সাতে পাঁচে কবিতায় অভিষেক পাল

ফিরে দেখা

আমাদের ২৫ টা বাড়ি র ছোট্ট পাড়াতে আমাদের বাড়িটা দ্বিতীয় প্রাচীনতম
সে সময়ে অধিকাংশ ই জয়েন্ট ফ্যামিলি, মানে যৌথ পরিবার
এইসব পরিবার, একান্নবর্তী হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে
না হলে,
শুধু কমন পায়খানা বাথরুম ছাড়া, সবই আলাদা
শান্তিপূর্ণ বা অশান্তি পূর্ণ সহাবস্থান আছে, কিন্তু সব পরিবারেই আলাদা আলাদা সরকার চলে
এমন পরিবার যেমন বাঙাল দের ছিলো, তেমনি ঘটি দের ও
অবিশ্যি যদি শতকরা হিসেব দ্যখা হয়, তাহলে হয় তো আমরা ৭০-৩০ এ এগিয়ে তখন
(এখন তো মারওয়ারী ব্যেওসায়ী ও ঢুকে গেছে!!)
একান্নবর্তী পরিবার কি জিনিস তার একটা স্ট্যান্ডার্ড নমুনা আমাদের পরিবার হতেই পারে
আমাদের ৪ দাদুর ৪ পরিবার,
একইসঙ্গে ৩ পুরুষের সহাবস্থান, একই বাড়িতে, বিরল বৈকি!
আমরা বাঙাল///
আমাদের বাড়িতে দাদু দের হাড়ি আলাদা হয়েছে, আমার জন্মের আগেই
আর শুনেছি, তবে ইস্তক, খাওয়া দাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে
কাঁচামাল এ নো কম্প্রোমাইজ,
তো, পরিশ্রম, হজমশক্তি, খরচা খরচ,
সব, বাজি
খেয়ে এবং খাইয়ে প্রমাণ করতেই হবে,
“উই আর দা বেস্ট”
এখন যদি দামি গাড়ি বা ফ্ল্যাট বা বিলাসবহুল জীবন যাপন স্ট্যাটাস সিম্বল ধরি, মানে ছোটো, বড়ো বিচারের প্যারামিটার, কমসে কম,
তাহলে তখন ছিলো, “খান পান”, মানে খাওয়া দাওয়া
প্রকট ভাবে আমাদের পূর্বপরুষদের মনে, এই বোধ টা কাজ করতো,
“পেটের জন্য সব কিছু, আমাদের বেঁচে থাকা, কাজেই নো কম্প্রোমাইজ উইথ পেট”, আর পেট মানেই রসনা তৃপ্তি
এতটা হালকাভাবে বললে বোধ হয় পুরো টা বলা হয় না
জন্ম থেকেই আমাদের পাড়ায় ঘটি বাঙাল এর একটা বেশ উপভোগ্য ডুয়েল চাক্ষুষ করে এসেছি
ঘটি বাঙাল এর ইগো, সে কি চাট্টিখানি ব্যাপার!
দাদুদের যখন মোটামুটি ফুল ফর্ম, তখন দেখেছি, ইগো কারে কয়?
খেলা শুরু সেই রান্নাঘরে ই,
৫-৭ টা পদ, দৈনন্দিন, ঘটিদের খাটো করার মারণাস্ত্র
বাজার ফেরতা, বাঙাল গৃহস্বামী, ঘটি কত্তা কে রোজ প্রশ্ন করেন, “কি নিলেন?”
ঘটি কত্তা হয় তো ঝোলা ব্যাগ টা সামান্য উচিয়ে বলতে গেছেন, “এই ৪০০ চারাপনা, একটু বেগুন…”
আমাদের বাঙাল বাবু তখন চকচকে ইলিশ জোড়া নাচাচ্ছেন, ” দ্যাখসেন, পোনে ২ কেজি এক এক খান”
খাওয়া দাওয়া তে আমরা মানে বাঙাল রা, ঘটি দের পিছনে ফেলতাম রোজ
যদিও লং রান এ ঘটি রা বাঙাল দের শত মাইল পিছনে ফেলে দিয়েছে, এখন যদি দেখি, অন্ততঃ আমাদের এলাকায়
আমাদের বাঙাল বাড়ি তে বরাবর বেশি পদ রান্না হয়, আমাদের সাইড ডিশ ও বেশি আবার খাওয়ার পরিমাণ ও বেশি
আমার ঠাকুমারা সব ডাকসাইটে রাধুনি ছিলেন
আজীবন এবং মৃত্যুর আগে অবধি ও লোককে রেসিপি শিখিয়েছেন, রান্না বান্না ওনাদের প্যাশন ছিলো
ঘটি বাঙাল ডুয়েল এ, এনারা বিরাট রোল প্লে করেছেন, বা বলা ভালো, সাকসেস ফ্যামিলির পিছনে এনাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো
আমরাও পুরো ফায়দা নিয়েছি, সেই সময়ের
পটল চিংড়ি, সুক্ত, বিভিন্ন রকম মাছের নাম না জানা সব পদ, পার্শে, বাটা, বেলে, ভোলা, কই, তেলাপিয়া, মৌরলা, পুটি, পাবদা ইত্যাদি ইত্যাদি
ইলিশের পদ গুলো না হয় বাদ ই দিলাম
তখন আবার এ বাড়ি, ও বাড়ি বাটি চালাচালি হতো
মানে ঘটি গিন্নি, বাঙাল গিন্নির বাড়িতে একবাটি স্পেশাল কিছু পাঠালেন, আর সেই বাটি স্পেশাল কিছুতে ভরিয়ে ফেরত করলেন, বাঙাল গিন্নি
শুধুই শান্তি বিরাজ করত, তা মোটেই নয়,
যেমন, পাশাপাশি বাড়ির বাঙাল বউ আর ঘটি বউ তে মারকাটারি পাওয়ার প্লে চলছে, এ বলে আমায় দ্যাখ, তো ও বলে আমায়
ঘন্টা ভর সময় পার হলেই, ঘটি শাশুড়ি মা হাঁক দিলেন, “বাঙাল দের মুখ লাগি স নে রে বউ, ছেড়ে দে, পারবি নি ওদের মুখের সাথে”
সেকেন্ড খানিক বাদেই বাঙাল শাশুড়ির গলা খকরানি, ” বৌমা, অনেক হইসে, থামো…”
সব চুপচাপ
ঘটি বাঙাল এর এই সহাবস্থান, এমনি তেমনি না
ভালোয়, মন্দ তে, সুখে দুঃখে, বিয়ে তে, শ্রাদ্ধ তে, জনমে, মৃত্যু তে, সব সময় বাঙাল আর ঘটি, হাতে হাত, কাধে কাধ
সময় বদলেছে, মানুষ ও
আজ শুধু ঘটি বাঙাল এ আর বাঙালির বিভেদ সীমাবদ্ধ নেই, ঘটি বাঙাল লড়াই টা কেবলই এখন সোশাল মিডিয়া তে “লোটা মাচা” খিস্তি আর পাল্টা খিস্তি তেই ঠেকে রয়েছে
অথচ মাত্র বছর ২০ আগেও এমন ছিলো না মোটেই
আমি ভিন রাজ্যে থাকি, বছরে ১/২ বার কলকাতায় যাই এখন,
গেলো বছর পুজোয় পাড়ার মোড়ে রক টায় বন্ধুদের সাথে বসেছি
বাইরে থেকে কেউ এলে, ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে আমাদের কাছে এগিয়ে আসবেন ই
আগে হলে এমন হতো…..
“ভাই, বাপিদের বাড়ি টা কোথায়, বলতে পারো”
__ ” কোন বাপি? স্কটিশ না এ ভি??”
আর এখন, মানে গত বছর, ঐ পুজোয়, আমাদের রক এ….
“ভাই, বাচ্চু দের বাড়িটা কোথায় হবে?”
— আমাদের পটলা, “কোন বাচ্চু? টি এম সি, সি পি এম, বি জে পি??”
আগন্তুক, একটুও না ঘাবড়ে, “দাঁড়ান, ফোন করে, একটু জিজ্ঞেস করে নি”….
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।