রম্য রচনায় অমৃতা ভট্টাচার্য

কমলার বাকল দিয়ে কাচকি চচ্চড়ি

একটা মফস্বলের সন্ধ্যে। ক্লাবের মাঠে মাঁচা বেঁধেছে পাড়ার ছেলেরা। অজিত পাণ্ডে গাইছেন, ‘দেশ সুদ্ধ লোক যতদিন খেতে পায়নি কমলালেবু, খাননি লেনিন।’ এমন গান শুনতে ভিড় জমিয়েছে ছেলে বুড়ো মাসীমা পিসিমারা। তারা যে সবাই লেনিনকে চেনেন এমনটা নয় তবু তারা শুনছেন। কমলালেবুর মতো গোল পৃথিবীর গল্পে লেনিন নামে একটা লোকের সহানুভূতি কেমন করে মিশে যাচ্ছে এমন শীত সন্ধ্যায় এক ফেরতা আলোয়ানের মতো, সে গল্প তারা শুনছেন গানে গানে। গান ফুরানো সন্ধ্যে শেষে তারা বাড়ি ফিরবেন। বাড়িতে বাড়িতে তখন গরম ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে। সে গন্ধের মধ্যে তখনও চলে ফিরে বেড়াবে গণসংগীতের সুর। সেসব সুর কি আর মানুষকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে পারে? পারে না বোধহয়। তাই না সকলের খাওয়া হয়ে গেলে মায়েরা একলা একলা খান! সকলের কমলালেবু জুটলেও তাদের জোটে কিনা সন্দেহ! এমনই তো দেখেছি আমরা! ঘরে ঘরে। আমাদের সেই মফঃস্বলের জীবনে আসলে কমলালেবু ছিল আস্ত একটা বিলাসিতা। সেই কোন দূরের বাজারে গেলে তবে তার দেখা মেলে। হবেই তো, এ কী আর কমলালেবুর দেশ! রূপকথার গল্পে পড়েছিলাম সেই কমলাফুলি কন্যের কথা। অমন একটা দেশে যাওয়ার ইচ্ছেটা তখন পেয়ে বসে বেমক্কা। দার্জিলিং হয়ে শিলং হয়ে সিলেটের কোন এক অজানা উপত্যকা আমায় তখন টানে। একটা আস্ত ছবির বই পড়তে পড়তে আমি টের পেয়ে যাই, অমন একটা কমলালেবুর দেশের মানুষ এই আমাদের নিমাই। আহা! যার যেখানে দেশ তার কি আর সেখানে ফিরে যাওয়া হয়? সব সময় তো আর হয় না তা। কমলালেবুও খাওয়া হয় না আর! সেকথা ভেবে আমার খানিক দুঃখ হয় বৈকী। সেই দুঃখের শরীরে মিশে যেতে যেতে কবে যে আসলেই বড় হয়ে যাই সে কথা এখন বলে বোঝানো মুশকিল। এ শহরের ফুটপাথে দোকানে কমলার ঝুড়ি দেখলে আমার মনে পড়ে সেই শীত সন্ধ্যের কথা। ধোঁয়াশা আর কুয়াশার শহরে আমি তখন এ গলি পেরিয়ে ও গলির দিকে হাঁটতে হাঁটতে কত কী যে ভাবি! চৈতন্য আর লেনিনের দুনিয়া পেরিয়ে হেঁশেলের জানলায় মুখ লাগিয়ে দেখি একেকবার। কত কত মায়ের মুখ তখন লেনিনের উচ্চারণ হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। কমলালেবুর মতো আশ্চর্য পৃথিবীতে তখন বিকেলের আলো মরে আসে। সেই মরে আসা গোধূলি আলোয় আমার ইচ্ছে করে কমলা লেবুর খোসা দিয়ে ডাইল রানতে, মাছ রানতে। শ্রীহট্টের কোন সে কমলালেবুর বন থেকে কমলাফুলি কন্যের উপকথার মতো এ রান্নার গন্ধ আমি পাই। হেঁশেলের জীবনও তো রূপকথার মতোই। কত না অ-লৌকিকতার খোসবাই সেখানে দিনরাত উঠছে পড়ছে। মেহনতি মায়েদের সেসব গল্প কমলালেবুর মতো আশ্চর্য পৃথিবী মনে রেখেছে কি? এইসব ভেবে ভেবে মনে হয় ,গণতন্ত্রের যদি এক চিলতে রান্নাঘর থাকতো! আহা!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।