গল্পতে অর্পিতা বোস

জলের আয়না


আকাশ জুড়ে চাঁদ। নীচের পুকুরের জলে সে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। স্পষ্ট না দেখতে পেলেও এত বছরের অনুভূতি দিয়ে সবটাই স্পষ্ট। আগামীকাল দোল। একটা সময় এবাড়িতে আজকের দিনে ছিল উৎসবের সূচনা। স্মৃতিরা যেন ভেসে ওঠে।


আসাদুল আর শিশিররা সেই ছোট্ট থেকেই বন্ধু। একসাথে স্কুলে যাওয়া। তখন গ্রামের ছবি অন্যরকম। ধর্মের বেড়াহীন গ্রামে সবাই প্রতিবেশী। ঈদ আর দুর্গাপুজোয় সবাই অংশগ্রহণ করে। শিশিররা পড়ন্ত জমিদার আর আসাদুলের আব্বার তখন সুদের কারবারের বেশ ভালো অবস্থা। তবে শিশির আর আসাদুলের বন্ধুত্বে এসবের কোনো ছোঁয়া ছিল না। শিশিরদের বাড়িতে ছিল রাধাগোবিন্দর মন্দির। এই দোল পূর্ণিমার আগের রাতে মন্দিরের সামনের বাগানে হতো ন‍্যাড়া পোড়া। শিশির, আসাদুল আর পাড়ার সব ছেলেরা মিলে বুড়ির ঘর বানাতো হাতে হাত লাগিয়ে। পাড়ার সব লোক এসে জড়ো হতো। মন্দিরের পুজোর পর পূজারী এসে প্রথম আগুন ছোঁয়াতেন। তারপর শিশিরের বাবা। এরপর জ্বলতে শুরু করত বুড়ির ঘর। শিশিরের বাবা বলতেন এক কোনো হোলিকা রাক্ষসীর গল্প। আসাদুল, শিশির আর বন্ধুরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে গাইত,
“আজ আমাদের ন‍্যাড়া পোড়া,কাল আমাদের দোল…”
সেই গানের মাঝে গনগনে আগুন আকাশ ছুঁতে উঠত। আর সে আগুনের আলো ঠিকরে পড়ত স্বপ্নার গালে। শিশিরের বোন স্বপ্না। রাতে স্বপ্ন দেখত আসাদুল চাঁদের আলো আর আগুনের তেজের ঝলকানিতে স্বপ্না যেন হুরপরী হয়ে ভেসে বেড়ায়। পরদিন গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই রঙে খেলায় রঙিন হতো। আসাদুলের খুব ইচ্ছে হতো স্বপ্নার গালে রঙ মাখায়। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারতনা।
এমন রঙিন দিনগুলো হঠাৎই বদলে গেল। একটা গোটা দেশ হঠাৎই রাজনৈতিক চালে ভেঙে গেল। উৎসবগুলোও ধর্মের শেকলে বাঁধা পড়ল। যদিও গ্রামে দাঙ্গার আগুন জ্বলেনি কিন্তু দেশের দাঙ্গার খবরে হিন্দুরা পরিবারের প্রাণ বাঁচাতে শিকড়ের টান ছিঁড়তে শুরু করল। একদিন এমন বসন্তেই শিশির জানালো সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে যাবে চৈত্রের আগেই । আসাদুলের আব্বা ওদের বাড়িটা কিনে নেবে। সে বছর দোল এল বটে কিন্তু ন‍্যাড়াপোড়া হলোনা। কিন্তু স্বপ্নার গালে আবীর ছুঁয়েছিল আসাদুল। সবার চোখ এড়িয়ে মন্দিরের পিছনে সেদিন আসাদুলের হাতে আবীর মেখেছিল স্বপ্না। ছলছলে চোখে বলেছিল,
— আর দ‍্যাখা হইবনা?
— হইব। কোনহোদিন হইব। বেবাক ঠিক হইলে তোমারে ইহানে লইয়া আমু।
মিথ‍্যে হলেও দুজনেই যেন আবার একদিন একসাথে হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল।


— নানাজান!
ফিরোজের গলায় পিছনে ফেরে আসাদুল। হাতে পাঠকাঠি নিয়ে তাড়া লাগায় ফিরোজ।
— আইয়েন তড়ায়। দেরি হইতাছে।
হাসিমুখে এগোয় আসাদুল। নাতি আর তার বন্ধুরা বুড়ির ঘর বানিয়েছে। আগুন জ্বলা পাটকাঠি ছোঁয়ায় আসাদুল। শিশিরদের এই বাড়িতে আজও প্রতি ফাগুন চতুর্দশীতে ন‍্যাড়া পোড়া হয়। সে আগুনের ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে গেলে আসাদুলের ছানিপড়া চোখে ভেসে ওঠে এক হুরপরীর মুখ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।