সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৩১)
সালিশির রায়
কিস্তি – ৩১
রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে সেই শ্লোগান। সে রাতে তারা কেউ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। সেদিন পাড়ার লোকেদের ক্লান্ত হতে রাত অনেক গড়িয়ে গিয়েছিল। আর ততক্ষণ নিজের বাড়িতেই চোরের মতো চুপিসাড়ে বসে থাকতে হচ্ছিল তাদের। কয়েকটা দিনের মধ্যেই গ্রামের পরিস্থিতিটা কেমন ঘোরালো হয়ে পড়ে। তাদের পক্ষে গ্রামে বাস করাটাই দায় হয়ে ওঠে।নানা ভাবে তাদের উপরে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা শুরু হয়ে যায়।কানাঘুষোয় নানা কথা শুনতে পায় অঞ্জলি।তাকে শোনানোর জন্যই বলা হয় ওইসব কথা। এই তো সেদিন জল আনতে গিয়ে কলতলায় শুনতে পেল পাড়ার মেয়েরা বলাবলি করছে যাদের বাড়ির পাট্টার কাগজ নেই তাদের এবার বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। সুহাসবাবুরা সেই জায়গা দখল করে ,দলের লোকেদের দেবে।কথাটা যে তাকে শোনানোর জন্যই বলা তা বুঝতে বাকি থাকে না তার। পাড়ায় বাড়ির পাট্টার কাগজ অনেকেরই নেই। কিন্তু তারা তো সবাই সুহাসবাবুর দলের লোক। বাবাই কেবল মাথা নোয়ায় নি।তাই কোঁপটা যে বাবার ঘাড়েই পড়বে তা তো ভালোই জানে সে।
এই পরিস্থিতির জন্য সে মনে মনে রামবাবুদেরই দায়ি করে। কতবার বাবা পাট্টার কাগজের জন্য রামবাবুকে বলেছে। আর রামবাবু শুধু বলেছেন, হবে হবে, অত ব্যস্ততা কিসের ? আমরা যতদিন আছি ততদিন কিছু হবে না। বাস করোই না যতদিন পারো। তারপরই অন্য কথায় পাস কাটিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এবার কি হবে তাদের, তা কি রামবাবুরা উপলব্ধি করতে পারবেন ? সেদিন অরুণস্যারের বাড়িতে এমনই কথা শুনেছিল সে। বোলপুরের স্যারের সঙ্গে ওই ধরণের কথাই আলোচনা করছিলেন অরুণবাবু। বহু জায়গায় রামবাবুরা নাকি গায়ের জোরে জায়গা দখল করে তাদের মতো লোকেদের বিলি করে দিয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর তাদের নামে ওইসব জায়গার কোন কাগজ করে দিতে পারে নি। কোথাও কোথাও কাগজ করে দিলেও তার কোন মূল্যই নেই। সরকারি নথিতে ওই কাগজের কোন উল্লেখই নেই। কর্মী-সমর্থকদের মন বোঝাতে সরকারি আধিকারিকদের সই আর স্ট্যাম্প জাল করে ওইসব কাগজ তৈরি হয়েছিল। রামবাবুরা ভেবেছিলেন অনন্তকাল তারাই ক্ষমতায় থেকে যাবেন। তাই তাদের বুজরুকিটাও কেউ ধরতে পারবে না, ধামাচাপাই থেকে যাবে।
কিন্তু ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সব প্রকাশ্যে চলে আসে। ওইসব জায়গার মালিকেরা তাদের সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য সুহাসবাবুদের দলে নাম লিখিয়েছে। বেহাত হয়ে যাওয়া জায়গা ফেরত পাওয়ার জন্য সুহাসবাবুদের সঙ্গে একটা রফাও করে নিয়েছেন তারা। বেদখল হয়ে যাওয়া জায়গা আধাআধি বখরাতে সুহাসবাবুরা নাকি উদ্ধার করার ঠিকে নিয়েছেন।এখন যদি তাদের কাছে এসে সুহাসবাবুরা কাগজ দেখতে চায় , তাহলে কি বলবে তারা ? এখন তো আর শুধু সেই জায়গাই নয় , তিল তিল করে গড়া ঘর বাড়ি সহ সমস্ত কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে তাদের। কিন্তু কোথাই যাবে তারা ? কে দেবে তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর কষ্টের টাকায় গড়া বাড়ি হারানোর ক্ষতিপূরণ ? আসলে সস্তায় বাজিমাতের রাজনীতি করতে গিয়ে রামবাবুরা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে খেলা করছেন। আর ভাবতে পারে না অঞ্জলি।কিন্তু বাবার কথা শুনে তার ভাবনা আরও বেড়ে যায়। অন্যদিনের মতোই সেদিন সকালেও কাজে বেড়িয়েছিল বাবা। কিন্তু দুপুরের অনেক আগে ফিরে আসে।
এ সময় তো বাবার ফেরার কথা নয়। শরীর খারাপ – টারাপ কিছু হলো না তো ? সে উদ্বিগ্ন হয়ে বাবার কাছে এগিয়ে যায়। বাবার চোখে – মুখে তখন হতাশা আর ক্লান্তির ছাপ। সে জলে গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। একটু স্থিতু হয়ে বাবা যা বলে তাতে দুচিন্তা বেড়ে যায় তার।জ্ঞান হওয়া থেকেই অঞ্জলি দেখে আসছে বাবা-মা পরাণকাকাদের বাড়িতেই ঠিকে মুনিশের কাজ করেছে। ধান পোঁতা কিম্বা কাটার মরসুমে যখন মজুরের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে মজুরী বাড়ে তখনও বাবা-মা’কে সেই সারা বছরের বাঁধা মজুরীতেই কাজ করতে হয়েছে। ঘটনা এমনও ঘটেছে, নিজেদের কাজ না থাকলেও বাবা- মা ‘ কে অন্যের কাছে ভাড়া পর্যন্ত খাটিয়েছেন পরানকাকুরা। অন্যের কাছে থেকে অনেক বেশি মজুরী আদায় করেছেন। কিন্তু বাবা-মা’কে দিয়েছেন সেই বাঁধা মজুরী। আসলে বাবা-মা’র শ্রম নিয়েও ব্যবসা করেছেন ওরা। বিনিময়ে বাবাকে কিষাণি ভাগে যৎসামান্য জমি চাষ করতে দিয়েছেন। তাও ছিল বাবা- মা’কে আটকে রাখার একটা ছল মাত্র। ওদের নানা কায়দাবাজির জন্য অধিকাংশ বছরই বাবা নিজের ভাগে তেমন কিছু পেত না বললেই চলে। মাঝখান থেকে চাষ করার জন্য নেওয়া খাদের ধানের ঋণ ঘাড়ে চেপেই থাকত।
যখন কাজে জবাব দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখনই খাতের ধান শোধ করার জন্য চাপ দিয়েছে পরাণকাকুরা। তাই বছরের পর বছর ক্রীতদাসের মতো আধা মজুরিতেই ডবল পরিশ্রম করতে হয়েছে বাবা – মা’কে। সেই পরাণকাকুই সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বাবাকে নাকি আর কাজে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কেন সম্ভব নয় তা অবশ্য ভেঙে কিছু বলেন নি। তবে পিছন থেকে কলকাঠিটা যে সুহাসবাবুরাই নাড়ছেন তা ভালোই বুঝতে পারে অঞ্জলি।কারণ সেদিন শুধু পরাণকাকার কাছেই নয় , তারপর বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন জমিমালিকের কাছে একই কথা শুনে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে বাবাকে। ওই পরিস্থিতিতে বাবাকে দেখে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল।একটা মানুষর আর কত চাপ নিতে পারে।একে তো ওই অবস্থা ,তার উপরে বাড়ি নিয়ে ও শুরু হয়েছে দুঃচিন্তা।এরই মাঝে একদিন হোপনকাকা এসে বলে গিয়েছে , সনাতনের কাছে বাড়ির কাগজপত্র জমা দিতে হবে। নাহলে একমাসের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। হোপনকাকার মুখে কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় অঞ্জলি।
মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়। এই হোপনকাকাই একদিন তাদের বাড়িতে বসে সনাতনের সাতগুষ্টি উদ্ধার করেছে। ফন্দিফিকির বের করে ওকে শায়েস্তা করার জন্য ঝুলোঝুলি করেছে। বাবা নানা অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছেন। সেই হোপনকাকা আজ কত সহজেই সনাতনের কথা শুনে তাদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে দিয়ে গেল।হোপনকাকা চলে যাওয়ার পরই বাবা নিজের মনেই বলে ওঠে, আর এখানে থাকতে দেবে না দেখছি। বাবার কন্ঠস্বরেই অঞ্জলি বিষাদের আভাস পায়। বাবার কাছটিতে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। পরম মমতায় বাবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে , তাহলে এখন কি করবে বাবা ?
—- ভাবছি বর্ধমান চলে যাব। পরাণমোড়লের বাড়িতে ঠিকে মুনিশের কাজে লাগার আগে তো খাটতে যেতাম।অনেকে আমার কাজ পচ্ছন্দ করত। বরাবর থেকে যেত বলত। দেখি তাদেরকেই কাউকে গিয়ে ধরব। তারপর একটা ব্যবস্থা হলেই তোদেরকে নিয়ে চলে যাবে। ততদিন তোরা একটু চালিয়ে নিতে পারবি না ?
বাবার কথা শুনে খুব দমে যায় অঞ্জলি। মায়ের ওই অবস্থা, গাঁয়ের এই পরিস্থিতি, মাথার উপরে একজন পুরুষ মানুষ না থাকলে সে একা সবদিক সামাল দেবে কি করে ভেবে পায় না। তাই চট করে বাবার কথার কিছু জবাবও দিতে পারে না।পরক্ষণেই ভাবে , এছাড়া উপায়ও তো কিছু নেই। বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে মেরে কেটে দিন দশেক চলতে পারে। তারপর কাজ না জুটলে তো সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। তার উপরে রয়েছে বাড়ি ছাড়ার দুঃশ্চিন্তাও। প্রয়োজনে সে নিজেও পড়া ছেড়ে কাজ করতে শুরু করতে পারে। কিন্তু তাকেই যে কাজ দেবে তারও নিশ্চয়তা কোথাই ? আর বাবাকে না দিয়ে যারা তাকে কাজ দেবে তাদের মতলব খুব সুবিধার হবে বলে মনে হয় না তার।কথাটা পাড়তেই বাবাও সেই একই কথা বলে। তার দোটানা ভাব দেখে বাবা বলে , দিন সাতেক কোন রকমে কাটাতে পারবি না ? তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে।অগত্যা মত দিতে হয় অঞ্জলিকে।