অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ২৪)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

কবি তুমি,একাগ্রতার এক দৃপ্ত বিন্দু যেন,
তাই থাকো,মগ্নতার নিভৃত গহনে ;
তোমার সামনে এসে কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যাক,
কবির সৃষ্টি যেন ফুটে ওঠবার দিন গোনে।

তরুণ কবি বাদল মেঘকে ফোন করতে করতে আরেকটা দিন গড়িয়ে গেলো। দিনের সবটুকু কেড়ে নিচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক খবরাখবর সংগ্রহে। পুরোনো স্কুটি আর মধ্যবয়সী শরীরটা মাঝে মধ্যে শুয়ে পড়বার ভয় দেখাচ্ছে‌ । নিজেকে ইদানিং বেতো ঘোড়া বলে মনে হচ্ছে অমলেন্দুর। দিল্লি থেকে জ্যাঠতুতো এক দাদা ও বৌদি কয়েকদিন আগে ফোন করে সংসারী হবার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ইদানিং অমলেন্দু চুপ করে থাকতে শিখে গেছে।শিখে গেছে মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। বৌদি তাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল শেষ বয়সের নিঃসঙ্গতার কথা। অমলেন্দু আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল — শেষ বয়স মানে ঠিক কতটা বয়স বৌদি ? বৌদিকে নিরুত্তর হয়ে যেতে দেখে সে নিজেই জবাব দিয়েছিল — সত্তর বছর পর্যন্ত অনায়াসে টেনে দেবো বৌদি।তোমরা আমাকে বাহাত্তুরে বুড়ো বলতে পারবে না। সেই বিখ্যাত ভীমরতির বয়স আসার একটু আগেই সদর দরজা না হোক , খিড়কি দুয়ার দিয়ে ঠিক পালিয়ে যাবো‌।আমার জন্য একটা দুটো শোকসভা হবে বড়জোর । তার বেশি কিছু নয়। খবরের কাগজে মাঝের পাতায় হয়তো চার লাইনের একটা শোক সংবাদ। ব্যস। খেল খতম পয়সা হজম। আমার এই ভদ্রাসনটুকু তো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া , কাজেই তাকে উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ হয়ে যেতে দেবো‌ । তরুণ কবিরা আগামী দিনে তার ভবিষ্যৎ রচনা করবে‌‌ । দাদা , বৌদি , তোমরা একটা সুন্দর নাম দিতে পারো আমার এই আস্তানার ? জ্যাঠতুতো দাদা অরিন্দম মন্ডল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কবি হিসেবে বেশ কিছুটা নাম করেছিলো । তারপর বড় সরকারী চাকরি নিয়ে দিল্লি প্রবাসী হয়ে যায়। একটুও না ভেবে দাদা স্মার্টলি বললো–একটা নাম মনে আসছে ,যদি বাতিল না করিস বলবো । অমলেন্দু হেসে ফেললো । বললো –ডান । বলে ফেলো। দাদা বললো– নামটা হলো–কবিজন্মের আঁচল । পাশ থেকে বৌদি ফোড়ন কাটলো–উঠোন নয় কেন ? ও প্রান্ত থেকে অমলেন্দুর উত্তর — না বৌদি।উঠোন বললে আঙিনাটুকুই বোঝায় । আর আঁচল বললে একটা আশ্রয় বোঝায় । যেন ছায়াবৃতার পবিত্রতা । বৌদি হতাশ গলায় বললো — তাহলে সংসারী আর হবে‌ না তুমি ? অমলেন্দু তার উত্তরে দরাজ গলায় বলে উঠেছিলো — কবিজন্মের আঁচলেই তো ভরা সংসার হবে আমার ।
আজ এই মুহূর্তে , রাত সাড়ে ন’টার গ্রামীণ নির্জনতায় , প্রতিশ্রুতিবান কবি বাদল মেঘকে ফোন করতে গিয়ে কেন জানিনা অমলেন্দুর হঠাৎ মনে হলো — তার গড়ে দেওয়া কবিজন্মের আঁচলে কারা এসে বাসা বাঁধবে শেষ পর্যন্ত ? যারা মন দিয়ে , ধ্যান দিয়ে কবিতা লেখার চাইতে , কবিতার মার্কেটিংকে বেশি গুরুত্ব দেয় ? তারা ? বাদল মেঘ ছেলেটির গলাটা খুব সুন্দর । ও প্রান্ত থেকে মুগ্ধতায় ভরা ‘হ্যালো’ বলে ওঠা শুনে অমলেন্দু সরাসরি বললো — আচ্ছা বন্ধু , তোমার কন্ঠস্বর তো খুব সুন্দর । তুমি নিজেই নিজের কবিতা কমিউনিকেট করতে পারো তো ! সুন্দর করে বলতে পারলে ভালো কবিতা আরো ভালো শোনায়‌। ও প্রান্ত থেকে অবাক উত্তর — তার মানে ? অমলেন্দু এবার একটু রুক্ষভাবেই জবাব দিলো– শোনো কবি, তোমার রুটি রুজির লড়াইয়ের বাইরে যে কঠোর পরিশ্রম সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাবে , সেটা হল লেখার অভ্যাস তৈরি করা। প্রতিদিন কালি কলম মনকে এক জায়গায় এনে খাতার পাতায় তার প্রতিফলন ঘটানো । কবি বাদল মেঘ এবার একটু অসহিষ্ণু উত্তর দিলো — স্যার , তার মানে কি আমার লেখা আদৌ দাঁড়াচ্ছে না ? অমলেন্দু আরও গভীর থেকে উত্তর দেয়– কেন দাঁড়াবে না ? ভালোই তো হচ্ছে লেখা । আমি তোমার লেখা মন দিয়েই পড়েছি। এখনো আমার টেবিলের ওপর ছড়ানো রয়েছে কবিতাগুলো। কিন্তু আমার ভয় অন্য জায়গায় কবি । তুমি ভালো লিখছো , এটা তোমার কুড়ি বছর পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু সাতাশ বছর বয়সে এসে , ভালো শব্দটা আর যথেষ্ঠ নয়। এবার তোমার কলম থেকে পুষ্পবৃষ্টি হোক। তোমার পাঠক পাঠিকারা সেটাই চায় । তোমার বন্ধু তিথি হয়তো সেটাই আশা করে। তিথি তোমাকে প্রতিদিন লক্ষ্য করছে। কিন্তু কী দেখছে সে ? একজন দারুণ সম্ভাবনাময় কবি , বাচিক‌শিল্পীদের প্রিয় হয়ে ওঠার জন্য কী প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ! ও প্রান্ত একদম চুপ । অমলেন্দু আবার বলে –তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথাগুলো ?
— হ্যাঁ স্যার,আমি শুনছি । আপনি বলুন ।
— আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছো । আমি বলতে চাচ্ছি‌ ,তুমি কি মেনে নিতে পারছো আমার কথা ?
— হ্যাঁ স্যার, আমি আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই । তিথি বলে –পরিচিতদের পিঠ চাপড়ানি পেয়ে পেয়ে আমি শুধু সস্তা জনপ্রিয়তার কথাই ভাবছি । আপনি বলুন । আমি শুনছি ।
–দ্যাটস গুড ।
অমলেন্দু আবার শুরু করে।
একজন তরুণ ফুটবলারকে লক্ষ্য করেছো ? ঘন্টার পর ঘন্টা সবুজ মাঠে স্প্রিন্ট টানছে , নানারকম শারীরিক কসরৎ করছে , ঘন্টার পর ঘন্টা লেগে পড়ে থাকছে। দিনের পর দিন ,মাসের পর মাস, বছরের পর বছর । হয়ে ওঠার দিনগুলো বড় কঠোর ।কেউ তার দিকে লক্ষ্য করছে না। গরীব বাবা মা তাকে পর্যাপ্ত খাবারও দিতে পারছে না। তবুও সে লড়াইয়ের জমি থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসছে না। পালিয়ে যাচ্ছে না। এভাবে একদিন যখন সে রাজ্যস্তরে খেলার জন্য সিলেক্ট হচ্ছে,অনূর্ধ্ব উনিশ , অনূর্ধ্ব একুশে চান্স পাচ্ছে , বড় ক্লাবগুলো তাকে নেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে , তখন তাদের ভাঙা চালাঘরের সামনে গ্রামের ধুলো উড়িয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে হাঁ করে চেয়ে থাকার মতো সুন্দর গাড়ি। অর্থ ,সম্মান তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আগামী ভবিষ্যতের দিকে। আমি তোমাকে বোঝাতে পারলাম ? বাদল মেঘ ?
হ্যাঁ স্যার ,বলুন । ও প্রান্তের গলা আবেগে থরথর করে কাঁপছে।
অমলেন্দুকেও যেন কথার নেশাতে পেয়েছে–প্রিয় বাদল মেঘ , এই তরুণ ফুটবলার যদি ঘন্টার পর ঘন্টা প্র্যাকটিস না করে ফুটবল কর্মকর্তাদের বাড়িতে গিয়ে বলতো — আমি দারুণ ফুটবলার ,আপনারা আমাকে আপনাদের দলে নেবেন ? তাহলে ঘটনাটা কেমন হত ? শুধু অপমান আর তাচ্ছিল্যই জুটতো তার কপালে। ব্রাজিলের পেলে থেকে বাঁকুড়া পুরুলিয়া জেলার একজন তরুণ পর্যন্ত আগে ফুটবল খেলাটাকে ভালোবেসেছে , তারপর প্রকৃতি তাকে সবুজ মাঠের রাজা করে দিয়েছে। তোমার লজ্জা করে না ? তিথির মতো একজন মানুষ ফুলের মালা নিয়ে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে , বিশ্বকবির পুরষ্কার কবিতার মতো কবিকে বরণ করার জন্য। আর তুমি কিনা !
আচ্ছা, তোমার মনে হলো না কেন ,দয়া আর অনুকম্পা দিয়ে দুদিন চলে, দুমাস চলে না। জীবন তো দূরের কথা। মেধা যতই থাকুক ,পরিশ্রমী হও বাদল মেঘ । মেধা আর পরিশ্রম একসঙ্গে যদি কলমের ডগা দিয়ে বেরোয় , তখনই সে সত্যিকারের কবি হয়ে উঠবে । সাদামাটা পিঠ চাপড়ানিকে প্রকৃত সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাও। তিথিকে যেন দেখতে না হয় , কেউ তোমাকে তাচ্ছিল্য করছে।জীবনে অন্তত একজনের কাছে সম্রাট‌ হয়ে ওঠো কবি।
— স্যার,মনে রাখবো আপনার কথা। তিথিকেও বলবো ।
আচ্ছা , একটা কথা , আমার শব্দভাণ্ডার কিভাবে বাড়াবো ? অমলেন্দু এবার সত্যিকারের পিতা , অভিভাবক হয়ে উঠলো — শোনো, একটা পুরোনো বড় ডাইরিকে নিজস্ব ডিকশেনারি করে তোলো। অ্যালফাবেট অনুযায়ী নতুন নতুন শব্দ দিয়ে সাজাও। লেখার সময় পাশে থাক সেই ডাইরি। নিজস্ব শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলো কবি। কোনো কাজ খুব সহজে হয় না। কঠোর পরিশ্রম লাগে তার জন্য । আরেকটা কথা মনে রেখো , কবিতায় অন্তমিলের ঝোঁক কিছুটা নেশার মতো , তাকে সংযত করো । গদ্য কবিতার উন্মুক্ত প্রান্তরও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।কী হল ? চুপ করে আছো কেন ?
ও প্রান্তের নিঃশব্দ কান্নার মধ্যে দিয়ে ফোনালাপ শেষ হলো ।
কিছুটা সময় ভূতের মতো চুপ করে বসে থাকলো অমলেন্দু । ধিক্কার দিলো নিজেকে । কী দরকার ছিল এত কড়া কথা বলার ? আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি ?
ছেলেটা এই কড়া কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দেবে না তো ? বুড়ো বয়সে এসে একজন তরুণ কবিকে কাঁদানোর কী দরকার ছিল ? হাতের সামনে প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ে রয়েছে।কবিতার অমলেন্দু,কবিমনের অমলেন্দু এখন নিজেই যেন বিষণ্ণতার বিবিক্ত প্রহর । সে ভাবছে , কবিজন্মের এই ঠিকানাটাকে শক্তপোক্ত ভিতের ওপর গাঁথতে হবে । সে বড় ধৈর্যের কাজ । শ্রেষ্ঠ কবিতার পাতা ওল্টাতে “জং” কবিতায় ওর চোখ আটকে গেল । আহা ! এই কবিতাও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ , নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্রের কন্ঠে তা অমর হয়ে রয়েছে‌। সার্থক যুগলবন্দী।যেমন কবিতা, তেমনই বলা।হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশ থেকে উঠে আসা আবৃত্তি।বাদল মেঘকে তো তিথির জন্য এমন কোনো কবিতাই লিখতে হবে। সারাদিন এত ফোনাফুনি করলে সেই একাগ্রতা তো আকাশ থেকে পড়বে না।
না , অমলেন্দুকে দেখতে হলো না। বইটা আলতো করে বন্ধ করে , হিমালয়ের মতো একাগ্রতায় বিড়বিড় করে বলে গেলো —
হাওয়া বয় সনসন
তারারা কাঁপে।
হৃদয়ে কি জং ধরে
পুরানো খাপে !
কার চুল এলোমেলো ,
কিবা তাতে এলো গেলো !
কার চোখে কত জল
কেবা তা মাপে ?

দিনগুলি কুড়োতে,
কত কী তো হারালো।
ব্যথা কই সে ফলার
বিঁধেছে যা ধারালো !

হাওয়া বয় সনসন
তারারা কাঁপে।
জেনে কিবা প্রয়োজন
অনেক দূরের বন
রাঙা হল কুসুমে ,না ,
বহ্নিতাপে ?
হৃদয় মরচে-ধরা
পুরানো খাপে !

মাথার চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে চুপ করে বসে থাকে অমলেন্দু । বাইরে হাওয়া ।কুসুমের ঋতু বসন্ত যেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা শুনতে শুনতে মুঠো মুঠো বাতাসের স্পর্ধা পাঠিয়ে দিয়েছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অমলেন্দুর আগাপাশতলা জীবন । পাগল মন ক্রমশ উন্মাদ হয়ে একটা ফোন নম্বরকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। এক্ষুনি সেই কবিতার নারীকে ফোন করতে হবে ,যার নাম উন্মনা । ওকে জানাতে হবে– ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’, আসলে‌ কুঁড়ি থেকে পলাশের ফুটে ওঠার গল্প ! ও কবি ,ও প্রেমেন্দ্র মিত্র , আমাদের এই বাঁকুড়া , পুরুলিয়ার দূরের- কাছের বন-জঙ্গল ,পাহাড় — যে কুসুমের আগুনে লাল হয়ে উঠেছে ,তার নাম পলাশ ,পলাশ,পলাশ….
প্রিয় কবি , আপনি শুনতে পাচ্ছেন ? কবি বাদল মেঘ যেমন তার কবিতার নারীর গল্প শুনিয়েছে আমাকে‌, আমি এখন , এই মুহূর্তে আমার কবিতার নারীর গল্প শোনাতে চাই আপনাকে । বহুযুগের ওপার থেকে , আপনি আমাদের কথাগুলো শুনতে পাবেন তো প্রিয় কবি ?
এই দেখুন আমার হাতের মুঠোর মধ্যে আধুনিক ফোন।আমি এখন সেই ফোনে উন্মনাকে কবিজন্মের গল্প শোনাবো। আপনিও‌ সেই গল্প শুনবেন তো ?

হ্যালো,হ্যালো…উন্মনা ,ফোনটা বেজে যাচ্ছে , প্লিজ ধরো।আপনির আড়াল ভেঙে আমি সত্যিকারের তুমি হয়ে এসে দাঁড়িয়েছি । তুমি ফোনটা ধরো প্লিইইইইজ….

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।