T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় আত্রেয়ী রায়

 শেষ বসন্ত

বাপির বাবা মারা গেলেন যখন , তখন তার বয়স পনেরো । ক্লাস এইটে দ্বিতীয় বছর (তখন ছেলেপুলেরা ফেলটেল করত ) । স্কুলের পাট চুকিয়ে নিয়মভঙ্গের পরদিনই দোকানের হাল ধরেছিল কাঁচা হাতে । পড়াশোনায় মাথা না থাকলে যে বুদ্ধিশুদ্ধি কম হয় না তার প্রমাণ এই ছেলে । পরবর্তী অনেক বছর ধরে তিল তিল করে ওই ছোট্ট মুদিখানাটিকে শহরতলীর সেরা দোকানে পরিণত করেছে সে । ন্যায্য দামে সেরা জিনিস আর ভালো ব্যবহারের জন্য বাপির দোকান প্রথম থেকেই ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ। ভোরে উঠে ঝাড়পোঁছ করা থেকে রাতে ঝাঁপ বন্ধ করা পর্যন্ত একাই সামলাচ্ছে সেই শুরুর থেকে । বাপির কাছে কোন ক্রেতা কোন জিনিস ‘নেই’ শোনেনি কখনো । দিনদিন শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে দোকানের। পাড়ার মোড়ে অমন ঝলমলে দোকান আর পরিচ্ছন্ন সুদর্শন তরুণ দোকানদার , যার ফল হল উপচে পরা ক্রেতা আর অচিরেই লক্ষীলাভ।

সে সময়টাও ছিল অন্যরকম । ঘরে ঘরে টেলিফোন আসেনি , ইন্টারনেট অধরা । তখন টিভিতে শচীন-সৌরভ , গানেতে সুমন-নচিকেতা আর বলিউডে খানত্রয়ী । অনেক পরিবার তখনও একান্নবর্তী । বাপির দোকানের সামনে চওড়া রাস্তা পেরিয়ে কোনাকুনি পুলকেশ মিত্রের তিনতলা বাড়ি। ডাকসাইটের সরকারি আমলা পুলকেশ মিত্তির স্ত্রী-কন্যা বাড়িতে রেখে ভিনরাজ্যে কর্মরত। রক্ষণশীল পরিবার । ভাইয়েরা সব ভালো চাকুরে । প্রৌঢ়া মায়ের অঙ্গুলিহেলানে চলে আঠারো ঊনিশ জনের বৃহৎ পরিবার। তখন বড় অফিসারের সন্তানও এলাকার স্কুলে স্বচ্ছন্দে পড়তে যেত। খেলতে আসত পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে । বাড়ির মেয়েরা প্রয়োজনে টুকিটাকি কিনতে বাপির দোকানে আসত যেত । পুলকেশবাবুর অষ্টাদশী কন্যা আমাদের গল্পের নায়িকা । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সে কলকাতার নামজাদা কলেজে ভর্তি হল । সালোয়ার কামিজ পরে মোটা বেনী দুলিয়ে ট্রেনে চেপে কলেজে যাওয়া শুরু করল বাপির দোকানের সামনে দিয়ে।

যৌবন আসলেই দিগ্বিদিকহারা, অপরিণামদর্শী, দুর্দম এক ঘোরসওয়ার । ওই যে মেয়ে যে কিনা রাজহংসীর মত অভিজাত , কলেজ ফেরত যার ঘর্মাক্ত মুখে দেবীর আদল , যে কিনা কলকাতার সবচেয়ে নামি কলেজে অর্থনীতির পাঠ নেয় , ফি শনিবার দুপুর বেলা মায়ের সাথে প্রমিতা মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখতে যায় আর সকালে তে’তলার ঘরে বসে বীনানিন্দিত কন্ঠে গায় , “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে …” , সে কিনা বাপির দোকানে শ্যাম্পু কিনতে এসে ইচ্ছে করে তার আঙুল ছুঁয়ে দেয় , একবার নয় বারবার ? দোকানের সামনে দিয়ে কলেজ যাবার সময় মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে বাপির দিকে চেয়ে লাজুক হাসে ? এও কি সম্ভব ?
গ্রীষ্মের ঝাঁঝালো রোদ্দুরে স্টেশনগামী রাস্তার দিকে চেয়ে চেয়ে চোখে ধাঁধা লেগে যায় বাপির । ওই পথেই ফিরবে সে। দোকান খালি থাকে ওই সময় । ঝাঁপটা নামিয়ে টেবিল ফ্যান চালিয়ে দোকানেই বিশ্রাম নেয় একটু । খুব সাহস ভরে ঠোঁট ফাঁক করে বড় আদরে ফিসফিসিয়ে ডাকে ‘রিনি … রিনি’ । ধীরে ধীরে চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসে , চোখে ঘোর লাগে । দোকান খালি দেখে সে মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, টুকটাক জিনিস কেনার অছিলায় মৃদু কন্ঠে সামান্য আলাপ করে । বাপির ফর্সা গালে লালের ছোপ লাগে । খুব যত্নে শব্দ চয়ন করে দু এক কথায় উত্তর দেয় অবান্তর প্রশ্নের ।

বছর যায় । মেয়ে কলেজ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে । ঘোড়ায় চেপে রাজপুত্র আসে রাজকন্যাকে নিতে । সারা পাড়ায় আলোর রোশনাই । মা দিদির হাতে উপহার ধরিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষায় পাঠায় বাপি। দোকানের ঝাঁপ ফেলে আলো নিভিয়ে নিঝুম বসে থাকে সারারাত । মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় ভেজা চোখে দোকান বন্ধ দেখে ।

তারপর আরো কতগুলো বছর । যুবক বাপি দোকান বড় করে দিদির বিয়ে দেয় । হালফ্যাশনের দোতলা বাড়ি হাঁকায়। নামি বহুজাতিক কোম্পানির বড় সাহেবরা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ডিসপ্লেতে সাজিয়ে দিয়ে যান নিজের নিজের কোম্পানির পণ্য । দোকানের এক পাশে জায়গা হয় কসমেটিকস বিক্রেতা কোম্পানির সেলসগার্লদের । বাপি ভুলেও কোনদিন বিড়ি , সিগারেট ,পানমশলা রাখেনি , পাড়ার বখাটে ছেলেদের আড্ডা জমতে দেয়নি দোকানে। জুলফিতে পাক ধরে সময়ের নিয়মে । মা বিয়ের তাড়া দিতে দিতে ক্লান্ত । এই পাড়ারই কত বদল । কত চেনা মুখ হারিয়ে গেল আবার কত নতুন কপোত কপোতী বাসা বাঁধল এসে । সেদিন যারা শিশু ছিল আজ তারা মোটরবাইক ফটফটিয়ে বেড়ায়। আশেপাশে হালফ্যাসানের গ্রোসারির দোকান হয়েছে কত , তবু এ পাড়ার লোকের কাছে বাপির দোকানই বড় ভরসা ।

অবশেষে মা শয্যা নিলেন। দিনরাতের আয়া এলো দেখাশোনার জন্য । দিদির দুই ছেলের বড়টিকে নিজের কাছে এনে মানুষ করতে লাগলো বাপি । রং চটা তেতলা বাড়ির তেতলার ঘরে আজকাল আবার আলো জ্বলে রাত অবধি । রিনি ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে । দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঠাকুমা , নম্রমুখী মা কবেই গত হয়েছেন। রিটায়ার্ড বৃদ্ধ পুলকেশ মিত্তির থাকেন একা , দোতলায় । সব ভাই-বোনেরা, ভিনদেশে ভিন রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। একতলায় ওর পিসির ছেলে থাকে পরিবার নিয়ে । কাকারা ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন আগেই । সকালের দিকে বাবার হাত ধরে হাঁটতে নিয়ে বের হয় রিনি । কপালের পাতলা হয়ে আসা চুলে , কুঁচকানো চামড়ায় বিরক্তি , অপ্রাপ্তি আর অভিযোগ । কখনো এদিকে চোখ পড়লেও দৃষ্টিতে আর ফুটে ওঠে না কোন ভাষা , ছায়া ফেলে না অতীতের কোন স্মৃতি । বাপি ভাসা ভাসা শুনেছে , স্বামী শ্বশুরবাড়ি ভালো ছিল না । কোনদিনই বনিবনা হয়নি । মাঝে মাঝে দোকানে এসে এসব বলে নিজে থেকে । বাপি কোন প্রশ্ন করেনা ।
—ওরা বলে আমার মাথার দোষ । নার্ভের ওষুধ খাই মানে কি পাগল বলো ? আপনমনে বলতেই থাকে ,
—বাচ্চাটা স্বাভাবিক হয়নি তো , সব নাকি আমার জন্য । সেবার অসুখে চিকিৎসা করতে দিল না ভালো করে । বাঁচাতে পারিনি আর ।
আজকাল রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বড্ড বেড়েছে । গভীর মমতায় দোকানের বাইরের চওড়া রাস্তা টুকু পার করে দেয় বাপি। চেয়ে থাকে যতক্ষণ না বাড়ির গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে মেয়েটা।

কত রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে তেতলার ঘরে । ওষুধ খেতে ভুলে গেলে ঘুম আসে না ওর , জানে বাপি । চেয়ে থাকতে থাকতে ঝিম লেগে যায় চোখে। নিশুতি রাতের বুক চিরে ভেসে আসে কোন পাড়ার কুকুরদের সমবেত ডাক । তে’তলার ঘরের জানালায় চেনা অবয়ব । মৃদুকন্ঠ ভেসে আসে , “মধুর তোমার শেষ যে না পাই…”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।