কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখালেখির ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন কবিতা রচনার ক্ষেত্রে। যদিও কবিতা ছাড়াও শিল্প-সাহ্যিতের অন্যান্য সকল শাখাতেই তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। তবে তিনি কখনোই কবিতা পরিত্যাগ করে যাননি। কবির সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবনের অন্যতম কাজ ছিল, সত্যান্বেষণ এবং অসীমকে জানার সীমাহীন এক আকুতি। আর শেষবেলায় এসে যেন কবির বিশ্বাসের সাথে এক অবিশ্বাস এবং সংশয়বাদী বিষয় এসে তাঁর চেতনায় আঘাত হেনেছে। বয়োবৃদ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোগশয্যায়ও মৃত্যুঞ্জয়ী কবি। কারণ, মৃত্যুও তাঁকে উপহার দিয়েছে পরম পূর্ণতা। পার্থিব জীবনের ন্যায় তিনি মৃত্যুকে ভোগ করেছেন। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের জীবনকে দিয়েছে সম্পূর্ণতা। পার্থিব নানা দুঃখ-বেদনা রোগশোকে কাতর হয়ে যেন তিনি লাভ করেছেন দিব্যজ্ঞান। নিদারুণ দুঃখকষ্ট আর বেদনার মধ্যে দিয়ে বুঝেছেন মৃত্যু-বিভীষিকা ছায়াবিথির মতো অবাস্তব একটা বিরাট অন্ধকারের পটভূমিকায় নিপুন শিল্প মাত্র। সৃষ্টির পথ বিচিত্র মায়াজালে আকীর্ণ। জীবন ঘিরে মিথ্যা বিশ্বাসের নিপুন ফাঁদ বিছানো। অনায়াশে এই ছলনার মোহজাল ছিন্ন করতে না পারলে অক্ষয় শান্তির অধিকারও লাভ করা যাবে না। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাই হয়তো কবি সহসা সংশয়বাদী চেতনায় আক্রান্ত হয়েছেন নচেৎ হয়তো তিনি সেই সময়ে এই রকমের অজানা ও অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিতেন না তার তার ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতায়:
বৎসর বৎসর চলিয়া গেল
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ-প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়
কে তুমি।
পেল না উত্তর।
মানবজীবনের চূড়ান্ত এই সত্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কাব্যরচনার প্রাথমিক পর্যায়ে আবিষ্কার করেন; ধরতে পারেন তার স্বরূপ এবং মৃত্যুর নিকট জীবনের পরাজয়কে মেনেও নেন। কিন্তু কখনই মানুষের অবসান মেনে নেননি। তিনি দীর্ঘ পার্থিব জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনকে ভালোবেসেও মৃত্যুর সামনে কীভাবে সমগ্র বিশ্ব-প্রকৃতিই পরাজিত হয় বারংবার। মানুষ তারপরও আশায় বুক বাঁধে ছোট্ট শিশুটির ন্যায় অবোধ আকুলতা দিয়ে বৃথাই ধরে রাখার ব্যাকুল বাসনায়:
মৃত্যু হাসে বসি। মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই?
অনন্ত সংসার, বিষণœ নয়ন-’পরে
অশ্রুবাষ্পসম! আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময়…।
বিশ্বময় প্রকৃতির সকল ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে রয়েছে অগনিত অনুরণিত সংগীত। পাখির কলতানে, পাতার মর্মরে, বহতা নদীর স্রোতে, অন্তরীক্ষের চন্দ্রে এবং হাওয়ায় সর্বদা ভেসে বেড়াই সেই সব বহুমাত্রিক সুরধ্বনি। সেই সুরধ্বনির অনুরণন হয় সংবেদনশীল মানব হৃদয়ে তাই মানুষের ভেতরটা যখন দুঃখ-কষ্টে উদ্বেলিত হয়, আলোড়িত হয় তখন সুরের ইন্দ্রজালে বাঁধা মানবহৃদয়ে সৃষ্টি হয় সংগীতের। সেই সংগীত জীবনদর্শনের মাঝে এমন একটি প্রত্যয় হয়ে ওঠে যেখানে মানুষ কিছুটা শান্তি পেতে পারে, ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় পেতে পারে। মোটকথা গান মানব-আত্মার সাথে বর্হিজগতের যে মেলবন্ধন করে থাকে সেই অলীক সাঁকোয় উপরে যেন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পরমআত্মা অনস্ত সুরের এক ইন্দ্রজাল হিসাবে। আর সেই ক্ষেত্রে বাঙলা সংগীতের পটভূমিতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বিরাট বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন; যা একই সাথে কালের এবং মহাকালের।
জীবনের বিবিধ পরিচর্চা থেকে তিনি রচনা করেছেন সেই সব গান, যা বোধের নিবিড় প্রান্ত থেকে জীবনের অনাবিল ফেনিল তরঙ্গে স্নাত হয় বারংবার। কাজেই তাঁর সংগীতের ভেলায় স্বচ্ছন্দে পরিভ্রণন করে বুঝে নেয়া সম্ভব হয় সত্তার রঙ্গলীলার, সীমান্তরেখা আর তার রঙ। জীবনের দূর্গমভূমে যতো সব মেঘমালা, বারিবর্ষণের লুকোচুরি, যতো সব অন্ধকার ছেয়ে থাকে মন ও মননের লুকারো গলিপথ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে গেছেন সেই সব অজানা-লুকানো প্রান্তর-দিগন্তের খবর তাঁর অজস্র সংগীতের বিচিত্র সজ্জায়। আর সেই ক্ষেত্রে অনায়াশে বলা যায় তাঁর গান যেন আমাদের জীবনের সঙ্গী অধরা মাধুরীর স্পন্দনে। আর এই প্রসঙ্গে কবি স্বয়ং নিজে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, তাঁর গানই বাঙালির চিত্তে সবচেয়ে স্থায়ী আসন গ্রহন করবে। অর্থাৎ তাঁর গান চিরদিন বেঁচে থাকবেÑ এই বিশ্বাস কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজীবন পোষণ করেছেন। কারণ তিনি বাঙালির মনোজগতের চিরায়ত নান্দনিক রুচির, সৌন্দর্যবোধের সবগুলো আঙিনায় উঁকি দিয়েছেন এক অনাবিল আগ্রহে-কৌতুহলে। আর হয়তো সেকারণেই তাঁর গান আমাদের চিনিয়ে দেয় অস্তিত্বের অজানা রহস্যকে, নিয়ে যায় পার্থিব জগত থেকে ভিন্ন এক অচেনা ভুবনে, সৃষ্টিকর্তার আলোকিত উদ্যানে।
মানুষ ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে তিনি সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পেয়েছিলেন: সে-বোধেই তাঁর গান অপূর্ণ মানবপ্রেমের নাগপাশ ছেড়ে পরমপ্রেমে উন্নীত হয়েছে।