সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৫)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৫

ছোটভাইটা কেবল বাবার হাত ধরে টানছে আর সমানে বলে চলেছে–“অ বাবা বাড়ি চ না”।সে বলেই চলে,” বাবা পান্তা খাবি না ? খুব খিদে লেগেছে। বাবা বাড়ি চ না”।প্রতিদিন এইসময় বাবার সঙ্গেই পান্তা ভাত খায় সে। কি করে বুঝবে সে , আর পাঁচটা দিনের মতো নয় আজকের দিনটা। বোঝার কথা ও নয়, অবোধ বালক কি করে বুঝবে ইচ্ছে থাকলেও বাবার যে বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। তার বাবা সালিশির রায়ে বাঁধা পড়ে আছে।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় দিদির হাত ধরে বাড়ির দিকে ছুট লাগায় অঞ্জলি। দরজা খুলে আঙুল উঁচিয়ে চালের বাতার দিকে দিদির দৃষ্টি ফেরায়। চালের বাতা থেকে ঝুলছে দু-বোনের দুটো মাছ আর ভাইয়ের একটা খরগোশ।
ফুল্লরাতলায় মেলা দেখতে গিয়ে প্রায় প্রতিবছর ওইরকম মাছ,খরগোশ, আম, আপেলের মতো লক্ষ্মীর ভাঁড় কিনে আনে তারা। মাঠে মাঠে ঝড়েপড়া ধানের শীষ, গমের শীষ কুড়িয়ে দোকানে বিক্রি করে সেই পয়সা তারা জমায় ওই ভাঁড়ে। মেলার আগে ভেঙে কিছু একটা পচ্ছন্দের জিনিস কেনে আর পরের বছরের জন্য নতুন ভাঁড় কেনে। তাই ভাড়গুলো ভাঙতে কেমন যেন মায়া হয় ওদের। কিন্তু বাবার করুণ মুখটার কথা মনে পড়তেই সব ভুলে যায় তারা। তিনটে ভাঁড়কেই দড়ি ছিঁড়ে নামায় অঞ্জলি। জানে ভাই ভাঁড় দেখতে না পেলে কেঁদে ভাসাবে। কিন্তু বাবাকে উদ্ধার করার জন্য এছাড়া তো আর কোন উপায় জানা নেই তাদের।
কিন্তু ভাঁড় তিনটে ভেঙেও মুখ কালো হয়ে যায় দু’বোনের। গুনে দেখা যায় সব মিলিয়ে ৮২ টাকা হয়েছে। তখন দিদি হাড়ির ভিতরে থেকে বের করে নিয়ে আসে তার বিয়ের জন্য কিনে রাখা রূপোর তাগা-নুপুর আর হার। সেসব নিয়ে তারা ছুটে যায় মোড়লের বাড়ি। দুই বোনকে উদভ্রান্তের মতো ফিরতে দেখে কালিরামকাকা বলেন — টাকা যোগাড় হলো না তো ? জানতাম হবেনা। কি করবি তাহলে এখন ? তখন তারা টাকা আর রূপোর গয়নাগুলো কালিরামের হাতে তুলে দিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বলে , কাকা আর আমাদের বাড়িতে কিছু নেই। আমার বাবা তো কারও কোন ক্ষতি করে নি।তবু সালিশি সভা জরিমানা করেছে। কিন্তু এখন আমরা অত টাকা কোথাই পাই বলো ?
শুনে কালিরাম কাকা নির্দয়ের মতো বলে, এতে আর কত হবে ? তাহলে বরং তোদের শুয়োর চারটেই দিয়ে দে। আমি বরং জরিমানার টাকাটা দিয়ে দিচ্ছি। আর আজকে পুজোর পর তোরাও চাট্টি খেতে পাবি আমার বাড়িতে। শুয়োরের কথা শুনে চমকে ওঠে বাবা। ফের হাত জোড়জোড় করে বলে, ওটা কোর না ভাই। বাদনা পরবের পরেই ছেলে আর বড় মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।শুয়োর চারটে বিক্রি করে বিয়ের খরচের টাকা যোগাড়ের জন্য দুবছর ধরে পেলে রেখেছি।তুমিও তো ভাই ছেলে-মেয়ের বাবা। আমার কথাটা একটু বিবেচনা করো। কিছুদিন সময় দাও।তোমাদের জরিমানার টাকা আমি ঠিক মিটিয়ে দেব।
কিন্তু কে শোনে কার কথা ? মোড়ল পরিষদের লোকেরা ততক্ষণে তাদের হুদরো থেকে শুয়োরচারটে নিয়ে এসে কালিরামের হুদরোতে ঢুকিয়ে দেয়। আর তা দেখে ক্ষোভে হতাশায় ভেঙেপড়ে বাবা। কালিরামকে বাবা বলে — কাজটা কি তোমরা ভালো করলে ভাই ? ১০০০ টাকা জরিমানা আদায় করতে তোমরা আমার তিন হাজার টাকার শুয়োর , ছেলেমেয়েদের জমানো টাকা, গয়না নিয়ে নিলে। ধর্মে সইবে তো ?
বাবার কথা শুনেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে কালিরাম -আরে যা যা , তুই আর ধর্ম দেখাস নে। কে চেয়েছে তোর শুয়োর ? জরিমানার টাকা দিতে পারছিস না বলেই না আমি দয়া করে শুয়োর নিয়ে তোকে উদ্ধার করে দিলাম।
তারপর আর কেউ বাবার দিকে ফিরেও চায় না।জরিমানা আদায়ের জন্য যারা প্রবল উৎসাহে বাবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ছিল তারা বাঁধন খুলে দেওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। মারাংবুরুর পুজো আর ফুর্তির ব্যবস্থা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা দু’বোন বাঁধন খুলে বাবাকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে আসে। বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার গলা থেকে ঝড়ে পড়ে আক্ষেপ — শেষ পর্যন্ত মলিন্দ-দুরো পর্যন্ত আমার সঙ্গে এমন করল ? ওরা ও আমার বাড়ি থেকে শুয়োর বার করে নিয়ে গেল ? একবারও ভাবল না আমার ছেলেমেয়ের বিয়ের কথা ? তারাদু’বোন বাবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্ত্বনা দিতে থাকে। দিদি বলে , তুমি অত ভাবছ কেন বাবা ? এবার বিয়ে নাই বা হোল। আমরা কি বুড়িয়ে গিয়েছি নাকি ? আবার আমারা শুয়োর পালব।
—- কিন্তু আবার যদি ওরা কোন অজুহাত খাড়া করে জরিমানা করে ? বাবার এই প্রশ্নের মুখে চুপ করে যায় দু’বোন। কারণ সে আশঙ্কা ষোলআনাই রয়েছে।আদিবাসী সমাজের রীতিই হচ্ছে কাউকে একবার বাগে পেলে তার পিছনেই বারে বারে লাগা।তাই বাবার প্রশ্নের কোন জবাব দিতে না পেরে অস্বস্তিতে পড়ে তারা। তাদের অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচায় দাদা। সেই সময় খবর পেয়ে বাড়িতে ফেরে দাদা। কাজ কামাই হয়ে যাবে বলে পরানকাকু দাদার বিষয়ে দাদাকে নাকি কিছু বলে নি। গ্রামের অন্য লোকেদের মুখে খবর পেয়েই সোজা মাঠ থেকে চলে এসেছে দাদা। দাদা ফিরতেই বাবাকে শ্মশানে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগায় মা। দাদার উদ্দেশ্যে বলে, যা তো বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাড়গোড় কুড়িয়ে ভালো করে গর্ত খুঁড়ে পুতে দিয়ে আয়। নাহলে বলা তো যায় না , আবার জরিমানা করে বসবে। অগ্যতা ক্লান্ত অভুক্ত বাবাকে ফের দাদাকে সঙ্গে নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যেতে হয়।
ঠাকুমার হাড় মাংস কুড়িয়ে পুঁতে দিয়ে তাদের ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়ে যায়। বাড়ি ফিরেই কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা। কান্নার দমকে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। দীর্ঘক্ষণ পেটে খাবার পড়ে নি, তার উপরে ওই ধকল বাবাকে কাহিল করে ফেলে। দু”বোন ছুটে গিয়ে বাবার বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। আর তাদের জড়িয়ে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা। বাবর গলায় ঝড়ে পড়ে তীব্র অনুতাপ — “মা তুমি আমাকে ক্ষমা করো মা। আমি তোমার অধম ছেলে। তোমার সৎকারটুকুও ঠিক করে করতে পারিনি।তাই তো তোমাকে শিয়াল, কুকুরে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে। ছিন্ন -বিচ্ছিন্ন দেহ,চোখ, মুখ সব খুবলে খুবলে খেয়েছে পশুতে।সে যে চোখে দেখা যায় না।”
বাবার কথা শুনে তারাও সবাই ভেঙে পড়ে কান্নায়। কাঁদতে কাঁদতেই খিদে তৃষ্ণা ভুলে যায় সবাই। বাড়িতে খুদ কুঁড়োও নেই। খিদের জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ভাইটা অনেকক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ তাদেরই শুয়োরের মাংস আর জরিমানার টাকায় মদের আসরে মত্ত গোটা গ্রাম। তারাই কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নাগাড়ে কেঁদে চলেছে। তাদের সেই কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যায় মোড়লের বাড়ি থেকে ভেসে আসা মদ্যপ কিছু মানুষের অমানবিক উল্লাসে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।