“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

মাথেরানে মধুচন্দ্রিমা

(১)
মার্চ মাসের এক মাঝ সকালে টয়ট্রেনের ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে মাথেরানের মাটিতে পা দিতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল পল্লবীর। চারদিকে ঝলমলে আকাশ, দূষনমুক্ত পরিশুদ্ধ বাতাস। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল পল্লবী। নাম না জানা কিছু টাটকা ফুলের গন্ধে ভরা  বাতাসে ভরে উঠল ওর ফুসফুস। পল্লবীর মনে হল আজ যেন মাথেরানের আকাশে বাতাসে নব বসন্তের ভালোবাসার ছোঁয়া লেগেছে।
“আমি এগোচ্ছি। তুমি আস্তে আস্তে সাবধানে এসো।”, পল্লবীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে একটু জোরে পা চালালো সুবোধ। ধুতি আর লাল পাঞ্জাবি পরা এক হাট্টাকাট্টা মাঝবয়সী কুলি ওদের তিনটে ট্রলিব্যাগ নিয়ে বেশ খানিকদূর এগিয়ে গিয়েছে। যা দিনকাল পড়েছে তাতে কাউকে বিশ্বাস নেই, এই অজানা অচেনা জায়গায় কুলিটা ব্যাগগুলো নিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে বসে বসে আঙুল চোষা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না সুবোধের। কথাটা ভেবেই একটু বিরক্ত লাগলো ওর। পল্লবীর কথায় এই নির্জন মাথেরানে হানিমুন করতে না এলেই বোধহয় ভালো হোতো। সাধে কি আর বলে বৃদ্ধস্য তরুনী ভার্যা। সুবোধের থেকে পল্লবী প্রায় দশ বছরের ছোট, তার ওপর পরমা সুন্দরী। কচি, ডাগর নতুন বউয়ের কথা কিভাবে ফেলবে গোলমরিচ রঙের চুলের ওপর নুনের ছিটে পড়তে শুরু করা, ক্ষয়িষ্ণু চেহারার সুবোধ ? অগত্যা, ইচ্ছে না থাকলেও আসতে হল মাথেরানে। না হলে, পল্লবীর সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ও তো প্ল্যান করেই রেখেছিল হানিমুন করতে হয় গোয়া নয়তো উটি যাবে। কিন্তু পল্লবী জিদ ধরলো, সমুদ্র বা পাহাড় নয় হানিমুন করতে ওরা যাবে জঙ্গলে; গহন জঙ্গলে অন্ধকার রাতে হিংস্র পশুর ডাক শুনতে শুনতে গভীর থেকে গভীরতর হবে ওদের সম্পর্ক। শুনেই কেমন একটা অস্বস্তি হয়েছিল সুবোধের। এ কি উদ্ভট চাহিদা পল্লবীর! কোকিলের কলতান নয়, ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি নয়, শেষে কি না জন্তু-জানোয়ারের হুংকার শুনতে শুনতে মিলিত হতে চায় প্রানের মানুষের সাথে! দৃশ্যটা মনে মনে কল্পনা করতেই একটা হাড় হিম করা স্রোত নেমে এসেছিল সুবোধের শিরদাঁড়া বেয়ে।
তবে মাথেরানকে অবশ্য ঠিক জঙ্গল বলা চলে না। মাথেরান হল মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার কারজাত অঞ্চলের একটা ছোট্ট হিল স্টেশন, বড় বড় গাছপালা আর বার্কিং ডিয়ার, বড় বড় কাঠবেড়ালী, বেঁজি, বুনো শুয়োরের মতো কিছু ছোটখাটো বন্যপ্রাণী দিয়ে ঘেরা ; ঠিক জঙ্গল না হলেও জঙ্গলের অনেকটা কাছাকাছি। তবে প্রচুর বাঁদর আছে এখানে। আর তারা বাঁদরামিতেও কম যায় না; একটু অন্যমনস্ক হলেই হাতে ধরা খাবারদাবার নিয়ে দে দৌড়। পরিবেশ পরিশুদ্ধ রাখার জন্য মাথেরানে কোনো অটোমোবাইল ঢুকতে দেওয়া হয় না, মানে পেট্রল বা ডিজেল চালিত গাড়ি এখানে নিষিদ্ধ। এখানে বাহন বলতে ছোট ছোট টানারিক্সা আর টাট্টু ঘোড়া। সে জন্যই তো ওদের এতো গাড়িঘোড়া পালটে পালটে এখানে আসতে হল। প্রথমে পুনা থেকে ট্রেনে চেপে নেরল স্টেশন, তারপর একটা ভাড়ার গাড়িতে করে পাকদণ্ডী পেরানো, তারপর আবার আধঘণ্টার টয়ট্রেন যাত্রা করে অবশেষে মাথেরান। না হলে তো সুবোধ নিজেই ওর ফোর-হুইলারটা চালিয়ে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই পুনা থেকে এই আশি-একাশি কিলোমিটার দূরের মাথেরানে পৌঁছে যেতো।
স্টেশনের বাইরে সার বেঁধে দাঁড়ানো টানারিক্সাগুলোর একটার সামনে কুলিটা ট্রলিব্যাগ তিনটে নামিয়ে রাখল। সুবোধ দেখল রিক্সাগুলোর যা সাইজ তাতে একজনই মালপত্র সমেত বসতে পারবে। কুলির পাওনা মিটিয়ে দিয়ে ও দরাদরি করে দুটো টানারিক্সা ভাড়া করল। মালপত্র ভাগাভাগি করে দুটো রিক্সায় তুলে দেওয়ার পর পিছনে তাকিয়ে দেখল পল্লবী আসছে কি না। না, পল্লবীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল সুবোধ। কি হল মেয়েটার ? পথ হারিয়ে ফেলল না কি ? সুবোধ পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে পল্লবীর নাম্বার ডায়াল করল। কিন্তু পল্লবীর কাছে পৌঁছানোর আগেই কেটে গেল ফোনটা। সুবোধ দেখল ওর ফোনে কোনো কানেকটিভিটি নেই। শুনেছিল বটে মাথেরানে নেটওয়ার্কিং-এর বড় সমস্যা। কিন্তু টানারিক্সায় মালপত্র ফেলে রেখে পল্লবীকে খুঁজতে যাওয়াও তো সম্ভব নয়। তাহলে এখন উপায় ?
কি করবে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দুহাত দিয়ে মাথার চুলগুলোকে চেপে ধরল সুবোধ।
(২)
শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগার পর থেকেই ‘ওয়াইল্ড’ ব্যাপারটা খুব টানত পল্লবীকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা, দাড়ি-গোঁফ কামানো তথাকথিত ‘ভালোছেলে’দের থেকে ঝাঁকড়া চুলের গালভর্তি দাড়িওয়ালা মস্তান টাইপ ছেলেদেরই বেশি পছন্দ ছিল ওর। রাস্তাঘাটে ওই ধরনের পুরুষমানুষ দেখতে পেলেই পল্লবীর হার্টবিট বেড়ে যেতো, বুকের ভেতর কেমন উথাল-পাথাল স্রোত উঠত। মনে হোতো এখনই ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে; অনেকদিন ব্লেডের ছোঁয়া না পাওয়া রুক্ষ গালে পরম আদরে ঘষতে থাকে ওর নরম গাল। বন্ধুরা এ সব শুনে হাসাহাসি করতো ওকে নিয়ে। আর ওর জঙ্গলে হানিমুন করতে যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে সবাই ওকে বলত বদ্ধ পাগল। পল্লবী অবশ্য বন্ধুদের ঠাট্টা-তামাসায় কিছু মনে করতো না, সবাই কি আর সব কিছুর মর্ম বোঝে ? গহীন জঙ্গলের আদিমতা, ঘন সবুজ বন্যতা হল নিষিদ্ধ মাদকের মতো; একবার নেশা লেগে গেলে ঘোর কাটানো খুব মুশকিল। সবাই কি আর তার স্বাদ নিতে পারে ?
মাথেরানের বাতাসে কি জাদু আছে কে জানে ? পুরোনো দিনের কথাগুলো বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে পল্লবীর। দিদির যখন বিয়ে হয় তখন ও সবে চোদ্দ পেরিয়ে পনেরোয় পা দিয়েছে। দিদি ছিল ওর থেকে প্রায় ছ’বছরের বড়। মা মারা যাওয়ার পর থেকে দিদিই মায়ের মতো করে দেখাশোনা করেছে পল্লবীর। বিয়ের পর দিদি ওকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবলেই খুব দুঃখ হত ওর। তাও তো দিদির গায়ের রংটা একটু কালো বলে বাবার প্রায় বছর চারেক লেগে গেল দিদির জন্য উপযুক্ত পাত্র পেতে। তবে এবার মোটা টাকা পণের বিনিময়ে দিদির জন্য বেশ ভালো একখানা পাত্র জোগাড় করতে পেরেছে বাবা। একমাত্র ছেলে, পুনাতে নিজের বাড়ি, রমরমা ব্যাবসা, তার ওপর মা নেই। তার মানে দিদিকে শ্বসুরবাড়িতে শাশুড়ির মুখনাড়া শুনতে হবে না।
বিয়ের পর দিদি যখন প্রথমবার বাপের বাড়ি এল তখন কি সুন্দরই না লাগছিল দিদিকে। নতুন জীবনের কতো গল্পই না শুনিয়েছিল পল্লবীকে; বেশিরভাগই অবশ্য জামাইবাবুকে নিয়ে। দিদির কাছে জামাইবাবুর গল্প শুনতে শুনতে পল্লবীর বার বার মনে হত বাবা নিশ্চয় ওর জন্যও এ রকমই কোনো সুপাত্রের সন্ধান পাবে। জামাইবাবু মানুষটাও খুব ভালো ছিল। সে বার ও যখন দিওয়ালির সময় দিদির বাড়ি গেল, তখন কি মজাটাই না করেছিল ওর সাথে। দিদি চিরকালই একটু ভিতু প্রকৃতির, ফুলঝুরি আর রংমশাল ছাড়া অন্য কোনো বাজি ফাটাতে খুব ভয় পেতো। কিন্তু পল্লবী ছোটবেলা থেকেই বেশ ডাকাবুকো। সে বার বাজী ধরে বাজি ফাটানোতে টেক্কা দিয়েছিল জামাইবাবুকে। পুরস্কার হিসাবে মোটরবাইকে চড়িয়ে পুরো পুনা শহর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল জামাইবাবু। জামাইবাবুর বাইকের পিছনের সিটে বসে নিজেকে দিদির মতো মনে হচ্ছিল পল্লবীর। মনে হচ্ছিল, ওর ও একদিন দিদির মতো সাজানো সংসার হবে, জামাইবাবুর মতো ভালো বর হবে…
“আমরা আর কখন হোটেলে পৌঁছাবো ? আমার যে খুব জোর সুসু পেয়েছে।”, গুনগুনের কচিকণ্ঠের আশঙ্কিত স্বরে সুখচিন্তায় ছেদ পড়ল পল্লবীর। ও মোলায়েম স্বরে জবাব দিল,”এইতো এসে গেছি। আর একটুখানি।”
লেডিস টয়লেটের খোঁজ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল পল্লবী। কি ভেবেছিল, আর কোথা থেকে কি হয়ে গেল…
(৩)
গিরিবিহার হোটেল। চারপাশে বড় বড় গাছ আর তার মাঝে ছোট ছোট কয়েকটা কটেজ, মাঝখানে বাচ্চাদের খেলার জায়গা, দোলনা। বড়দের জন্য গাছে বাঁধা গোটা দুয়েক হ্যামক। মাধবীলতা আর বোগেনভেলিয়ার গেট দিয়ে সাজানো সেলফি পয়েন্ট। কটেজগুলো কোনওটা এক কামরার, কোনওটা আবার দু’কামরার। চার-পাঁচ ধাপের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট্ট বারান্দা, তারপর ঘর। এই রকমই একটা এক কামরার কটেজের অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত সিগারেটে টান দিচ্ছিল সুবোধ। রাত বেশি না হলেও চারপাশ নিঝুম। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দার রেলিং-এর ওপর। বাতাসে ভেসে রয়েছে একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ, বোধহয় মাধবীলতা। এ সময় কি সুবোধের এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকার কথা ?
পল্লবীর আবদার মেনে নিয়ে সারা বিকেল সুবোধ ওর সাথে টইটই করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। গ্রামদেবতা পিসরনাথের মন্দিরটা এই গিরিবিহার হোটেল থেকে খুব কাছে। মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। মন্দিরের সামনে একটা বড় লেক আছে। বোটিং বা অন্যান্য ওয়াটার গেমের কোনো ব্যাবস্থা নেই ঠিকই, তবে লেকের নীল জল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। পড়ন্ত রোদে সঙ্গিনীর হাত ধরে নরম বালিতে বসে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বন্ধু প্রীতমের কাছ থেকে এমনই শুনেছে সুবোধ। গত বছর প্রীতম এখানে এসেছিল ওর স্ত্রীকে নিয়ে। সুবোধ ভেবেছিল পল্লবীর হাতের ওপর হাত রেখে লেকের ধারে বসে রক্তিম সূর্যের দিকচক্রবালে মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ওকে মনের কথা বলবে, সন্ধ্যে গাঢ় হতে শুরু করলে পল্লবীর কোমরে হাত রেখে ঘন আদিম মহাদ্রুমের বনবীথি পেরিয়ে ফিরে আসবে হোটেলে। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
পিসরনাথের মন্দিরে একটা প্রণাম ঠুকেই বেরিয়ে এল পল্লবী। নীল ঝিলটার দিকে এক ঝলক দেখেই হাঁটা দিল ফিরতি পথে। সুবোধ কিছু বলার আগেই ও বলল স্টেশন চত্বরে যাবে, ওখানে যে মার্কেট আছে সেখান থেকে একটু কেনাকাটা করবে। টানারিক্সাগুলো স্টেশনের কাছেই থাকে, ওখান থেকেই ভাড়া নেয়। যদি ভাগ্য খুব ভালো হয় তবেই এই সব জায়গা থেকে এক-আধটা ফিরতি রিক্সা পাওয়া যায়। তার মানে এখন আবার হেঁটে হেঁটে স্টেশন চলো। খুব বিরক্ত লাগলো সুবোধের। ও মুখ ভার করে পল্লবীর পিছু ধাওয়া করল। হিল স্টেশনের এইসব ছোট ছোট মার্কেটগুলোতে কি কি পাওয়া যায় তা বেশ ভালোভাবেই জানা আছে সুবোধের। কাঠের খেলনা, হাতা, খুন্তি, ছোট্ট ছোট্ট স্পাইক দেওয়া হাত-পা মালিশ করার যন্ত্র। কমদামী রংবাহারি জামাকাপড়। আর থাকে একগাদা চিক্কির দোকান। মগনলাল চিক্কি, সোহনলাল চিক্কি- দোকানের নাম যাই হোক না কেন জিনিস সেই একই। চিনির গাঢ় রসে আঁটা চিনেবাদাম, নয়তো কাজু, কিশমিশ, আখরোট, নাহলে গুঁড়ো গুঁড়ো রাজগীরা। হানিমুন করতে এসে পল্লবীর এইসব ফালতু জিনিস কেনার যে কি দরকার তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সুবোধ। তবে একটু একটু আন্দাজ করতে পারে। এ সবই হল ওকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা। অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করার পরেও স্বামীর প্রাপ্য অধিকারটুকু না দেওয়ার চেষ্টা। দশ দিন হল ওদের বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত পল্লবীকে অঙ্কশায়িনী করতে পারেনি সুবোধ; একই ছাদের তলায় থেকেও ছুঁতে পারেনি ওর পরম সুন্দর শরীর। পল্লবীর যদি ওকে এতই অপছন্দ ছিল তাহলে বিয়েতে মত দিল কেন ???
লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল সুবোধ। দেখা যাক, কাল হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হবে। কাল সকাল থেকেই ঘোরাঘুরির প্ল্যান করেছে পল্লবী। সুবোধ সেইমতো হোটেলের ম্যানেজারকে বলে একটা টানারিক্সার ব্যাবস্থা করেছে। ব্রেকফার্স্ট করেই বেরিয়ে পড়বে ওরা। কাল আর ওদের রিক্সার জন্য স্টেশন অবধি যেতে হবে না, ম্যানেজারের কথামতো রিক্সাটা হোটেলের সামনে চলে আসবে।
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল সুবোধ। মাথেরানে মোটামুটি এগারোটা নামী ভিউ পয়েন্ট আছে। মহাবালেশ্বরের মতো এখানেও রয়েছে মাঙ্কি পয়েন্ট আর সুইসাইড পয়েন্ট। এ দুটো অবশ্য খুব কমন, মহারাষ্ট্রের প্রায় সব হিল স্টেশনেই এই দুটো ভিউ পয়েন্ট দেখা যায়। সুবোধ একটু এক্সাইটেড ‘হানি-বি’ পয়েন্ট দেখার জন্য। এখানকার মানুষেরা বলে ‘মধুমক্ষী’ পয়েন্ট। বড় বড় জংলী গাছে বাসা বাঁধে বন্য মৌমাছি। তৈরী করে বড় বড় মৌচাক। অনেক সময় মৌচাক থেকে মধু ঝরতেও দেখা যায়।
এক টানে সিগারেটটা শেষ করে ফেলল সুবোধ। এখন অফ-সিজন তাই বেশি বোর্ডার নেই হোটেলটাতে। গাছের পাতার ভেরত থেকে নিঝুম অন্ধকারের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসছে রাতচরা পাখির ডাক। মাঝে মাঝে পাওয়া যাচ্ছে নিশাচরের পায়ের আওয়াজ; খুব কাছে, মনে হচ্ছে যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে। চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল সুবোধ। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে চলল অজানার দিকে।
প্রিয়াঙ্কার কথা খুব মনে পড়ছে সুবোধের। বার বার চোখের ওপর ভাসছে প্রিয়াঙ্কার সরল সাধাসিধে মুখখানা। প্রিয়াঙ্কা; সুবোধের প্রথম স্ত্রী, গুনগুনের মা, পল্লবীর দিদি
(৪)
মশালা চায়ের কাপটাতে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে এসে খবরটা দিল। টুরিষ্টের মৃত্যুর খবর পেয়ে একটু হকচকিয়ে গেল থানেদার দিলীপ মোরে। অল্পদিন হল ও এই মাথেরান পুলিশ চৌকিতে এসেছে। একে বয়স কম তার ওপর অভিজ্ঞতাও প্রায় নেই বললেই চলে। তাই কিংকর্তব্যবিমুড়ের মতো শুনছিল লোকটার কথাগুলো। এক নিঃশ্বাসে কথা বলে চলেছে লোকটা। বার বার ঠোঁট চাটছে, বোধহয় গলা শুকিয়ে গিয়েছে। জলের গ্লাসটা লোকটার দিকে এগিয়ে দিল থানেদার সাহেব। জল খেয়ে একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল লোকটা।
সবকিছু শোনার পর নিজের মতো করে গুছিয়ে নিল দিলীপ মোরে। যে লোকটা ছুটতে ছুটতে খবরটা দিতে এসেছে তার নাম পরশুরাম। সে পেশায় টানারিক্সার হেল্পার। এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি রাস্তায় একার পক্ষে রিক্সা টানা প্রায় অসম্ভব। তাই রিক্সাওয়ালারা পরশুরামের মতো লোকেদের ভাড়া করে রিক্সাটাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। অনেকসময় রাস্তা খারাপ থাকার জন্য ভিউ পয়েন্টের কাছ পর্যন্ত রিক্সা যেতে পারে না, রিক্সাওয়ালারা যাত্রীদের বেশ খানিকটা দূরে নামিয়ে দিয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কিছুক্ষন জিরিয়ে নেয়। তখন পরশুরামের মতো হেল্পারেরা সামান্য কিছু বখশিসের বিনিয়মে টুরিষ্ট গাইডের কাজ করে; যাত্রীদের পথ দেখিয়ে স্পষ্টে নিয়ে যায়, নানা রকম ইনফর্মেশন দেয়। যখন এতো সেলফি তোলার ঘটা ছিল না তখন এরা টুরিষ্টদের ফটোও তুলে দিত।
আজ সকালে পাপ্পু খোটের রিক্সার হেল্পার হয়েছিল পরশুরাম। গিরিবিহার হোটেলের সামনে থেকে রিক্সায় উঠেছিল একটা ফ্যামিলি। একটা রোগাপটকা আধবুড়ো লোক, একটা ফর্সা, টুকটুকে কমবয়সী বউ আর একটা বাচ্চা মেয়ে। বউটা লোকটার থেকে বয়সে অনেকটা ছোট ছিল আর সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছিল নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। সঙ্গে বাচ্চাটা না থাকলে পরশুরাম তো ধরেই নিতো যে ওরা হানিমুন করতে এসেছে।
আলেকজান্ডার পয়েন্ট, লুইস্যা পয়েন্ট আর প্যানোরামা পয়েন্ট দেখার পর লোকটা বলল মধুমক্ষী পয়েন্ট দেখতে যাবে। এই পয়েন্টটা মেন রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে। ছোট বড় পাথরে ভরা চড়াই-উতরাই পথ। একটু দূর যাওয়ার পর বউটা ওকে বলল বাচ্চাটাকে কোলে নিতে। বেশি বখশিস পাওয়ার আশায় পরশুরাম মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সাবধানে চলতে লাগল। বউটা লোকটার হাত ধরে জঙ্গুলে পথ দিয়ে এগিয়ে গেল ভেতরের দিকে। বাচ্চাটার সাথে কথা বলতে বলতে পরশুরাম আস্তে আস্তে হাঁটছিল, হঠাৎ দেখল বউটা পাগলের মতো ছুটে আসছে। পরশুরাম বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে তাড়াতাড়ি বউটার দিকে এগিয়ে গেল। বউটা হাঁপাতে হাঁপাতে ওকে জড়িয়ে ধরে হাত-পা নেড়ে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হল না। ভাবগতিক দেখে পরশুরাম বুঝল নিশ্চয় কিছু অঘটন ঘটেছে। ও দৌড়ে গেল মধুমক্ষী পয়েন্টের দিকে। জায়গাটা একেবারে ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে লোকটাকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করল পরশুরাম, কিন্তু গভীর খাদের ওপারে সবুজ পাহাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।
বউটার যা অবস্থা তাতে থানায় এসে কিছু বলতে পারবে না। তাই ওদের পাপ্পু খোটের হেফাজতে রেখে পরশুরাম নিজেই এসেছে পুলিশ ডাকতে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দিলীপ মোরে। এইসব বোকা বোকা টুরিষ্টদের নিয়ে আর পারা যায় না; ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে নাম কেনবার জন্য খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে চায়। তারপর আনাড়ির মতো পা পিছলে খাদের ভেতর পড়ে পুলিশের কাজ বাড়ায়। এটাও সে রকমই কোনো কেস হবে। কচি বউয়ের সামনে বেশি হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে খাদের ভেতর পড়েছে বুড়ো বরটা। এখন দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে স্পটে যেতে হবে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বডিটা উদ্ধার করে পাঠাতে হবে পোষ্টমর্টেমের জন্য।
(৫)
সুবোধের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় দুটো বছর। শোক-দুঃখ ভুলে সবাই আবার ফিরে এসেছে জীবনের মূলস্রোতে। প্রথমে আপত্তি করলেও পাড়া-প্রতিবেশি আর কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পল্লবীর পুনর্বিবাহে মত দিয়েছেন শ্বসুরমশাই। খানিকটা অনিচ্ছাস্বত্বে হলেও বাবা পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে বিধবা পল্লবীর জন্য। বাবার কাছে বিয়ে মানেই আবার একগাদা টাকা পণ দেওয়া; তাই পল্লবীর আবার বিয়ে দিতে একটু ইতঃস্বত করছে। তবে পল্লবীর ভাগ্য ভালো। একটা বিনা পণের সম্বন্ধ এসেছে ওর জন্য।
সুবোধের এক দূর সম্পর্কের বোন তার দেওরের সম্বন্ধ এনেছে পল্লবীর জন্য। ছেলেটা কামকাজ কিছু করে না, সারাদিন খালি সমাজসেবা করে বেড়ায়। তবে ফটো দেখে ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছে পল্লবীর। মনে মনে ও যেমন স্বামী চাইতো, এই ছেলেটা ঠিক সেই রকম। পেশীবহুল বলিষ্ঠ চেহারা, ফর্সা রঙ, আর শিবাজি মহারাজের মতো দাড়িগোঁফ। পল্লবী রোজ সকাল সন্ধ্যে ‘গণপতি বাপ্পা’-র কাছে প্রার্থনা করে এই ছেলেটার সাথেই যেন ওর বিয়ে হয়।
পল্লবী, দিদির মতো একটা সাজানো সংসার, জামাইবাবুর মতো একজন স্বামী চাইতো ঠিকই, কিন্তু তার মানে তো আর দিদির স্বামীকে, দিদির ফেলে যাওয়া সংসারটাকে আপন করে নেওয়া নয়। পল্লবী চাইতো নিজের সংসার, নিজস্ব স্বামী। তাই যখন হঠাৎ করে সেপটিসেমিয়ায় ভুগে প্রিয়াঙ্কা মারা গেল আর বাবা গুনগুনের ভালোর জন্য কিছু হিতাকাঙ্খীর পরামর্শে সুবোধের সাথে ওর বিয়ের ঠিক করল, তখন পল্লবীর মনে হয়েছিল যে ও সুইসাইড করবে। কিন্তু পল্লবী ছিল সাহসী মেয়ে, তাই আত্মহত্যা করার বদলে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। বাবাকে জানালো নিজের মনের কথা। কিন্তু বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়; ভালো পাত্র যখন হাতের কাছে রয়েছে তখন আবার নতুন করে অন্য পাত্র খোঁজার কি দরকার ? আর তাছাড়া সুবোধের সাথে বিয়ে হলে নতুন করে কোনো পণ দিতে হবে না, অন্য পাত্র মানেই তো আবার একগাদা পণ। পল্লবীর চেনাজানা এমন কি কেউ আছে যে ওকে বিনা পণে বিয়ে করবে ?
বাবার এই সব অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আর কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি পল্লবী। শুধু এইটুকু বুঝেছিল যা করার তা ওকেই করতে হবে। আর তাই বিয়ের আগে থেকেই জীবনকে আবার নিজস্ব গতিতে ফিরিয়ে আনার প্ল্যান ছকে রেখেছিল পল্লবী।
সেদিনটার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে পল্লবীর। সুবোধকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিল মাথেরানে হানিমুন করতে যাওয়ার জন্য। কাজের জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিল নির্জন মধুমক্ষী পয়েন্ট। গুনগুনকে গাইডের কোলে চাপিয়ে দিয়ে, সুবোধকে ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল খাদের ধারে। তারপর মৌচাক দেখাবার নাম করে ছোট্ট একটা ধাক্কা…
ভাবতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল পল্লবীর। ও তাড়াতাড়ি মোবাইল ফোনের ফটো গ্যালারি খুলে হবু স্বামীর ফটোতে হাত বোলাতে লাগল। এবার বেশ শান্ত লাগছে মনটা। দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমার ছক কষতে লাগল পল্লবী। এবারে একটা সত্যিকারের জঙ্গলে যাবে। বিশাল বড় ঘন জঙ্গল, হিংস্র প্রাণীতে ভরা, জান্তব গর্জনের মাঝে অমাবস্যার তারা ভরা রাতে জোনাকি দেখতে দেখতে আপন থেকে আপনতর করে নেবে ওর জীবনের পরম পুরুষকে…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।