সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৫০)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৫০

কেউ তা জানতেও পারে না। মনে মনে ভাবে তার তো কোন দোষ নেই , তাহলে তাকেই কেন প্রিয়জন , নিজের বাড়ি ছেড়ে হোমে পড়ে থাকতে হবে ? শুধু তাকে একাই নয় , এই হোমের সব মেয়েকেই তো বিনা অপরাধে একই ফল ভোগ করতে হচ্ছে। সেটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দেয় অঞ্জলি। আর তারপরই মনটাও অনেকটাই হালকা হয়ে যায়। সুখে দুখে দিনগুলো বেশ কেটে যায় অঞ্জলির। দেখতে দেখতে পুজোর ঢাক বেজে ওঠে। সেই ঢাকের আওয়াজ হোমের উঁচু প্রাচীর ভেদ করে এসে পৌঁছোয় অঞ্জলিদের কানেও। হোমের মেয়েদের মন খুব উদাস হয়ে যায়। অঞ্জলি শুনেছে , পুজোর কটা দিনও হোমের মেয়েদের চার দেওয়ালে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। সরকার নাকি হোমের মেয়েদের পুজো দেখার জন্য টাকা কাপড় দেয়। কিন্তু সেই টাকা খরচের ভয়ে শয়তানটা হোমের মেয়েদের একদিনের জন্যও পুজো দেখানোর গরজ দেখায় নি। এমন কি একটা করে নতুন শাড়িও তাদের দেয় নি। সব নিজে আত্মসাৎ করেছে।
তাই হোমের মেয়েদের বছরের পর বছর হোমের চার দেওয়ালের মধ্যে মনমরা হয়ে পুজো কেটেছে। এবার অঞ্জলি সাংবাদিকদের মাধ্যমে ডি,এম’র কাছে অন্তত একটা দিন হোমের মেয়েদের শুধুমাত্র ঠাকুর দেখানোর আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু কোথাই কি ?

                       দেখতে দেখতে ষষ্ঠী , সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পেরিয়ে গেল। ঠাকুর দেখার আশা ছেড়েই দেয় অঞ্জলি। নিজের জন্য নয় , তার কষ্ট হয় হোমের অন্য মেয়েদের কথা ভেবে। বড়ো মুখ করে সবাইকে বলেছিল - দেখো ডি, এম সাহেব আমাদের কথা রাখবে। তাই তার খুব অভিমান হয় ডি, এমের উপরে। আসলে মুখে সবাই ওই রকম বড় বড় কথা বলে। তারপর যথারীতি সব ভুলে যায়। কোন কথা রাখতেই যখন পারবেন না, তাহলে সেদিন বড়ো মুখ করে বলার কি দরকার ছিল, যখন যা প্রয়োজন হবে আমাকে জানাবে। জানানোর এই তো ফল। মন খারাপ করে শুয়ে পড়ে অঞ্জলি। দুপুরে কিছু খায় না পর্যন্ত। সবাই খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করে , শ্রাবণী হাত ধরে টানাটানি পর্যন্ত করে।  সে সবাইকে শরীর খারাপ বলে এড়িয়ে যায়।একসময় খালি পেটেই ঘুমিয়ে পড়ে অঞ্জলি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রাবণীর ডাকে ঘুম ভাঙে তার। শ্রাবণীর ঠেলায় সে ধড়মড় করে উঠে বসে। আতংকিত গলায় বলে -- কি হলো রে ? এত ডাকাডাকি কেন ? 

ভীত গলায় শ্রাবণী বলে , সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে গো দিদি।
সর্বনাশের কথা শুনেই বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় অঞ্জলি। তারপর বলে, কার কি সর্বনাশ হলো আবার ? চল চল দেখি।
অঞ্জলির উদ্বেগ লক্ষ্য করে হো হো করে হেসে ওঠে শ্রাবণী। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলে , সর্বনাশটা হোল — —
—- কি হেয়ালি করছিস ? এই বলছিস সর্বনাশ, আবার হো হো করে হাসছিস। কি হয়েছে খুলে বলবি তো।
— সর্বনাশটা হল আজ আমরা সবাই ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি। ডি,এম সাহেব সবার জন্য নতুন জামা কাপড়, আর পুজো দেখার জন্য নগদ ১০০টাকা করে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
— ওরে বাপরে তাই বল, তুই তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়ে ছিলি। দাঁড়া তোকে দেখাছি মজা বলে চড় তুলে তেড়ে যায় শ্রাবণীকে।
— কেমন দিলাম বলো ? বলেই তাকে ভেংচি কেটে ছুটে অফিস ঘরের দিকে চলে যায় শ্রাবণী।

                      সেও কিছুক্ষণের মধ্যে চোখেমুখে একটু জল নিয়ে অফিস ঘরেই যায়। অফিস ঘরে তখন রীতিমতো খুশীর হাট। সবার মুখেই ঝিলিক দিচ্ছি স্বর্গীয় হাসি। দেখে কাপড়ের প্যাকেটগুলো নামানো রয়েছে টেবিলের উপর। পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া রয়েছে ১০০ টাকার নোটগুলোও।

সে যেতেই সবাই তাকে ছেঁকে ধরে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দেয়। ডি, এম অফিসের যে কর্মী ওগুলো দিয়ে গিয়েছে , তার কাছেই জানা যায় ডি,এম সাহেব নাকি জেলার বাইরে ছিলেন। এসে সবকিছু জানার পর দেরি হয়ে যাওয়ার পর খুব আফশোস করেছেন। তাড়াতাড়ি সব কিছু ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিকালে পুজো দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা মিনি বাস পাঠিয়ে দেবেন। সবাইকে তৈরি হয়ে থাকতে বলেছেন। তাকে দেখেই সবাই বলে ওঠে , আজ বহু বছর পর তোমার জন্যই আমরা মায়ের মুখ দেখতে পাবো। কি ভালো যে লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু খারাপও লাগছে জানো তো ?
—- কেন আবার খারাপ লাগার কি হলো ?
—- তুমি যেতে পারবে না বলে।
—- মানে ? আমি যেতে পারব না কে বলল ?
—- ওই তুমি বললে না তোমার শরীর খারাপ। খেতে পর্যন্ত পারলে না। দুর্বল শরীর নিয়ে তুমি ঠাকুর দেখতে যাবে কি করে ? তুমি বরং শুয়ে পড়ো গে যাও। আমরা ফিরে এসে তোমাকে ঠাকুর দেখার গল্প বলব ক্ষণ। তবু তো দুধের স্বাদ ঘোলে মিটবে।
অঞ্জলি বুঝতে পারে সবাই তাকে প্যাক দিচ্ছে। তাই সেও না বোঝার ভান করে বলে, হ্যা গো শরীরটা সত্যিই খুব খারাপ। আমি যেতে পারব না। তোমরা বরং দেখে এসো। তোমাদের কাছে ঠাকুর দেখার গল্প শুনলেই আমার মন ভরে যাবে।

                    বলেই সে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কয়েকজন এসে তার হাত ধরে বলে , আরে তুমি আমাদের মজাটুকুও ধরতে পারলে না ? তোমার কেন হঠাৎ করে অসুখ করে গেল , কেন তুমি খেলে না ,  তা আমরা বুঝতে পারি নি ভেবেছে ? আসলে ডি,এম সাহেব তোমার আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় আমাদের এবারও পুজো দেখা হবে না ভেবেই মন খারাপ করে তুমি অসুখের অজুহাত দেখিয়ে খাও নি। আর সেই আমরা তোমাকে ফেলে ঠাকুর দেখতে চলে যাব তুমি ভাবলে কি করে ? তাতে না হয় এবারও হবে না আমাদের ঠাকুর দেখা।

— না , ঠিক তা নয়।
—- নাও, নাও তোমাকে আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না। টাকাগুলো তুমিই তুলে রাখো। বাইরে যার যা লাগবে কিনে দেবে। আর শাড়ি একটা করে নিলেই হলো। সবগুলোর রঙই তো এক।
— বা রে টাকা গুলো সাবিত্রীদিই রাখুন। পুজো দেখতে গিয়ে যা কিছু কেনা কাটা হবে তার দাম উনিই এক সঙ্গে মিটিয়ে দেবেন। তারপর যদি কিছু বাঁচে তাহলে তা দিয়ে আমরা একদিন একটা পিকনিকের মত করব।
— সবাই বলে দারুণ আইডিয়া।টাকা গুলো সাবিত্রীদির হাতে তুলে দেওয়া হয়। কয়েনদিনেই সাবিত্রীদির মধ্যেও কেমন একটা প্রানবন্ত ভাব চলে এসেছে। সব কাজেই এখন ডেকে হেকে একাকার করে দেন। সেই অভ্যাস থেকেই বলে ওঠে , নে নে আর বসে থাকলে হবে ? তাড়াতাড়ি কর সব।

                                 মুহুর্তের মধ্যেই সাজো সাজো রব পড়ে যায়। শাড়ির  প্যাকেট নিয়ে যে যার ঘরে চলে যায়। যার কাছে যা সাজার জিনিস ছিল তাই দিয়েই সবাই মিলে হালকা প্রসাধনও সেরে নেয় সবাই। সন্ধ্যের আগেই সবাই একে বারে ফিটফাট। যৎসামান্য প্রসাধনেই সবার মধ্যেই একটা অন্যরকম শ্রী ফুটে বেরোচ্ছিল। সন্ধ্যের মুখেই এসে পৌঁছোয় প্রশাসনের মিনি বাস। সবাই একে একে গিয়ে বসে সেই বাসে। বাসে যেতে যেতেই অঞ্জলি দেখে শহরের পথে ধামসা- মাদলের তালে তালে দাসাই নেচে বেড়াচ্ছে আদিবাসী নারী পুরুষের দল। অঞ্জলির মনে পড়ে যায় তারাও একসময় গ্রামে গ্রামে বাবুদের বাড়িতে দাসাই নেচে মুড়ি-মুড়কি আর নাড়ু নিয়ে আসত। তারপর তা ভাগ করে খেত। সেইসব কথা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে একটা কষ্ট যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ঠাকুর দেখা শুরু হতেই অবশ্য কষ্টটা কমে আসে। প্যান্ডেলে প্যাণ্ডেল ঠাকুর দেখে, ফুচকা এগরোল আর মোগলাই পরোটা খেয়ে হোমে ফিরতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে যায়। সে রাতে আর কেউ কিছু খেতে পারে না। এক ফাঁকে সাবিত্রীদি জানিয়ে দেন , খরচখরচা বাদ দিয়ে এখনও দেড় হাজার টাকা বেঁচে আছে।

শুনেই সবাই হই হই করে ওঠে — পিকনিক হবে তাহলে।
সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা উৎফুল্ল ভাব। শুয়ে শুয়ে ঠাকুর দেখার গল্প করতে করতে একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে অঞ্জলি ভাবে , এই মেয়েগুলো কত অল্পে সন্তুষ্ট। একটা সস্তার কাপড় , একটা মোগলাই কি এগরোল , আর গোটা কয় ঠাকুর দেখা। ব্যস তাতেই যেন হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার আনন্দ। অথচ ঠাকুর এইসব মেয়েগুলোকেই শুধু কষ্ট দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। একটা কষ্টের অধ্যায় শেষ হতে না হতেই ঠেলে দেন আর এক অধ্যায়ে। সে নিজেই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

                                কয়েক দিনের ব্যবধানে তাকে দুবার কোর্টে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রথম দিন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দী দিতে হয়েছিল তাকে। সেদিন তেমন কোন সমস্যা না হলেও দ্বিতীয়দিন আবার যেন সব কিছু উলোট-পালট হয়ে যায় তার।

সেদিন ছিল অভিযুক্তদের সনাক্তকরণের পর্ব। আরও কয়েকজনের সঙ্গে শয়তানগুলোর সামনে পুলিশ তাকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। শয়তানগুলোর মুখের দিকে চাইতেই বীভৎস সেই রাতটার কথা মনে পড়ে যায়। আর আচমকা তার কি যেন হয়ে যায়। একটার পর একটা শয়তানের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে থুতু ছুড়ে দিয়ে গালে চড় কসাতে থাকে। ওইভাবে শেষজনকে চিনিয়ে দেওয়ার পর প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। একজন মহিলা পুলিশকর্মী তাকে বাইরে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে কেমন যেন মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে অঞ্জলি। যখন ভালো থাকে তখন দিব্যি সবার সঙ্গেহাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে। আবার পরক্ষণে গুম মেরে যায়। তখন একা শুয়ে শুয়ে পিছনে ফেলে আসা দিনের কথা ভাবে আর চোখের জল ফেলে। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। হোমে খিঁচুড়ি, আলুভাজা আর ডিমভাজা হয়েছিল। সবাই খাওয়া দাওয়ার পর অফিস ঘরে টিভি দেখতে চলে যায়।

                                অঞ্জলি এসে শোয় নিজের বিছানায়। ফেলে আসা দিনের নানা স্মৃতি ঘিরে ধরে তাকে। মনে পড়ে যায় সেই সেদিনটার কথা। সেদিনও দুপুর থেকে এ রকম অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছিল। তখন লোকালয়ের বাইরে একটি স্কুলবাড়ি নির্মাণের কাজ চলছিল। হৃদয়দা আর সে ছাড়া সেদিন কেউ কাজে আসে নি। কোথাও কোন জনপ্রাণী নেই। তাদেরও কাজে মন লাগছিল না। মুখোমুখি বসে গল্প করছিল দুজনে। দুজনের চোখেই তখন প্রেমের আবেশ। হাতে হাতে রেখে একসময় হৃদয়দা তার ঠোঁটে নামিয়ে আনে নিজের ঠোঁট। আর সব আগল ভেঙে যায় অঞ্জলির। ঝমঝমে বৃষ্টিতে নির্জন সেই ঘরের ভিতরে তারাও উপুর চুপুর ভিজে যায়। অনাস্বাদিত এক সুখানুভূতির পাশাপাশি তীব্র লজ্জাবোধ জড়িয়ে ধরে তাকে। কিছুতেই সরাসরি সে হৃদয়দার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। মনের মানুষের হাতে যথাসর্বস্ব তুলে দিতে পেরে তার চোখে মুখে পরিতৃপ্তি ফুটে ওঠে। হৃদয়দাও  তার সব নিয়ে পরিতৃপ্ত হয়েছে তো ? কিন্তু লজ্জায় সেদিন তা দেখা হয়নি অঞ্জলির। দেখতে পারলে হয়তো তাকে আজকের কষ্টটা আর পেত হত না। কারণ সে দেখতে পেত পরিতৃপ্তি নয় , হৃদয়দার চোখে মুখে ফুটে ওঠে একটা অপরাধ বোধ। প্রকৃত ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষের কাছে সর্বস্ব নিলেও তো অপরাধ বোধে ভোগার কথা নয়।সেদিনের কথাটা মনে পড়তেই মানসিক যন্ত্রণাটা আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে তার। শয়তানগুলোর খাবলে খুবলে খাওয়ার ব্যাথার চেয়েও তাকে বেশি ব্যাথা দিয়েছিল হৃদয়দার আচরণ। সেই ব্যাথার প্রলেপ হয়ে আসে আলাপন ঘোষ।


ক্রমশ
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।