আর ভালো নেই ছোট্টবেলার স্কুলে ,
সোদাঁগন্ধের নরম কবিতা শোনা;
ভালো নেই, তাই দরজার তালা খুলে ,
মনে রাখব না, কিছু মনে রাখবো না।
শ্রীচরনেষু দিদি ও দাদা,
আমি জানি ,আমার মত তোরাও ভালো নেই ।ভালো নেই বাবা আর আমাদের ছোট্ট বাড়িটা। ভাড়াবাড়ি , তবুও খুব সুন্দর নির্জন নির্জন একটা ভাব আছে ।পাশে এক টুকরো ব্যাডমিন্টন কোর্টের মত জমি । ওটাও যেন আমাদেরই সম্পত্তি ; যেখানে বাবা সারা শীতকাল আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার বন্দোবস্ত করে । কত ভালো ভালো খেলোয়াড় খেলতে আসে। আমার বাবাও তো ফুটবলের বাইরে ইনডোর গেম চ্যাম্পিয়ন। কত রকম খেলা যে বাবা খেলতে পারে ! ব্যাডমিন্টন-তাস-দাবা-ক্যারম, সব খেলাতেই চ্যাম্পিয়ন।ব্যাডমিন্টনে কলকাতা চ্যাম্পিয়নশিপেও লড়ে যেত।তাস বা দাবাতেও তাই ।তোর মনে আছে দিদি ? দাদাকে বাবা কন্ট্রাক্টব্রীজ আর পেসেন্স খেলা কেমন ভাবে শিখিয়েছে ? খুব শক্ত খেলা । আর আমরা তো খেলি অকশনব্রিজ, টোয়েন্টি নাইন আর ব্রে। তুই আবার রংমিলান্তি খেলতে খুব ভালোবাসিস। এই সবকিছুর মধ্যেই এখন আর মা নেই । কোনোকিছুর মধ্যেই নেই রে দিদি। এক মাস হয়ে গেল, আমি আর মা মামার বাড়িতে পড়ে আছি ।এখান থেকে বন্দেলগেটের কাছে সরকারি মানসিক হাসপাতালে মাকে নিয়ে যেতে সুবিধে হয় । সঙ্গে থাকি আমি আর সেজো মামা, আর সামনে বসে বাবা। তারপর আবার দেখানো হয়ে গেলে এভাবেই ফিরে আসি মামার বাড়িতে। মা কিন্তু ট্যাক্সির মধ্যে কোনরকম চেঁচামেচি করে না। শুধু আমার হাতটা আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। আর আমি কি বলবো ! শুধু মাকে বলি , মা তুমি গান গাইবে কবে ? কবে আমরা বাড়ি যাবো ? সারা সপ্তাহের মধ্যে একদিন বাবার সঙ্গে দেখা হয় আমার । মামার বাড়িতে মা থম মেরে চুপচাপ বসে থাকে। দাদুর শূন্য খাটটার চারিদিকে কিছু যেন খোঁজে। দাদুর ফেলে যাওয়া জিনিসগুলো, আর দেওয়ালের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটার দিকে কেমন শূন্য দৃষ্টি মেলে বলে — ঝন্টু শোন, এটা কি মাস রে ? এখানে রয়েছি কেন ? ডাক্তার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করবে কেন ?
আসলে জানিস তো দিদি, ওই মানসিক হাসপাতালে জায়গা পাওয়া খুব কঠিন। ভাগ্যিস বাবা খোদ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে চাকরি করে ,তাই চেষ্টা করে যাচ্ছে । একদিন বড়ো আর মেজোমামার সঙ্গে বাবার কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। মাকে নাকি ইলেকট্রিক শক দেয়া হবে। সে না কি সাংঘাতিক কষ্টকর একটা অভিজ্ঞতা ! অনেক সময় মানুষ মারাও যেতে পারে ! জানিস দিদি, এখানে আমার আরেকটাও কাজ আছে। সময় মেপে মেপে আমি ,ছোটমামা আর ছোটমাসি মাকে নানারকম ওষুধ খাওয়াই। আর, ওষুধ খাওয়ার পরেই মা কেমন গুম মেরে বিছানায় শুয়ে থাকে । মণিমামা অনেক চেষ্টা করেছে মাকে নিয়ে গানে বসাতে। কিন্তু মা দু-চার লাইন গেয়ে চুপ করে যায় ! কেমন শূন্যের দিকে তাকিয়ে বলে — এই মণি শোন,– শিখা ,বিলু– ওরা ভালো আছে ? শিখা ইস্কুল ছেড়ে দেয় নি তো ? বিলুকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বার করে দেয়নি তো ? ঝন্টুর কি পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল ? জানিস দিদি, আমি কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি ঘন্টা পড়াশোনা করি। স্কুলে কি পড়ানো হচ্ছে ,আমিতো কিছুই জানিনা । হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা বোধহয় দেওয়া হবে না। কানু, বংশী, দেবু শ্যামল, চন্দন… ওরা কেউ আমার খোঁজ করতে আসে ? আমার ফুটবল মাঠের কোচ কমলদা ? আমাদের স্কুলের বন্ধুরা ? আমাদের স্যারেরা ? কেউ এসে খোঁজ নেয় ? একটা ছেলে কেন এক মাস স্কুলে আসছে না ? তুই আমাকে সত্যি কথা বলিস কিন্তু দিদি।চিঠিতে কোন কিছু লুকোবি না । আমাদের পাড়ার লোকেরা এখনও কি আঙুল দেখিয়ে আমাদের বাড়িটাকে নিয়ে আলোচনা করে ? তোকে তোর স্কুলে কোন যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় ? বাবার মুখে শুনলাম, তুই নাকি দারুণ রান্না করা শিখে গেছিস ? তাহলে পড়াশোনা করিস কখন ? আর তোর নাচের ক্লাসে যাস? জানিস দিদি,আমাদের স্কুলের পুরনো বিল্ডিং-এ না, বেশ কয়েকটা তালাবন্ধ ঘর আছে । ওখানে এখন আর ক্লাস করবার দরকার হয়না। কিন্তু বড় তালাটা ধরে ঠেললেই বিশাল দরজাগুলো ফাঁক হয়ে যায়। আর ভেতরে চোখ রাখলেই অন্ধকারে চোখ সেট গেলে দেখি ,কত কী আসবাবপত্র সাজানো রয়েছে ! সবই পুরনো আর ভাঙা । কিন্তু আমার নাকে আসে অদ্ভুত একটা গন্ধ। ওই যে বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টি এলে, মানে কালবৈশাখী ঝড়ের পরে প্রথম বৃষ্টি মাটিতে মিশে গিয়ে, যে গন্ধটাকে টেনে বার করে আনে ,মা বলতো পৃথিবীর গন্ধ –সেই গন্ধটাই পাই আমি ,ওই বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে। কে যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে । বলে– এখানে সব কবিতারা আছে। যারা লিখেছিল, এখন তারা আর কেউ বেঁচে নেই। সবাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। আর, বেঁচে থাকলেও অনেক বয়স হয়ে গেছে । তাঁদের লেখা কবিতাগুলো, প্রাইমারি সেকশনের কাঁচা হাতের লেখা কবিতারা ওখানেই ঘুমিয়ে আছে। বেঞ্চিতে নিজের নাম লেখা– সবকিছু এখানে আছে আমি জানি । ওই তালাটা তো কেউ খুলবে না, আর, খুললেও আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবেনা। তাই চুপচাপ নিজের ক্লাসে ফিরে যাই । এখন তো সেটাও বন্ধ ।ক্লাস সিক্সের পড়াশোনা কত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাকে এই অবস্থায় পরীক্ষায় বসতে হলে সব বিষয়ে শূন্য ছাড়া কিছুই পাবোনা । পড়াশোনা আমার আর হবে না রে দিদি। কারণ, মাকে ছেড়ে তো আমিও যেতে পারব না ,আর মা-ও আমাকে ছাড়বে না। জানিস , এর মধ্যে একদিন বিকেলে আমি চেতলা পার্কে খেলতে গেছি , সঙ্গে পাড়ার বাবলা , চার্চিল আরও বেশ কয়েকজন ছিল। খেলা সেরে গলির ভিতর দিয়ে মামার বাড়ির সামনে দেখি, সারা পাড়ার লোকেদের জটলা। মা নাকি আমাকে দেখতে না পেয়ে, চিৎকার করে বলে উঠেছিল — ঝন্টুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমাকে যেতে হবে ।সদর দরজাটা খোলা ছিল। সেজমামা ঘুমিয়ে পড়েছিল, ফ্যাক্টরি থেকে এসে। মা কখন বেরিয়ে গেছে , কেউ জানেনা। ছোটমামা হঠাৎ চিৎকার করে উঠে বলেছিল –বড়দি বাড়িতে নেইরে সেজদা ।সঙ্গে সঙ্গে ওরা দৌড়ালো মা-র খোঁজে ।আমি যেন প্রায় জ্ঞান হারিয়ে বসে পড়লাম গলির মধ্যে। ছোটমাসি হাউ হাউ করে কাঁদছে । আর বাবলা চার্চিল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে–কিচ্ছু হবে না, তোর মা এক্ষুনি ফিরে আসবে। সন্ধে যখন ঘন হয়ে গেছে, ভিড়ও পাতলা হয়ে গেছে ,হঠাৎ দেখি ছোটমামা আর সেজোমামার কাঁধে দুটো অসহায় হাত বিছিয়ে দিয়ে, কোনরকমে হাঁটতে-হাঁটতে গলির মধ্য দিয়ে মা আসছে । বাড়িতে ঢোকার সময় আমাকে দেখেও চিনতে পারল না । সেইদিন রাত্রিবেলায় মেজোমামার নেতৃত্বে চার মামা বসলো মিটিং করতে। বড়মামা পি এন্ড টি র কর্মী, কৃষ্ণনগরের পোস্টিং ।সপ্তাহের শেষে আসে আবার সোমবার খুব ভোরে বেরিয়ে যায়। দাদু ভাইয়ের মৃত্যুর পরে, মামার বাড়ির আসল চালিকাশক্তি মেজমামা। বড়মামার অনুপস্থিতিতে বাকি তিন ভাই মেজোমামা যা বলে, সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ।কারণ, ছোটমাসির বিয়ে তখনও বাকি ; ছোটমাসি যাতে কোন সময় মনে না করে মাথার উপরে কোন আশ্রয় আর নেই। পাঁচটা ভাই কি আশ্চর্য ভাবে ছোটমাসিকে আগলে রাখে ! আর বড়দিকে এই করুণ অবস্থায় তারা দেখবে বলে কোনদিনও আশা করেনি। তবু দেখতে হচ্ছে ।ফোন নেই যে , বাবাকে ডেকে আনবে ।পরের দিনই ছোটমামা ছুটল রাইটার্সে ।বাবা বিকেল বেলায় এলো। একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহেই বন্দেল গেটের কাছে লুম্বিনি পার্ক মেন্টাল হসপিটালে আমার মাকে ভর্তি করা হবে। দিদি, আমার মা কি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেল ? আমাদের বাড়িটা কি চিহ্নিত হয়ে গেল পাগলের বাড়ি বলে ?
আমার জন্য ভাবিস না ।আমি নিজের জামাকাপড় সব নিজে কাচতে শিখে গেছি। হ্যাঁ, পড়াশোনাটাও ঠিকমতো করি । আমার ওপর সব মামার কড়া নজর। সবথেকে কড়া বোধহয় মণিমামা। পান থেকে চুণ খসতে দেয় না । কঠিন শব্দ বলে না কিছু। শুধু বলে– ঝন্টু, যার তার সাথে মিশবি না কিন্তু । এখানে বড় বড় রাস্তায় অনেক গাড়ি। খুব সাবধানে থাকবি । আমাদের না বলে বাড়ি থেকে বেরোবি না ।
এই চিঠিটা বাবার পকেট গুঁজে দিলাম। রেখে দিস। আর তোর কিছু বলার থাকলে আমাকে একটা চিঠি লিখে বাবার হাত দিয়ে পাঠাস ।আমি আর যাই ছেড়ে দিই না কেন , ফুটবল খেলাটা কিন্তু ছাড়িনি ।তুই কিছু ভাবিস না । বাবলা, চার্চিলরা আমাকে খুব ভালোবাসে। ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে নিয়ে যায়। বাবলা আমার লোকাল গার্জিয়ান ।এ বাড়ির সবাই ওকে খুব পছন্দ করে। খুব ভালো থাকিস দিদি ।
ইতি ঝন্টু।