।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অমিতা মজুমদার

চিঠি

শিউলি ফুল,
এ নামেই মনে হয় ডাকতাম তোমাকে। তুমি ছিলে ঠিক শিউলি ফুলের মতো কোমল আর স্নিগ্ধ। তুমি আমার ঘরে এলেই মনে হতো শিউলি ফুলের গন্ধে ঘরটা ভরে গেছে। আবার তোমায় একটু ছুঁয়ে দিলেও তুমি ঠিক শিউলি ফুলের মতোই নেতিয়ে পরতে, যেন তোমাকে অনেক বড় আঘাত করা হয়েছে। তাই তোমার পেছনে লাগতে হতো খুব সাবধানে। মায়ের চোখে পড়লে আর রক্ষা থাকতো না। মা তোমার মুখ একটু বিমর্ষ দেখলেই বলতেন খোকা তুই আবার ওর পেছনে লেগেছিস ? মেয়েটা একটু আসে ,তুই কি তাও চাস না ? আমি মনে মনে বলতাম মা আমিতো চাই তোমার মেয়ে সবসময় আমার কাছে কাছে থাকুক। আমি শুধু তার উপস্থিতির গন্ধটুকুই অনুভব করি চোখ বুজে। কিন্তু তোমার আদরের মেয়ে তো আমার কথা কিছুতেই বোঝেনা। তাইতো মাঝে মধ্যে একটু জোর খাটাতে হয়।
আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হলেই বাবা আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেন কোচিং করার জন্য। ঢাকা এসে আমার সব কিছু কেমন বদলে যেতে লাগলো। এখানে এতো বন্ধু-বান্ধব পেলাম ,সবাই অনেক বেশি সাহসী। বাবার শাসন, মায়ের অনুযোগ কোনটাই এখানে ছিলনা। এখানে যাদের পেলাম তাদেরকে তোমার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হলো। তাদের সাথে গল্প করতে গেলে তোমার মতো ভয় পায়না। দূরে দূরে থাকেনা। আমরা একসঙ্গে খেতে যাই, ঘুরতে যাই। অন্য এক জীবন। যে জীবনের স্বাদ আমাদের ছোট্ট মফঃস্বল শহরে কল্পনাও করা যেতনা।
তাই আমি কখন যে তোমাকে ভুলে গেছি মনেও করতে পারিনা। তারপরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তুমিতো জান এটাই ছিল আমার স্বপ্ন। ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিকে যখন বাড়ি যেতাম, তুমি আসতে আমাদের বাড়িতে। তখন তুমিও বেশ বদলে গেছ। আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছ, সেই শিউলি ফুলের গন্ধটা আরো বেশি অনুভব করতাম। একদিন দূপুরবেলা মা নিত্যদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে, বাবাও স্কুলে। তখন তুমি এলে। আমি তোমাকে আগের মতোই কাছে ডাকলাম। তুমি না এসে ঠায় দরজায় দাঁড়িয়ে রইলে। আমার যে কি হলো, তোমার হাত ধরে জোরে টান দিলাম, তুমি তাল সামলাতে না পেরে আমার গায়ের উপর পড়ে গেলে। আমি তখন সেই শিউলি গন্ধে যেন জ্ঞান হারালাম। কয়েকদিন পরেই চলে এলাম আবার ঢাকায়।
এখানে পড়তে পড়তে আমার শেলির সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। শেলি আমার সাথেই পড়ে। সে ঠিক তোমার বিপরীত। তার যেটা ভালো লাগে সেটা সে করিয়েই ছাড়ে। আমার কোন আপত্তি খাটেনা। আমরা দিনে দিনে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। আমার বাড়ি যাওয়াও আগের চেয়ে কমে যেতে লাগলো। আসলে শেলি কে ছাড়া আমার থাকতে ইচ্ছা করতোনা। ততদিনে সেই পরিচিত শিউলি ফুলের গন্ধটাও আমি ভুলে গেছি।
হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়ি গেলাম। মায়ের শরীর বেশ খারাপ। বাবাকে বললাম মাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে। মাকে নিয়ে ঢাকা আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি , মা অসুস্থ অথচ তোমাকে কোথাও দেখলাম না। বেশ একটু খটকা লাগলো। একসময় মাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কথা। মা বললো ওরা তো প্রায় দুবছর আগে এখান থেকে চলে গেছে। তোমার বাবার বদলীর চাকুরী জানতাম। তাও কেন যেন ধরেই নিয়েছিলাম তুমি আজীবন এখানেই থাকবে।
ঢাকা আসার পথে মা ই বললো তোমরা এখন ঢাকাতেই থাকো। তুমি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো। আমি অবাক হয়ে গেলাম। একই শহরে পাশাপাশি শিক্ষায়তনে আমরা পড়ি অথচ একবারের জন্যও আমাদের দেখা হলোনা! নাকি তুমি ইচ্ছা করেই আমার সাথে দেখা করনা।
মাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়িতে পাঠালাম। মনে কেমন জেদ চেপে গেল তোমার সাথে দেখা করার। খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। পরে মনে হলো যে ইচ্ছা করে হারিয়ে যায় তাকে কি করে খুঁজে পাবো?
আমি শেলি দুজনে পাশ করে বিদেশে চলে এলাম উচ্চ শিক্ষার জন্য। তখন ভাবিনি বিদেশেই থেকে যাবো। কিন্তু ফিরে যাওয়া আর হয়নি। আমাদের ছেলে মেয়েরা, শেলি কেউই আর ফিরে যেতে চায়নি।
আমি মাঝে মাঝে দেশে যাই। এবারেও তেমনই এসেছিলাম মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। আর এভাবে যে তোমাকে পেয়ে যাবো স্বপ্নেও ভাবিনি। দেখি তুমি আমার আগেই পৌঁছে গেছ। সবকিছু একাই সামলাচ্ছো। প্রথমটায় তোমাকে চিনতে পারিনি। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। একহারা ছিপছিপে গড়নের শিউলি ফুল একটু যেন পৃথুলা। চুলগুলোও বেশ সাদায় কালোতে মেশানো ধুসর বর্ণের। তোমার সাথে কাজে কর্মে ঘোরাঘুরি করছিল একজন তাকে জিজ্ঞেস করতে বললো ওমা খোকা ভাই তুমি পারভেজ চাচার মেয়ে সিমু কে চিনতে পারলেনা। সিমু আপা তো এখন আমাদের এখানকার কলেজের প্রিন্সিপাল। এখানকার কলেজ কোয়ার্টারে মেয়েকে নিয়ে থাকে । অবশ্য মেয়ে ঢাকায় থেকে বুয়েটে পড়ে। ঠিক তোমার মতো।
এর মধ্যে একটি বছর বিশেকের তরুণী এসে আমাকে সালাম দিল । আমি অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি অবিকল আমার মায়ের মতো দেখতে। ছেলেবেলা সবাই বলতো আমি নাকি ঠিক আমার মায়ের মতো দেখতে। মেয়ে হলে একদম আমার মায়ের প্রতিমুর্তি হয়ে উঠতাম।
এরপরে আর বাড়িতে থাকতে পারছিলামনা । মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ফিরে যেতে হবে। কাজের অজুহাত দিয়ে মায়ের মিলাদ পড়িয়েই চলে এলাম।
ঢাকায় দুদিন হোটেলে থাকলাম,রোজ বুয়েটে যাই আর খোঁজ নেই সে এসেছে কিনা ? হ্যা তার নামটা জেনে এসেছিলাম, “শিশির”।এ নামেই সবাই তাকে ডাকে। একদিন তাকে পেয়ে গেলাম, তার সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম। জানতে চাইলাম তার বাবার নাম কি? সে অকপটে বললো আমি আমার বাবাকে কোনোদিন দেখিনি। তাই আমার কাছে আমার মা’ই বাবা ও মা।
তোমার মুখোমুখি হবার সাহস পাইনি, তাই একরকম পালিয়েই এলাম। সেই নরম শিউলি ফুলের মতো মেয়েটা এতো কঠিন একটা কাজ কিভাবে করলো ! এইরকম সমাজে থেকে ! কতোটা কঠিন সময় পার করতে হয়েছে তোমাকে আজ অনুভব করতে গিয়েও পারছিনা।
না তোমার কাছে ক্ষমা চাইছিনা। এতোকাল পরে ক্ষমা চাওয়ার কোন মানেও হয়না। শুধু বলি তুমি ভালো থেকো।
ইতি
খোকা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।