T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় অসীম কুমার রায়

যারা মদ্যপানের বিরোধী

ফিনফিনে গ্লাসে কাঁচে টলটলে তরল হাতে নিয়ে রণদেব বলে ওঠে, চিয়ার্স -।

ওমনি সমস্বরে ওর চার বন্ধু বলে,

– চিয়ার্স।

রণদেব বলে, এই তো জীবন। চালাও ফোয়ারা -।

চার বন্ধু, এই ঠেক দীর্ঘজীবী হোক। এই ঠেক দীর্ঘজীবী হোক।

চার বন্ধু বলতে, বান্টি,তপন, পরিমল ও ধ্রুব।

রণদেব মদ খায়। অফিস ছুটির পর মাঝে মাঝে ওরা পাঁচজন এই বান্টির ঘরে পার্টি বসাই। বান্টির বৌ নেই। এখনো অবিবাহিত। বান্টি বলে, বৌ মানেই তো হাজার গণ্ডা কড়াকড়ি, বিধিনিষেধ। এই বেশ আছি।

মাঝে মাঝে রণদেব একটু আধটু বেশি খেয়ে ফেলে। হুশ থাকে না। সেদিন হয়তো ঘরে ফিরতে ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে যায়। ওর বৌ ঝাঁটা হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুলেই বলে, ভেবেছোটা কী তুমি? এভাবে ফুর্তি করে পয়সা কটা ওড়াবে! সংসারটা পথে নামাবে?

– বেশ করেছি আমি, শালা নিজের পয়সায় মদ খাই। কোন শ্বশুরের পয়সায় নয়। আর একটু আধটু মদই খাই মাঝেমাঝে। কোনো মেয়েমানুষের কাছে তো যাই না!

– সেটুকু আর ফাঁক রাখ কেন! রাতটা ওখানে কাটিয়ে আসলে তো পারতে! আমি বাঁচতাম। ওর বৌ কাঁদতে থাকে।

সকালে উঠে মনে মনে অনুশোচনা হয়। রণদেবের কালকের রাত্রিরের কথাগুলো মনে পড়ে। ও বৌকে আদর ও সোহাগ করে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমু দিতে গেলে বৌয়ের ঘুম ভেঙে যায়। রেগে উঠে এক ঝটকায় হাত ধরে টেনে সরিয়ে দেয়। রণদেব থামে না। বৌয়ের পা টিপতে থাকে। পা দুটো ধরে বলে, ক্ষমা-ক্ষমা-। বৌ হেসে ফেলে ফিক করে। হাত ধরে টেনে তোলে। বলে, আর কোনদিন খাবে না বল-। রণদেব বলে, promised আর খাব না। দিন যায়। রণদেব বাজারের থলি হাতে নিয়ে বাজারে বেরিয়ে যায়। দিন সাতেক ভালোভাবেই কাটে। ঠেকের দিক হাতছানি দিলেও একাদশী পালন করে রণদেব।

তারপর একদিন-। যথারীতি বাড়ির রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিল ও। বেশ কয়েকদিন খুব গরম পড়েছিল। খানেক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। শনিবার। বন্ধের দিন। বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ থাকে এই দিন। রণদেব খোলা দোকানগুলো দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবতে থাকে…। একি? এটা কী হল! দোকানদাররা খদ্দের ভুলে তার দিকে চেয়ে হাসছে কেন? এমনিতেই রাস্তায় লোকজন কম। যে দু-চারজন মানুষের সাথে তার চোখাচোখি হচ্ছে, তারাও মনেহচ্ছে তার দিকে চেয়ে হাসছে। – আশ্চর্য! বড় রাস্তার মাঝে যে পাতা বাহার রঙিন গাছগুলো বসানো হয়েছে তারাও এমনভাবে হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে দেখে মনেহচ্ছে, যেন হাসছে! রাস্তায় জায়গায় জায়গায় চটা ওঠা পীচও হাসছে! এত হাসির যে কী হল! হাসুকগে। রণদেবও আর থাকতে পারে না, হাসতে থাকে হো- হো- করে।

ঠেকের দিকে পিছন ফেরে ও। দু’তিন পা এগোয় আবার পিছিয়ে আসে। সামনে ঘোরে। বাড়ির দিকে। কয়েক পা চলার পর – মনেহয় দূর। সাত আটদিন তো গ্যাপ দিয়েছি। এবার একদিন খেলে কি হবে আর! পিছন ফিরে হনহন করে এগিয়ে যায় রণদেব। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ঠেকে গিয়ে পৌঁছায়। ওকে দেখে বন্ধুরা,হিপ্ হিপ্ হুরেরে করতে শুরু করে। রণদেব বলে,আজ কিন্তু বেশি খাব না। ঠিক আছে গুরু,অল্পই খাও। জোর করব না। ওর বন্ধুরা বলে। চার পেগ খাওয়ার পর রণদেব অনুভব করে শরীরের ভিতরে এক অস্বস্তি হচ্ছে। অনেকদিন না খাওয়ার জন্যই মনেহয়। এটাকে বলে হ্যাং ওভার। এটা কি করে কাটিয়ে ওঠা যায়! আরও দু’পেগ নেয়। উহু্। কমেনা। আরো এক পেগ নেয়। এবার ভেতরটা হাল্কা হয়। মেজাজটা ফুরফুরে হয়। হ্যাং ওভার কাটে। মাথার মধ্যে মনেহচ্ছে এক হাজার একটা প্রজাপতি দৌড়াদৌড়ি করছে। আরো এক পেগ নিয়ে খেতে লাগে। দু’চুমুক দেওয়ার পর পেটে লাগে। ব্যথা শুরু হয়। ব্যথাটা আস্তে বাড়তে থাকে। একসময় অসহ্য হয়ে উঠলে ও বন্ধুদের ডাকে। বন্ধুরা ছুটে আসে। বলে, বমি বমি পাচ্ছে? তাহলে চল বাইরে গিয়ে বমি কর। রণদেব উঠে বাইরে গিয়ে মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে। বমি হয়না। অল্প একটু হয়। পেট ব্যথা কমে না। বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে। কি করবে এখন! ধরাধরি করে রণদেবকে ওর বাড়ি নিয়ে যায়। ওর বৌ দরজা খুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বন্ধুরা ওকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে কাছেপিঠে কোয়ার্টার থেকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসে। হাসপাতালের সার্জেন্ট। ডাক্তার অনেকক্ষণ পরীক্ষা করে। ব্যাগ থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে। ওকে খাইয়ে দেওয়ার পর রণদেব বাথরুমে গিয়ে ক্রমাগত বমি করতে থাকে। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখে। ওর বৌকে বলে, ঔষুধ দিচ্ছি ব্যথাটা কমে যাবে। কালকে এই মেডিক্যাল টেস্টগুলো করিয়ে আমাকে দেখিয়ে নেবেন। তারপর ঠিক করব, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে কিনা! আর একটা কথা, উনাকে ইমিডিয়েট মদ ছাড়তে হবে। না হলে এরপর আর বাঁচানো যাবে না। মদ ছাড়ান।

ভিজিট নিয়ে ডাক্তার চলে গেল। রণদেবের বন্ধুরাও চলে গেল। ওর বৌ ওর সাথে একটাও কথা বলল না। দু’দিন ধরে কথা বন্ধ। পাঁচদিন পর রণদেব একটু সুস্থ হয়ে অফিস বেরয়।

– আমি কিন্তু আজ বিকেলে বাপের বাড়ি যাব। তুমি চাবি নিয়ে যাও, ওর বৌ বলে। রণদেব জিজ্ঞেস করে,কেন?

– কেন কি? আবার জিজ্ঞেস করচ্ছো।

– আমি তো আর ছোঁব না বললাম।

– ওরকম অনেক বলেছ আর না।

– প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। রণদেব বলে।

– কোনো কিছুই নয়। অনেক হয়েছে। আমি আর থাকতে পারছি না তোমার সাথে জাস্ট । ওর বৌ বলে।

রণদেব ব্যেজার মুখে চাবি নিয়ে অফিস বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি আসে। দেখে বৌ আছে। শশুরবাড়ি যায়নি তাহলে! মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু প্রকাশ করে না। সংসার চলতে থাকে। আবার মিল হয়ে যায় দু’জনের। দিন যায় দিন আসে। রণদেব এখন আর ঠেকের রাস্তা ভুলে যেতে চেষ্টা করে। চারমাস কেটে যায়। ইতিমধ্যে একদিন ধ্রুবর সাথে দেখা হয়। রণদেব ধ্রুবকে সব বুঝিয়ে বলে। ধ্রুব বলে, ছেড়ে দে তাহলে আর মদ ছুঁস না। তাই ঠিক করেছি। রণদেব বলে। তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস? আর বলিস না। কাল টোটনদা আমাদের একটা পার্টি দিচ্ছে। ধ্রুব বলে। মাছ মাংস মদ – যে যত খুশি খেতে পার। তারই বাজার করতে বেরিয়েছি। টোটনদা এখন তো মুম্বাইতে থাকেন! একটা সিনেমায় আর্ট ডিরেক্টরের কাজে চান্স পেয়েছেন। -ও। রণদেব বলে।

– পারিস তো কাল চলে আসিস। মদ নাই বা খেলি।মাছ,মাংস ফ্রাইড রাইস খাবি। ধ্রুব বলে। রণদেব বলল, দেখি।

বৌ নেই। একা একা ভালো লাগে না রণদেবের। শ্বশুর খুব অসুস্থ। সুগার প্রেসার আলার্জি আজমা একশো আটটা রোগে ভোগে সবসময়। মাঝেমাঝে যখনি বাড়াবাড়ি শুরু হয়,তৎক্ষণাৎ ওর বৌ বাপের বাড়িতে হাজির হয় । আজ নিয়ে তিন দিন হল। আরও চারদিন পরে আসবে। কাল কি একবার ঠেকে যাবে! না থাক। যে জিনিস একবার ছেড়ে দিয়েছি আবার নতুন করে ধরলে বিপদ হবে। কই তার বৌ তো একবারও তার কথা ভাবল না। কী খাচ্ছি কীভাবে আছি! দু’দুটো শালাগুলো কী করে? ধর্মের ষাঁড়। শিবের বাহন। খালি নিজের নিজের সংসার সামলাচ্ছে।একজন দুটো, আরেকজন তিনটা, বাচ্চা,বৌ নিয়ে সুখী পরিবার। বুলাদিকে খুব মানে। বৌ-দের সাথে মাঝে মাঝে এক দু’দান লুডোও খেলে মনেহয়।

অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে নিজেকে খুব অসহায় লাগে রণদেবের। বাড়ি ফিরে সেইতো সেই টিভি না হলে খবরের কাগজ। একঘেয়ে সিরিয়াল, নয়তো সবসময় আতঙ্ক! গোটা কাগজ জুড়ে খুন, ধর্ষণ, ব্যাংকগুলোর অনাদায়ী ঋণ,ফেরত পাওয়ার টাকার অনিশ্চিয়তা, সোনার মূল্য বৃদ্ধি, শেয়ারের ধস, টাকার পতন…। ভাল্লাগেনা। সত্যি সত্যি একদিন ও ফোবিয়ায় আক্রান্ত হবে। রণদেব ঠেকের দিকে পা বাড়ায়। ঠেকে পৌঁছাতে টোটনদা ও কে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, কী খাবি বল? রণদেব বলে, ড্রিঙ্কস্ করব না।

– সেই ভালো। আপাতত দুটো ফিস ফ্রাই খা। টোটনদা বলে।

ফিস ফ্রাই খেতে খেতে রণদেবের কী মনেহয় এক পেগ হুইস্কি দিতে বলে। খাবি আবার! যদি কিছু হয়! পরিমল বলে। কিচ্ছু হবে না, দেতো। এক পেগের পর আরেক পেগ নেয়। সকলে নিজের নিজের আনন্দে মত্ত। ওর দিকে কেউ আর অত লক্ষ্য করে না। ব্যাপারটা খারাপ লাগে ওর। ওকে যেন খানিকটা আন্ডার এস্টিমেট করছে বন্ধুরা। রণদেব কিছুটা রাগে,

কিছুটা বিষণ্ণতায় আরও চার পেগ ঢকঢক করে গিলে ফেলে।

অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় রণদেব অজ্ঞান হয়ে পড়লে, ধ্রুব আর বান্টি মিলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেয়।বন্ধুরা ওর বৌকে ফোন করে। সকালে সব মেডিক্যাল টেষ্ট হয়। একটা কিডনি পুরো নষ্ট হয়েছে। লিভার ও ত্রিশ পারসেন্ট খারাপ। অবস্থা খুব সিরিয়াস। মেজর অপারেশন। একটা কিডনি পুরো বাদ দিতে হবে। ডাক্তারবাবু বলেন, আপনাকে বলার পরও মদ ছাড়তে পারলেন না! এখন কী হবে? রণদেব বলল, আমি অনেক চেষ্টা করছি ডাক্তারবাবু। কিন্তু কিছুতেই পারছি না। আগে আগে শরীরের ক্লান্তি তারপর একটু মানসিক আনন্দের জন্য মদ খেতাম। মাসে দু’একদিন। কিন্তু এখন আর আমি মদ না খেতে চাইলেও মদ আমাকে খায়…। কী করব ডাক্তারবাবু! ওসব ডায়লক মেরে কি করবেন। এখন তো আপনাকে বাঁচানোই মুস্কিল। ডাক্তার বললেন।

রণদেবের বৌ ফোঁপাতে ফোঁপাতে ডাক্তারবাবু পা জড়িয়ে ধরে। রণদেব ডাক্তারবাবুর দুটো হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, যেভাবে হোক আমাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু-।

– কেন বেঁচে কি করবেন, ডাক্তারবাবু বললেন।

– সকলেই তো বাঁচতে চায়। আমি বাঁচতে চাই ডাক্তারবাবু। ভীষণ বাঁচতে চাই।

– সব্বাইতো আপনার মতো মদ খায় না।

– সব্বাই মদ খায় না ডাক্তারবাবু। আমি মদ খাই। কিন্তু সব্বাই মাদকতা লুকিয়ে রাখে বুকের ভিতর। কাউকে বলে না। রণদেব বলে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।