সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১)

যুদ্ধ যুদ্ধ

এক
মানুষটা ঢ্যাংয়া, মিশমিশে কালো, পরনে খেটো ময়লা ধুতি, গায়ে কিছু নেই, মাথায় একটা লাল গামছা ফেট্টি দিয়ে বাঁধা। কাঁধে হাজারটা রঙিন তাপ্পি দেওয়া একটা কালো কাপড়ের ঝোলা। একরকম ধুঁকতে ধুঁকতে মানুষটা পশ্চিম দিক থেকে শ্মশানের দিকে হেঁটে আসছে। এবড়োখেবড়ো পথ চলতে শরীরটা তার টাল খায়, উপরনীচ হয়। সেইসঙ্গে অনেক দিনের আতেলা, আধোয়া, পাটের মতো চুলগুলো দুলে দুলে ওঠে। বয়স চল্লিশের উপরেই হবে। গলায় তিন ফেরতা তুলসির মালা। কপাল, বাহু আর কন্ঠার গোড়ায় ঘামে আলগা তিলকের ছোপ। দাড়িগোঁফে পাক ধরতে লেগেছে। হাড় জাগা মুখাবয়বে দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি আর খিদেতেষ্টার ছাপ। সারা শরীর ঘামে জবজবে।
একসময় মানুষটা দাঁড়িয়ে পড়ে, কপালের উপর হাতের ছাউনি করে চারিদিকে চোখ চালিয়ে কী যেন খোঁজে।
জ্যৈষ্ঠের ভরদুপুর, পৃথিবী পুড়ছে, ভাটিদেশের পাগল বাতাসে নোনা গন্ধ। আকাশমাটি জুড়ে আগুনে হল্কার সমুদ্র। খটখটে, নির্মেদ চারদিক। কাছেই হোগল নদীর বেয়ারা রকমের বাঁক। ভাটায় একফালি দড়ির মতো পড়ে আছে। শুকনো চরে সুচের মতো দাঁতালো ঘাস। একঠ্যাংয়া লাল কাঁকড়া পুড়ে মরার ভয়ে গর্তে লুকিয়ে। একটা ভাঙা নৌকোর হাড়গোড় মাটিতে মিশছে। বাঁকে বড় গাছপালা নেই। ভেড়িবাঁধের গা বরাবর ফণিমনসা, বাঁশবরণ কাঁটাঝোপ আর বনতুলসির জড়ামুড়ি। বাঁকের গায়ে শ্মশান। ছড়ানোছিটানো আধপোড়া কাঠ আর অংগার। এক কোণে একটা মাটির ঘর।তার চালা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। সামনে মাটির তুলসিমঞ্চের গাছটা শুকিয়ে কঙ্কাল। পুবদিকে একটা জলা। তাতে থকথকে কাদা। গুলে মাছেরা তাতে ঘুরপাক খায়।
শ্মশানের দক্ষিণে রুইদাসদের পাড়া। সামান্য উঁচু এক টুকরো ডাঙায় মাটির দেয়ালের উপর খড়ের ছাউনি করা খুপরি খুপরি কটা ঘর। বহু বছরের পুরনো খড়ের ছাউনি রোদের তাপে ছাইবর্ণ। মাঝে একফালি উঠোন।ভেড়িবাঁধের গা ধরে যে রাস্তাটা আরও পশ্চিমে গেছে তার দু’প্রান্ত জুড়ে গ্রামের বাজার। বাজারের শেষ সীমায় লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, কালীর থান। আরও যত পুবদিকে যাওয়া যায় ততই ভাটিদেশের হতকুৎসিত উলঙ্গ চেহারা প্রকট হয়ে ওঠে।
কয়েক মুহূর্তে মানুষটার মিয়ানো মুখাবয়ব খুশিতে ভরে ওঠে। চোখজোড়ায় হাসি ফুটে ওঠে। যেন সে তার পরম কাঙ্খিত কিছু জিনিস পেয়ে গেছে। দ্রুত পা চালিয়ে সে রুইদাসদের বসতিটার দিকে এগিয়ে চলে।
উঁচু ডাঙাটার গা ধরে রাঙচিতা গাছের ঘের। তার এপারে দাঁড়িয়ে মানুষটা সম্ভবত যাচাই করতে থাকে, সে ঠিক জায়গায় এসেছে তো!
কটা নেংটো বাচ্চা উঠোনের একপাশে নিজেদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। কুস্তি লড়ছে। এদিকে মানুষটা যে কখন হাঁটু মুড়ে বসে বেজায় হাঁপাতে থাকে সে খেয়ালও ওরা করে না। বা করলেও তাতে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করে না। এই গরীবগুর্বোদের উঠোনে ভিখিরিরাও কিছু প্রাপ্তির আশায় কখনো কখনো ঢুকে পড়ে। বাচ্চাগুলো মানুষটাকে সম্ভবত ভিখিরিই ভাবে। তারা জানে,ভিক্ষা না পেয়ে একসময় নিরাশ হয়ে ঠিক ফিরে চলে যাবে। মানুষটা চারিদিকে তাকায়। বয়স্ক কাউকে খোঁজে। কোথায় তার পরিচিত মানুষজন! সব ঘরের দরজা ভেজানো। বয়স্করা ভেতরে ভাতঘুমে কাদা হয়ত। কিন্তু তার যে খিদে পেয়েছে জোর। সেইসঙ্গে তেষ্টায় বুকের খাঁচা গুড়িয়ে যেতে চাইছে। খাবার না হোক অন্তত একটু জল চাই তার এক্ষুনি। কিন্তু কার কাছে চাইবে! পরিচিত লোকগুলোর নাম ধরে একবার ডাকবে কি? পরক্ষণেই ভাবে, এতবছর পরে তারা তাকে চিনতে পারবে তো! নাকি চিনলেও বোঝা মনে করে এড়িয়ে যাবে। কোনও দায়দায়িত্ব নিতে চাইবে না। মানুষটা ভাবে, হ্যাঁ, সেরকম পরিস্থিতি হলে কী করে তার মোকাবিলা করতে হয় তা তার ভাল করেই জানা আছে। সে গোঁসাইবাবার ছেলে বলে কথা, মুখ বাজিয়ে ঝাড়েবংশে নিব্বংশ হওয়ার অভিসম্পাত দিলে বুকের খাঁচা মুহূর্তে আত্মাশূণ্য হয়ে যাবে না সবার! সবগুলো হুমড়ি খেয়ে এই পায়ে পড়ে ক্ষমা না চেয়েছে তখন!
মনে মনে মানুষটা চোখা চোখা কিছু শব্দ অস্ফুটে উচ্চারণ করে মুখটাকে শানিয়ে নেয়। তাতে করে বেশ একটা তৃপ্তিভাব চোখেমুখে ফুটে ওঠে মানুষটার। একসময় মানুষটা লক্ষ করে, একটা বছর সাত আটের প্যাকাটি চেহারার রুগ্ন ছেলে ওই হুটোপাটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার মাথায় রুক্ষ লাল চুল, লম্বাটে মুখমণ্ডল, নাকে সিকনি, সম্পূর্ণ উলঙ্গ। গলায় কালো কার দিয়ে ঝুলানো একটা তাবিজ আর কিসের যেন একটা লকেট। সম্ভবত শরীর মনের দুর্বলতাই তাকে খেলাধুলো থেকে নিরস্ত করে রেখেছে। মাঝেমধ্যে ওদের খেলা দেখে মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে হেসে উঠছে।
ও খোকা, ও খোকা। দুবার ছেলেটাকে ডাকল মানুষটা।
ছেলেটা মানুষটার দিকে তাকাতেই সহসা তার মুখমণ্ডল থেকে সমস্ত রক্ত সরে গিয়ে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। সেইসঙ্গে চোখের মনি দুটো স্থির হয়ে গেল।
মানুষটা বুঝতে পারল, ছেলেটা তাকে দেখে ভয় পেয়েছে। কিন্তু এর কারণ মানুষটা বুঝতে পারল না। ভাবে, তাকে কি ভয়ংকর দেখতে লাগছে! আয়নায় নিজেকে একবার দেখার মন হয় তার। ঝোলা থেকে আয়নাটা বার করতে চায়। তারপরই ভাবে, না, ওসব এখন থাক, আগে তেষ্টা মেটাতে হবে তাকে,কন্ঠা শুকিয়ে খটখটে একেবারে, পেটেও কিছু দিতে হবে। মানুষটা এও বুঝল, ছেলেটার ভয় ভাঙ্গিয়ে দিতে হবে। সে কি বাঘ না ভাল্লুক! ছেলেটা মানুষটার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। যেন ভয়ে বোধবুদ্ধিহীন হয়ে পড়েছে।
মানুষটা তার দুর্বল ডান হাতটা উঁচিয়ে আঙুল আর চোখের ইশারায় বারকয়েক ছেলেটাকে কাছে আসার ইঙ্গিত করল।
ও বাবা গো, ছেলেধরা! ছেলেটা চিৎকার করে বলেই এক দৌড়ে একটা ঘরের দাওয়ায় উঠে পড়ল।
মানুষটা হতভম্ব। ভাবে, এ ভারি মুসিবতে পড়া গেল তো!
বাচ্চাদের দলটা কয়েক মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তারা খেলা ভুলে ছেলেধরা খোঁজে।
কোথায় বলদিকি, ছেলেধরা! একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল।
রুগ্ন ছেলেটা দাওয়া থেকে ভয়ে ভয়ে হাত উঁচিয়ে মানুষটাকে দেখিয়ে দেয়।
মুহূর্তের মধ্যে, ছেলেধরা ছেলেধরা, চিৎকারে বাচ্চাগুলো পাড়া মাথায় তুলে হুড়মুড় করে যার যার ঘরের দাওয়ায় উঠে আসে।
আমাকে চোখ টিপে, হাত উঁচিয়ে ডাকছিল রে! কাছে গেলেই ওই ঝোলায় ভরে নিয়ে চলে যেত! রুগ্ন ছেলেটা ভয়তাড়িত গলায় বলল।
শুনে বাকিরা ওরকমই আশঙ্কা করে আরও জোরে চিৎকার জুড়ে দিলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব ঘরের দরজা খুলে গেল। কাঁচাঘুম চোখে যত বউঝি আর বুড়োবুড়িরা দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের আগোছালো শাড়ি, কাপড়, চুল। চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন। সেইসঙ্গে আশঙ্কা, সত্যিই ছেলেধরা এল বুঝি পাড়ায়। সে মানুষটাকে আচ্ছা শিক্ষা দেওয়ার এক কঠিন সংকল্প তাদের অঙ্গভঙ্গিতে।
কোথায় ছেলেধরা, কোথায়? প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে বড়রা জানতে চায়।
ঐ, ঐ বসে আছে! বাচ্চারা আঙুল তুলে চিৎকার করে মানুষটাকে দেখায়।
বড়রা উঠোনে নেমে আসে। মানুষটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
এ কেমন ছেলেধরা গো, পালাচ্ছে না যে, পাথরের মতো কেমন ঠায় বসে আছে দেখ! মারগুঁতো খেয়ে মরার ভয় নেই নাকি? বৃদ্ধ দয়াল রুইদাস বলল। তারপর দয়াল রুইদাস কী ভেবে উঠোনের এক কোণে পড়ে থাকা একটা গরাণ কাঠের টুকরো হাতে তুলে নিল।
ওই দেখে আরও কয়েকজন হাতের কাছে যে যা পায় তাই তুলে নিয়ে হাতের অস্ত্র করে নেয়। তাদের ভাবটা এমন, মেরে মানুষটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে না দিয়েছে!দয়াল সবার আগে চলে।
মানুষটার খুব কাছে এসে দাঁড়ায় দয়াল। আঁশলাগা চোখে সে মানুষটাকে আবছা ছায়ার মতো দেখে।
এই মানুষ, কী মতলবে এসেছ এখানে? বাড়িঘর কোথায় তোমার? ছেলেধরা নাকি? ওই ঝোলায় কী? কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে দয়াল।
মানুষটা দয়ালের এতসব প্রশ্নের কোনও উত্তর করে না। সে শুধু মিটিমিটি হাসে, যেন ভারি এক মজা উপভোগ করছে। খিদে তেষ্টা বেমালুম ভুলে গেছে।
মানুষটার এই বেয়াক্কেলে ব্যবহারে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দয়াল। এই রুইদাসদের মাথা হয়ে তার একটা দায়দায়িত্ব রয়েছে যেকোনও বিপদআপদ থেকে এদের রক্ষা করার। এদের যেকোনও সমস্যা সমাধানে বা কাজকর্মে দয়ালের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। মানুষটা সবার মান্যি। তাকে অমান্য করার মতো মনের জোর বা যুক্তিগ্রাহ্য বুদ্ধি চেতনা এদের মধ্যে কারোর নেই। তাছাড়া তার পরিবারই সবচেয়ে সচ্ছল, ফলে তারজন্যও বাড়তি মান্যতা পায় দয়াল রুইদাস, তার পরিবারও।বসতির সবচেয়ে বড় ঘরটাও তারই।চৌচালা, দাওয়া দেয়াল মাটির হলেও ঝকঝকে তকতকে। তার চার ছেলে, সবাই স্বাস্থ্যবান। খাটিয়ে খুব।যার জন্য রোজগারও ভাল।
এই মানুষ, খালি হাসছ কেন? কী জিজ্ঞেস করলাল তোমাকে? উত্তর নেই কেন? পাগল নাকি? না বোবা? দয়াল ক্ষুব্ধ হয়ে আরেক প্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে।
চোয়ালের গোড়া পর্যন্ত প্রসারিত করে মানুষটা সবচেয়ে বড় হাসিটা হাসতে থাকে। সে হাসিতে শব্দ নেই, আছে শুধু মজা লোটার ইঙ্গিত। মিশকালো দাঁতের বিটকেল হাসি দেখে সবার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। তার উপর অপরিষ্কার, এলোমেলো চুলদাড়িগোঁফের ফাঁকে এত দীর্ঘ হাসি! দেখে মনে ভয়ও জাগে সবার । মানুষটার গলায় কন্ঠিগাছা, সারা শরীরে তিলকের ছাপছোপ। সত্যিই কোনও মন্ত্রসিদ্ধ সাধু নয়তো! বাচ্চারা ভয় পেয়ে ছেলেধরা, ছেলেধরা বলে হৈচৈ করে উঠলেই কি একটা মানুষ ছেলেধরা হয়ে যায়!
কী মনে করে দয়াল সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মানুষটার কাঁধের ঝোলাটার দিকে তাকায়। এটুকু একটা ঝোলায় ছয় মাসের বুকের শিশুরও জায়গা হবে না। হাতে পায়ে ডাগর ছেলে তো দূরের কথা। তবে কি মানুষটা ছেলে ধরে গোপনে শহরে চালান করে? কিন্তু শহর কি এখান থেকে একটুখানি পথ! দীর্ঘ পথ হাঁটো, নদী পার হও, বাস ধরো, আবার নদী পার হও,তারপর ট্রেন বা বাসে চাপো, তবেই না শহর পৌঁছনো। এতটা সময় কি ছেলেটা চিৎকার চেঁচামেচি না করে থাকতে পারে! তবে দয়াল শুনেছে, বাচ্চাদের বোধবুদ্ধি বিলোপ করে দেওয়ার মন্ত্রটন্ত্রও নাকি এরা জানে। মন্ত্র পড়া রঙিন ফুল দেখিয়ে শুধু ছোটদের নয় বড়দের পর্যন্ত সারা পৃথিবীময় পিছন পিছন ঘুরিয়ে মারতে পারে। যার উদ্দেশ্যে ফুল দেখানো সে তখন ওই মন্ত্রসিদ্ধ সাধু আর ওই ফুল ছাড়া বাকি পৃথিবী ভুলে যায়। মা বাবা, ভাই বোন, স্ত্রী সন্তান পরিজন, বিষয় আশয়, কামনা বাসনা ইত্যাদি সব জীবন থেকে বিসর্জন হয়ে যায়। সে তখন কারোর পিছুডাক শুনবে না, বাধা মানবে না। এমনকী কী উদ্দেশ্যে তার এসব ভুলে ওই লোক আর ফুলের পিছনে ছুটে মরা, তা সে কখনো ভেবে দেখে না। দেখার মনও হয় না। উদ্দেশ্যহীন, কারণহীন এক গভীর মোহের টানে খিদে, তেষ্টা, শরীরের যত্ন আত্তি, দিন রাত্রি সব, সব ভুলে যায়।
মানুষটার মুখে হাসিটা এখনও একইরকমভাবে লেপ্টে আছে দেখে দয়াল রুইদাসের মনটা কেমন সন্দেহপ্রবন হয়ে ওঠে। মানুষটার মতলবটা কী! একরকম হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, কী মানুষ তুমি এ্যাঁ, রা কাড়ছো না যে মোটে! ভেক ধরে এসে আমাদের অনিষ্ট করতে চাইছ নাকি? বল, নইলে মারব ডান্ডার বাড়ি।
দয়াল হাতের লাঠিটা মানুষটার মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। অথচ মানুষটা একইরকম নির্বিকার। হেসেই চলেছে।
পিছনের কৌতূহলী ভিড়টাও একরকম সমস্বরে বলে উঠল, কি গো, মারগুঁতো খেয়ে মরার ভয় নেই তোমার?
ছোকরা লুকাস বলল, এই ভরদুপুরে তোমাকে মেরে ওই নদীর চরায় যদি লাশটা পুঁতে দিই তাহলে অন্য মানুষ আর থানাপুলিশ তো দূরের কথা, কাকপক্ষিতেও টের পাবে না জেনে রেখো।
তার আগে তোমরা আমারে একটু জল খাওয়াও, ক্ষুধাও পাইছে খুব। ঘরে খাবারদাবার কিছু থাকলে দাও। শেষবারের মতো আশ মিটাইয়া খাইয়া লই। মানুষটা হাসতে হাসতেই দয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল ।
মানুষটার আস্পর্ধা দেখে ভিড়টা যেন চমকে উঠে পাথর হয়ে গেল। কারোর চোখের পাতা পড়ে না। হাতের মুঠিতে ধরা অস্ত্র আলগা হয়ে আসে। তাই দেখে মানুষটা শরীর কাঁপিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে।
কি দয়াল, আমাকে মারতে প্রথম ডান্ডার বাড়িটা তুমিই তো মারবা, নাকি? তোমারেই তো এগো হেড দেখতাছি।
অচেনা অজানা একটা মানুষের মুখ থেকে নিজের নাম শুনে দয়াল রুইদাস যেন হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ল। এ মানুষ তাকে চিনল কী করে! দয়াল করে বিস্ফারিত চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়েই থাকে। অন্যদেরও আর কোনও নড়চড় নেই, কথা নেই।
বুঝছি, চক্ষে তোমার ভাল রকমেই ছানি পড়ছে! আমারও কি মুখ আর শরীরের কাঠাম একরকম আছে? মাঝে কত্তগুলা বছ্ছর পার হইয়া গেছে না! মানুষটা ফের বলল।
দয়াল রুইদাস মানুষটাকে ফের চিনবার চেষ্টা করে। গলাটা এতক্ষণে খানিক চেনা চেনা লাগছে তার। স্মৃতি হাতড়ায় দয়াল। থৈ পেয়েও পায় না।
সময়ের সঙ্গে একটু একটু করে দাড়িগোঁফের আড়াল থেকে একটা চেনা মানুষের মুখমণ্ডল মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। মানুষটার নামও একসময় মনে করতে পারে।
আরে, আমাদের গোঁসাইবাবার ছেলে হরগোঁসাই না! হরগোঁসাই, আমাদের সেই গুরদেবের একমাত্র ছেলে, সে মানুষ এসেছে আমাদের কাছে!
দয়াল মানুষটার আরও কাছে এসে দাঁড়ায়। আরেকবার পরখ করে দেখে।
হ্যাঁ, হরগোঁসাই এসেছে দয়ালদের কাছে। বসতির মানুষগুলো কোথায় তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা জানিয়ে, আদর আপ্যায়ন করে ঘরে তুলবে, আনন্দে সকলে আত্মহারা হবে, তা নয়, উল্টে ভিড়টা যেন ভয়ের এক অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে দয়াল রুইদাস, সে যেন আসন্ন কোনও এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসের আশঙ্কায় মুহ্যমান। মানুষটার সামনে সে আর কঠিন, প্রত্যয়ী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মানুষটাকে চিনতে পেরে তার প্রাণশক্তি একেবারে লোপ পেয়েছে যেন। ওখানেই বসে পড়ে। কোমরের উপর থেকে শরীরটা বড্ড বেশি ভারি লাগছে। হাতের চেটো দিয়ে মাটিতে ভর করে দেহের ভার রক্ষা করে। মুখটা ঘুরিয়ে কাঁধের উপর এলিয়ে ফেলে রাখে। মুখে কথা নেই তার আর, শুধু বার বার গরম শ্বাস ফেলতে থাকে। ভাবে, সে কী করে আর এই গোঁসাইমানুষটার খিদে তেষ্টা মেটাবে!
একসময় মানুষটার মুখমণ্ডল রাগ ক্ষোভ অভিমানে থমথমে হয়ে ওঠে। বলল, আমার সঙ্গে তোমাদের এ কী দুর্ব্যবহার দয়াল, পাপ কইরা নরকে যাওয়ার ভয়ডর কি খুয়াইছ নাকি? আমার ক্ষুধা পাইছে, তিষ্টা পাইছে, কিন্তু তোমরা তার কোনও ব্যবস্থাই করতাছ না। এমনকী ঘরেও ডাকতাছ না। রৌদ্দে পুইড়া শুকনা কাঠ হইয়া গেলাম।
দয়াল কিছুতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, গুমরে ওঠা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।বলল,
আমাদের হাতের জল, খাদ্য আপনি কী করে খাবেন গোঁসাই, আমাদের এখানেই বা আপনাকে কী করে ঠাঁই দিই। আমরা যে সব জাত খুইয়েছি গোঁসাই। এখন প্রভু যীশু আমাদের আরাধ্য দেবতা। আপনার কাছে আমরা এখন ম্লেচ্ছ। বলতে বলতে দয়ালের কান্না প্রলম্বিত হতে থাকে।
সূর্যটা এখন মাঝ আকাশ ছাড়িয়ে কিছুটা পশ্চিমে ঢলেছে। ফলে মানুষগুলোর ছায়া গুটিয়ে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে প্রায়। তবুও ওরা সাবধানী হয়, নড়েচড়ে উঠে একটু পিছিয়ে আসে যাতে তাদের ছায়া কোনওরকমভাবে মানুষটাকে ছুঁতে না পারে। ঘৃণা আর ধিক্কারে মানুষটার মুখচোখ বেঁকেচুরে যায়। বলল, ছ্যা ছ্যা, দয়াল, এই দেশে আইসা শেষপয্যন্ত চোদ্দপুরুষরে নরকবাস করাইয়া ছাড়লা! এই পাপ কম্মের ক্ষমা আছে কোনও! মানুষটার দুচোখে আগুনের আভা। লাল হয়ে ওঠে। ক্রোধে সারা শরীর তিরতির করে কাঁপে। যেন তর্জনী উঁচিয়ে এক্ষুনি অভিসম্পাত দিতে শুরু করবে।
দেখে ভীত শঙ্কিত হয় দয়াল। সারা শরীরের রক্ত মুহূর্তে বুকের মধ্যে গুটিয়ে আসে। আর সবার মধ্যেও ভয়কাতর কথার গুঞ্জন ওঠে। যদিও এই বসতির মানুষগুলো এখন অন্য ধর্মাবলম্বী, আগের ধর্মাচার সবই তাদের মধ্যে থেকে একেবারে ধুয়েমুছে গেছে, এখন তারা প্রভু যীশুর প্রতি প্রার্থনা জানাতে, পাপ স্বীকার করতে গির্জায় যায়। অজানা অচেনা কোন সুদূর দেশের পবিত্র জর্ডন নদীর জল বুকে ছুঁইয়ে শরীরমনে শুদ্ধ হয়। প্রভুর ভোজের পবিত্র রুটিখন্ড মুখে নিয়ে পরম পিতার ভোজসভার অংশীদার হয়। কিন্তু তবুও, আজ যে তাদের ফেলে আসা ধর্মের গুরুদেব বড়গোঁসাইয়ের ছেলে হরগোঁসাই স্বয়ং তাদের বসতিতে এসে হাজির!
দয়াল রুইদাস এই বসতির মাথা। এদের হয়ে মানুষটাকে যা কিছু বলার তাকেই বলতে হবে। ধুতির কোণায় চোখ মোছে দয়াল। বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু হাল্কা করার চেষ্টা করে।
আমাদের ভুল বুঝবেন না গোঁসাই। এদেশে এসে বড় অভাবে পড়েছিলাম। না খেতে পেয়ে মরতে বসার উপক্রম হয়েছিল গোঁসাই। পেটকে বুঝ না দিলে প্রাণ যে বাঁচে না! বলতে বলতে দয়ালের গলা আটকে আসে। সারা শরীরজুড়ে এক হতচ্ছাড়া দশা ফুটে ওঠে।
তা দেখেও মানুষটার মন এতটুকু টাল খায় না। শাসনের কাঠিন্য চোখেমুখে। আগুন উগরানো স্থির দুচোখ।
তুমি অখন যতই অভাবের অজুহাত দাও, কামটা তুমি মোটেই ভাল কর নাই দয়াল। অভাব, রোগজারি, দুঃখকষ্ট পিথিবীতে কবে না ছিল! তাই বইলা ধম্ম খোয়াইতে হইব? অভাবে স্বভাব নষ্ট হয় জানি কিন্তু ধম্ম কেউ ত্যাগ করে! মানুষটার কন্ঠস্বরে ঘৃণা। যেন কতগুলো কুৎসিত কীট দেখছে দুচোখের সামনে।
দয়াল আর কোনও রা কাড়ে না। সে নিজেকে নিজে খুঁড়তে থাকে। সত্যিই কি সে পাপ করেছে! অতগুলো মানুষের ধর্মান্তরী হওয়ার সিদ্ধান্ত সেই তো নিয়েছিল। কী নিদারুণ অভাব অনটন, লাঞ্ছনা বঞ্চনা, অসহায়তার মধ্যে যে তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তা সে কী করে এই মানুষটাকে বোঝায় এখন! ফের একবার কেঁদে ওঠে অসহায় দয়াল। ভেজা চোখে দূরের পানে উদাস দৃষ্টি মেলে আকাশ, গাছপালা, পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে। আর মনে মনে ভাবে, ওদের কোনও ধর্ম নেই,তাই ধর্ম খোয়া যাওয়ারও আশঙ্কা নেই। শুধু মানুষের যত ধর্ম আর তা রক্ষা করার জন্য কতই না চেষ্টা। কিন্তু অভাবের এমনই মার যে তা নিয়েও টানাটানি হয়। নয়তো বাঁচার জন্য চুরি ডাকাতি করতে হয়। তা যদি করতে না পারে তাহলে ঘরের বউ, মেয়ে, বোনকে রাতের অন্ধকারে ঠেলে দিতে হয়। এত সাবধানে থেকেও রেহাই হয়নি দয়ালদের। কত বদ মানুষের নজর পড়ে তাদের মেয়েছেলেদের উপর। যোগেন রুইদাসের ছোটমেয়ে পুন্যি তো কার কথায় ভুলে হারিয়েই গেল। সে মেয়ের আজ পর্যন্ত কোনও খোঁজ নেই।
মানুষটার খিদে যেন এখন খোঁচা খাওয়া কেউটে। দেহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে চাইছে। তবুও এদের হাতের জল আর খাদ্য সে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারবে না। তাতে করে যে চোদ্দ পুরুষের নিশ্চিত নরকবাস হবে। এ সে কিছুতেই হতে দিতে পারে না।
সূর্যটা আরেকটু পশ্চিমে ঢলতে ঘরের ছায়া এসে মানুষটার শরীরের দখল নেয়। যে বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে দূরে সরে গিয়েছিল তারা এখন মানুষটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে মানুষটা সম্পর্কে অপার কৌতূহল। ওই দলে রুগ্ন প্যাকাটি চেহারার ছেলেটাও আছে। দুহাঁটুর উপর দুহাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। গলা থেকে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তির পদক ঝুলছে। মূর্তির মুখে নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও দয়া আর করুণার কী অপরূপ অভিব্যক্তি! সাধুসন্ন্যাসিদের মতো বড় বড় চুলদাড়ি, হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত। একটা হাঁটুর উপর আরেকটা হাঁটু চেপে বসেছে।
যীশু এদের আরাধ্য দেবতা! কেমন এক ঘোর লাগা নিষ্ঠুর চোখে ওটার দিকে তাকিয়েই থাকে মানুষটা। মনের মধ্যে এক বৈরীভাব জাগে, সারা শরীরের পেশিগুলো টানটান হয়ে উঠতে থাকে। এই কয় ঘর রুইদাসরা ছিল তার বাপ নদেরচাঁদ গোঁসাইয়ের শিষ্য। নদেরচাঁদ থাকতে যে ভক্তি শ্রদ্ধা, আদর আপ্যায়ন, গুরুদক্ষিণা ইত্যাদি পেত, তার অবর্তমানে সেসবের ভাগীদার তো ছেলে হয়ে সেই হয়। কিন্তু এই মানুষগুলো যদি জাত খুইয়েই বসে থাকে তাহলে সে কী করে বাঁচবে? এই অজানা দেশে কোথায় তার ঠাঁই হবে? কাদের নিয়ে সে তার পৈত্রিক গুরুগিরির পরম্পরা বজায় রাখবে। মানুষটা ভাবে। ভাবতেই থাকে শুধু।
গোঁসাই জল খাবেন না? আগে তেষ্টা মেটান।তারপর আপনার খাওয়াদাওয়া আর থাকার কী ব্যবস্থা করা যায় দেখি। দয়াল বলল।
তার কথায় সম্বিৎ ফিরে এল মানুষটার।
তোমাগ হাতের জল খাইয়া জাত খুয়ামু নাকি আমি?
না গোঁসাই, না, এই কথা মনে আসার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়! হাহাকার করে ওঠে দয়াল। বলল, ওই ভেড়ি ধরে আধা মাইল মতো দূরে জলের কল। আপনি যদি একটু কষ্ট করে গিয়ে তেষ্টা মিটিয়ে আসেন। আপনার সঙ্গে লুকাসকে দিচ্ছি। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে।
দয়াল লুকাসকে ডাকতে সে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। রোগাপাতলা চেহারা, লম্বা গড়ন, ঘোর তামাটে রঙ ছেলেটার। মাথার চুল উস্কখুস্ক। খালি পা, পরনে আধময়লা চেক পায়জামা। চোখেমুখে রুক্ষ প্রত্যয়ী ভাব।
লুকাস! এ আবার কেমন ধারার নাম দয়াল? রাম শ্যাম যদু মধু না, লুকাস! এ নিশ্চই তোমাগ খিষ্টান সাহেবের দেওয়া নাম। একরকম বিদ্রুপের গলায়ই বলল মানুষটা।
তারপর মানুষটা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। ঝোলার ভিতর থেকে একটা এ্যালুমিনিয়মের বাটি বার করে। এতে করেই জল খাবে মানুষটা। জল নিয়েও ফিরবে।
তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে মানুষটার। কাঁধে ঝোলা, হাতে বাটি মানুষটা যেন জল ভিক্ষা করতে চলেছে। কোত্থেকে এক দামাল হাওয়া উঠোনে ঢুকে পড়ে আর বেরোবার পথ না পেয়ে পাক খেতে খেতে হাঁপিয়ে মরে। কাছেপিঠের কোনও এক গাছে বসে একটা কোকিল ডেকে ওঠে, কুহু, কুহু।কোকিলটার ডাককে অনুকরণ করে হঠাৎই এক সুরেলা মেয়েলি কন্ঠ খুব কাছ থেকে ডেকে ওঠে। কোকিলটা যতবার ডেকে ওঠে ততবার মেয়েটাও ডেকে ওঠে। যেন দুটো কোকিল নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করছে। মানুষটা দেখে, ভরাভারা শরীরের গড়ন, বছর সতের আঠারোর মেয়েটা ভারি চমৎকার দেখতে। গায়ের রঙ একটু চাপা হলে কী হয়, নাকচোখ বেশ টানাটানা, পাতলা ঠোঁট, হাসিতে মুক্তোর দানার ঝিলিক। পরনে হলুদ শাড়ি, কালো ব্লাউজ।
মেয়েটা কে দয়াল? মানুষটা আগ্রহী হয়।
ও আমার ছোটমেয়ে গোঁসাই। একে নিয়ে আর পারি না। বড় বেহায়া। একটু চুপ থেকে ফের বলল, যান গোঁসাই, আপনি আগে জল খেয়ে আসুন। মেয়ের উদ্দেশ্য ধমক দিয়ে বলল, এই পারু, চুপ কর বলছি,নইলে গলা টিপে শেষ করে ওই গাঙের জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসব!
দয়ালের কথা গ্রাহ্যই করে না পারু। উল্টে সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
পারুর এই ব্যবহারে মেয়েদের ভিড়ে গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু সে দয়ালের মেয়ে বলে কেউ তাকে দুকথা শোনাতে পারে না।
এই নিষ্ঠুর প্রকৃতি, অভাব অনটন, হতাশাভরা জীবনযাপনে এমন প্রাণখোলা উদার হাসি শুনে যেন একটু প্রাণের স্পন্দন পায় মানুষটা। একইসঙ্গে দয়ালের কথাগুলো কৌতূহলী করে তোলে তাকে।
ভেড়িপথের খটখটে ঢেলার ওপর দিয়ে দুটো প্রাণী আগুনের হল্কার মধ্যে নিজেদের ভাজা ভাজা করতে করতে এগিয়ে চলে। সামনে লুকাস, পিছনে বাটি হাতে মানুষটা।
কোকিলটা এখনও ডেকে চলেছে। মনে হয়, ওরও বড় তৃষ্ণা!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।