“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় অভিজিৎ চৌধুরী

বেলা নগর     

বেলানগর স্টেশনটা এখন কেমন হয়েছে জানি না , তখন বেশ নির্জন ছিল । হল্ট স্টেশনগুলির এক আশ্চর্য সৌন্দর্য থাকে । একটা চায়ের স্টল থাকে । সেখানে ঘুগনি , মাটির ভাঁড়ে চা আর আ-সেঁকা পাউরুটি পাওয়া যায় । আ-সেঁকা পাউরুটিতে বেশি অ্যাসিড হলেও তখন টের পেতাম না । বেশ উপাদেয় লাগত । চাকরি পাওয়ার পর ডিম-সেদ্ধ যোগ হয়েছিল । তবে সেসব আমাদের বেকার জীবনের কথা ।
সেবক সংঘের মাঠের একটা কোণার দিকের বারান্দায় ছিল আমাদের ঠেক । আলো-অন্ধকার খেলাঘরের মতোন বিলয় আর অভ্যুত্থান বিন্দুর মতোন সেখানে ওঠা নামা করত ।
অবসর ছিল অনন্ত । সময় অফুরান । জমত শনিবার । অণুংকর আর প্রদীপ দুজনেই শিবপুর বি. ই. কলেজ থেকে আসত । আড্ডা সেদিন প্রলাম্বিত হত । আর রোববারের দুপুরের কথা মনে পড়লে সেই সমস্ত রোদ্দুর ছিল যেন রূপকথা । 
সেই শনিবার অণুংকর এলো না , প্রদীপ এলো ।
বলল- সে তো অনেক আগে বেরিয়েছে ।
আমি , অমিয়াভ একসঙ্গে বললাম – সে গেলোটা কোথায় ! 
সুদীপ বলল – সন্দীপটাও তো নেই ।
আমরা বললাম , তাই-তো । স্যান্ডিও অফ ।
অবশ্য পরদিন রোববারে দুজনেরই দেখা পেলাম ।
বেশ বিশ্রস্ত চেহেরা । সেদিন ওরা কিন্তু ভাঙেনি কিছুই ।
ভাঙল এই মধ্য বয়সে আমাদের শারদীয়া আড্ডায় ।
স্যান্ডি একটা গ্রুপ করেছে এখন । হোয়াটস অ্যাপ ।
নাম ব্যাচ-৭৮। সেই গ্রুপে দীপংকর তার নাট্যচর্চার ধারা বিবরিণী দেয় । আর আমি এই বয়সে শোনাই রাক্ষস-খোক্কস আর পরীদের গল্প ।
স্যান্ডিই শুরু করল । অণুংকর , বেলানগর – সেই রাতটার কথা মনে পড়ে ।
অণুংকর হেসে উঠল ‘হো হো’ করে । সেই আমাদের পুরোনো বন্ধু অণুংকর ।
শারদীয় আড্ডায় দিল্লির নয়ডা থেকে আসতে পারেনি কিন্তু হাসির সংকেত পাঠাল ।
আমার মনে পড়ল সেই সুন্দর চোখ দুটো , ফর্সা ঝকঝকে দাঁত আর চমৎকার লাবণ্যে ভরা মুখটা ।
আমারা সকলে বদলে গেছি বাইরের চেহেরায় ।
ভয়ংকর রোগা ছিলাম , এখন ভয়ংকর মোটা হয়েছি । বন্ধুরা দেখেই বলে উঠল – কি হয়েছিস তুই !
এবার আসি বেলানগরের কথায় । অণুংকর চিরকালই সবটা কথা বলত না । এবারও একটু বলে বাঞ্জণা সমর্পণ করল স্যান্ডিকে ।
স্যান্ডি ব্যাংকে রয়েছে কিন্তু সে ইচ্ছে করলেই পেশাদার বাচিক শিল্পী হতে পারত ।
বেলানগর কিন্তু কোন হল্ট স্টেশন ছিল না । কর্ড লাইনের একটি স্টেশন ।
দীপংকর বলল – দুজনেই সেদিন কর্ড লাইনেই ছিলই !
স্যান্ডি হাসল ।
বলল- হ্যাঁ । একটু রাত হয়েছিল । বর্ধমান , মেইনের বদলে কর্ডে উঠে পড়ি ।
দীপংকর বলল – কিন্তু অণুংকর !
স্যান্ডি বলল – ‘ও’ একই ভুল করেছিল । 
তাই তো !
হোয়াটস অ্যাপে অণুংকর জানালো –হ্যাঁ ।
দীপংকর অপেক্ষা করতে পারছে না । শারদীয়া আড্ডার ব্যবস্থাপক এবার ভোলা আর মুরারি ।
পুরোনো সেই ক্লাসরুম যেন , কে নেই !
অভিনব , সুদীপ , চন্দন , চিন্ময় , অমিয়াভ , অরূপ , অচিন, কার্তিক , অনুপ , বিশ্বজিৎ , তানা , শৈবাল , ভালু ও ভাণু – কে নেই !
ইলিশের ফ্রাই চলে এলো সঙ্গে ব্ল্যাক কফি । 
মুরারি বলল – রাত অবধি থাকতে হবে সবাইকে ।
স্যান্ডি বলে – রাতে হুইস্কি আর প্রন ।
স্যান্ডি হচ্ছে এই গ্রুপের প্রাণ-পুরুষ । সে-ই খুঁজে খুঁজে বের করেছে সকলকে । অতল জলে হারিয়ে যাওয়া কৈশোরকে ফিরিয়ে আনা এই গ্রুপের কর্তব্য ।
ফিরে হয়তো গেছি । আমি তো দিব্যি ব্ল্যাক বোর্ড আর চকের গন্ধ পাচ্ছি ।
স্যান্ডি ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ বুজল । আহ্লাদের কামড় বসালো ইলিশের ফ্রাই-য়ে ।
ট্রেন বেলানগর ঢুকতেই চমকে গেলাম । এরপর গেলে তো কোন্নগরে বাড়ি ফিরতে পারব না ।
সামান্য বৃষ্টি হয়ে গিয়ে স্টেশন চত্বর বেশ ধবধবে হয়ে গেছে । ছাতিম গাছের তলায় চপ ভাজা হচ্ছে । 
একজন বয়স্ক মানুষ ভাজছেন । আর ঠোঙায় ভরে দিচ্ছে এক তন্বী । তার হাতের নেল-পালিশ কখনও কখনও লেপটে যাচ্ছে ঠোঙার বাইরের অংশে । 
খিদে ছিল সঙ্গে যোগ হল নান্দনিকতা ।
আবার হো হো হাসির সংকেত পাঠাল অণুংকর । মুঠোফোন জেগে উঠল ।
স্যান্ডি ঝুঁকে পড়ে দেখল , অনুংকর লিখেছে – চপসুন্দরীর প্রণয়ে আটকে পড়েছিল সন্দীপ । গোটা দশেক ‘চপ’ পরপর মেরে দিলো । অবর আলাদা আলাদা ঠোঙায় সেই নেল- পালিশের ছাপ । 
দীপংকর বলল – তোকে দেখেই নি !
অণুংকর বলল – না । একেবারেই না ।
তারপর ! এবার দেবব্রত বলল । 
শেষমেশ আমি পীঠে হাত রাখতে সন্দীপ ফিরে তাকাল । আমাকে একটা চপ হাতে ধরিয়ে ইশারা করল ।
তানা বলল – বেলানগরে এসব বিন্দাস কর্মকাণ্ড হয়েছিল ! ইস্‌ , আমি তো বহুবার নেমেছি সেই স্টেশনে । 
সুদীপ বলল – আর কি করলি স্যান্ডি !
কিছুই না , বৃদ্ধ কিছুক্ষণ পর উনুনে জল ঢেলে দিলো । ওরা সামনের আলপথে নেমে উধাও হয়ে গেল ।
তবে !
কী ? আমি বললাম ।
অপাঙ্গে একবার আমাদের দুজনকে দেখেছিল ।
আমাদের সেকেলে , সাবেকি গল্প এখানেই শেষ হওয়ার কথা কিন্তু আর কিছুটা ছিল ।
অণুংকর বলল – ট্রেনের বিভ্রাটে দুজনেই আটকে গেলাম । একটা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত ঘরে রাত কাটল আমাদের । মশক দংশনে টের পেলাম কি ভুলই না করেছি । 
স্যান্ডি বলল – সকাল হল । টিকিট কাউন্টার খুলল । ছাতিম গাছের তলায় চা , চপও ফিরে এলো। কিন্তু …
তালা বলল – হ্যা । আমি বহুবার খেয়েছি । কিন্তু সেখানে তো কোন তন্বীকে দেখিনি । 
দীপংকর বলল – কিন্তু সেই তন্বী নেই । তাও আবার চপ খেয়েছিলি !
অণুংকর বলল – ঘুগনি , পাউরুটি , ডিম সেদ্ধ খেয়েছিলাম ।
স্যান্ডি আর পারল না ।
বলল – নতুন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম – সন্ধেয় বুঝি অন্যরা বসেন !
এই চপওয়ালা যুবক ,স্বাস্থ্যবান । বেরসিক চেহেরা , বেশ ষণ্ডামার্কা ।
তবুও বলল , ভূতেদের দেখেছিলেন । 
বাবা আর মেয়েকে দেখেছিলেন তো ! 
হ্যাঁ । ঢোঁক গিলে বললাম ।
অনেকেই দেখেন । দুজনে মিলে সুইসাইড করেছিল । চপ বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল । 
স্তব্ধ হয়ে গেলাম । দুজনেই ।
অণুংকর লিখল – সত্যিই তাই ।
এরপর যুবকটি যেন শাসানোর গলায় বলল – এসব কাউকে বলার দরকার নেই ।
স্যান্ডি বলল – ‘আমি বললাম , কেন !’
সবটাই তো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে । আজ সন্ধেয় আরেকবার আসব । আমরা কিন্তু ভূতে বিশ্বাস করিনা ।
যুবকটি এবার কর্কশ গলায় বলল – জ্যান্ত ফিরবেন না তবে !
আমরা স্তব্ধ হয়ে রইলাম । 
মুরারি বলল – চল্‌ রান্না হয়ে গেছে । স্যান্ডির গল্প খাওয়ার পর আরেকবার শোনা যাবে ।
অণুংকর হোয়াটস অ্যাপে লিখল – আমরা আজও বুঝতে পারিনি সেদিনের সেই দৃশ্যটা ভৌতিক না অন্য কিছু !
স্যান্ডি বলল – আর কখনও বেলানগর যাইনি । 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।