অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ২৭)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

অনেক কথার শেষে কথা থেকে যায়,
প্রতীক্ষায় থাকা অপেক্ষাতে
নারী পুরুষের সেই অন্তহীনতায়,
কুঁড়িগুলো ফুল হয় আগামী প্রভাতে।

সেদিন রাতের কনফারেন্স কলে ঘন্টা খানে আহকের একটি প্রহর কেটে গেলো ,‌অনেক মান অভিমান,স্বপ্নভঙ্গ ও স্বপ্ন-প্রত্যাশার এলোমেলো চিত্রগুলো এক জায়গায় জড়ো করতে করতে । অমলেন্দু নিজেই যে তার স্বল্প‌ সঞ্চয় আঁকড়ে নিজের বসত বাড়িটুকুতেই কবিতার আঁচল গড়ে তুলবে , মাসমাইনের চাকরির দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে , কবিতার গভীরে ডুব দেবে — এটা বোঝাতে চেষ্টা করলো শুভ আর প্রলয়কে । মুশকিল হচ্ছে , অমলেন্দু যখন কথা বলে , তখন সবাই বড্ড বেশি চুপ করে শোনে। বাদ প্রতিবাদ, মত মতান্তর না হলে ভালো কিছু গড়ে ওঠে না –এটা তো সবাই জানে । তবু ওরা চুপ করে থাকে। প্রলয় ওকে প্রায়ই বলে — আপনার কথাগুলোই তো কবিতা । তাই চুপ করে শুনি। উন্মনা আজ একটু অন্যমনস্ক ছিল বলে মনে হল। কয়েকটা কথার সঙ্গে শুধু বললো — সামনের সপ্তাহে গোপগড়ের মিটিংএ, স্যার যদি অনুমতি দেন , তাহলে কিছু কথা বলবো।আজ আমি চুপ করেই শুনছি। আজকের কথাবার্তার পর , ঠিক আটদিনের মাথায় ওদের চারজনের একসঙ্গে গোপগড়ে বসার বিষয়টা চুড়ান্ত হয়ে গেলো । তবে চুপ করে থাকলেও , কথাগুলো যে প্রলয় শুভকে বেশ খানিকটা অক্সিজেন যোগালো , তাতে অমলেন্দুর সন্দেহ ছিলনা ।
ইদানিং ডাক্তার ওকে ডিনারের পর একটা স্ট্রেস রিলিফের ওষুধ দিয়েছেন । সেটা খেয়ে , টিভি অন করে রাতের নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখলো অমলেন্দু । গোটা দেশটাই যেন ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে‌ উঠছে। আচ্ছা , রাজনীতির প্রতি মানুষ কি ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ? বামপন্থার প্রতি অমলেন্দুর আশৈশব বিশ্বাসও যেন কোথাও একটু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। বামপন্থীদের মধ্যে তেমন সমবেত প্রতিবাদী আন্দোলন এখন কোথায় ? বামপন্থার নিজস্ব গতিবেগ একটু স্তিমিত হয়ে যেতে দেখে , অমলেন্দু নিজেও কি কোথাও কেঁপে ওঠে ? নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে কোথায় ? একটা দলে এত বয়স্ক মানুষের প্রাধান্য কেন ? আচমকা মনটা অন্ধকার হয়ে গেল । কবি ও কবিতা নিয়ে ওদের এই পরিকল্পনা সার্থক হবে তো ? রাজনীতির পাশাপাশি মানুষের জীবনকে কবিতায়‌ , গানে , নৃত্যে চিত্রকলায় ভরিয়ে দিতে হবে যে ! নয়ত শতফুল বিকশিত হবে কী ভাবে ? হয়তো , অনেকদিন আগে , ঠিক এই কারণেই সলিল চৌধুরী হৃদয় উজাড় করে লিখেছিলেন —
ও আলোর পথযাত্রী ,এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না….
ক্লান্ত হাতে টিভি অফ করে খোলা জানালার সামনে দাঁড়ায় অমলেন্দু । নিজস্ব বেদনা ছুঁয়ে গেয়ে উঠলো —
আর কতদূর ওই মোহানা
এ যে কুয়াশা , এ যে ছলনা
এই বঞ্চনার দ্বীপ পার হলেই পাবে
জনসমুদ্রের ঠিকানা….
গানটার শেষের দিকে ওর গলা ধরে আসছিলো —
হে মহাকাল , হে ইতিহাস , আমরা যেন সলিল চৌধুরী হেমাঙ্গ বিশ্বাস , দেবব্রত বিশ্বাসদের কখনও ভুলে না যাই । তাহলে তো বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে !হঠাৎ স্ক্রিনে উন্মনার নাম ভাসিয়ে চেনা রিং টোন বেজে উঠতেই , এক মুহূর্তে অমলেন্দুর ক্লান্তি উধাও হয়ে গেলো …
ও প্রান্ত থেকে মৃদু অভিমান–
সব কথা ওদের দুজনের সঙ্গেই তো বললে । আমাকে আলাদা করে কিছু বললে না তো ! এমন পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক আক্রমণে অমলেন্দু কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে গেল । কোনোরকমে বললো–
তুমিও তো চুপ করেই ছিলে !
— বেশ করেছি চুপ করে ছিলাম ! আমি দুচোখের আলো জ্বেলে , শুধু গলার আওয়াজ শুনেই , আমার শব্দভদী তুলিতে আঁকছিলাম একটা মুখ ।‌ কার মুখ সেটা বলবো না ,বুঝে নিতে হবে ।
অমলেন্দু রোমাঞ্চিত হলেও , অনিবার্য ক্লান্তির হাই তোলা কিছুতেই চাপতে পারলো না‌ ।ও প্রান্তে উৎকণ্ঠায় উন্মনা বললো — তোমার বোধহয় ঘুম পেয়েছে , তাই না ? ফোনটা রেখে দিই ? কাল কথা বলবো। অমলেন্দু একটু অস্থির হলো — ঠিক আছে , মানলাম আমার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু, আমি তো তোমার ফোনের জন্যেই অপেক্ষা করে বসে ছিলাম ‌।
— কেন ?
অমলেন্দুর সত্যিই টায়ার্ড লাগছিলো । তবুও কোনোরকমে বললো– গোপগড়ে আমাদের মিটিংএর আগে , চিল্কিগড়ে আমরা দুজন একবার যেতে পারি না ? ও প্রান্তের উত্তর — অবশ্যই । আমি তো পথ চেয়ে আছি।
উন্মনার আগ্রহ আবার যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো। কবে ? আগামীকাল সকালে ?
অমলেন্দু আবার ঘাবড়ে গেলো। তা কি করে সম্ভব ?
উন্মনা এবার নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো — আমি জানি। ইচ্ছে করেই ঠাট্টা করছিলাম । কাজের অমলেন্দু , সাংবাদিক অমলেন্দুকে অনেক চেষ্টা করে পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলোকে জড়ো করতে হয়,আমি সেটা জানি ; কিন্তু আমার যে কবির অন্তরে কবিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে ! অমলেন্দু মৃদু হেসে বললো — পরশুদিন সকালে হতে পারে। আমি কাল পরশুর সব কাজ অ্যাডজাস্ট করে রাখবো । উন্মনা খুশির হিল্লোল তুলে বললো — আমি রাজি । খুব ভোরবেলা বেরোবো , তাহলে বাড়ি ফিরতে অসুবিধে হবে না। একটাই কন্ডিশন‌ , তুমি কিন্তু ঘড়ি দেখতে পারবে না । ডুলুং নদীর ওপারে সূর্যকে পাটে বসিয়ে তবেই ঘরে ফেরার রাস্তা ধরবো‌ । রাজি ?
অমলেন্দু চুপ করে শুধু ভাবতে চেষ্টা করছিলো — এমন ইচ্ছেডানা , এমন খুশি হওয়া , এমন স্বতঃস্ফূর্ত ঝর্ণার কলকল করে বয়ে যাওয়া , তার জীবনে এতদিন কোথায় ছিলো ? ও প্রান্ত থেকে উন্মনার হ্যালো শুনে চমক ভাঙলো।
ও কবিমন , তোমাকে একটা কথা বলি , নারী উন্মনাকে খুশি করতে কোনো কাজ তোমাকে করতে হবে না । পরশু না হলে , অন্য কোনো দিন যাবো । কিন্তু যাবো । তোমার সঙ্গেই যাবো ।
আবেগ সামলে অমলেন্দু শুধু বলতে পারলো– পরশুদিন সকালেই যাবো। আমি আসলে অন্য কথা ভাবছিলাম। ঘুমোবার আগে তোমার গলায় কবিতার লাইন শুনবো না ? তুমি নতুন কিছু লেখোনি ?
— না। এই দুদিন লিখতে পারিনি । সব ভাবনাগুলো জড়ো হয়ে শুধু তোমার মুখটাই দেখছি । তুমি বরং শোনাও কোনো চিরদিনের কবিতা ।
কিছুক্ষণ আগে , খোলা জানালার ধারে সলিল চৌধুরীর গানে ডুবে থাকা অমলেন্দু , কী জানি , কোন গহন গভীরতা থেকে আবৃত্তি করলো —
যেন এক আকাশ বিশ্বাসের কবিতা —
.………..…….
………………..
দিগন্তে কারা আমাদের সাড়া পেয়ে
সাতটি রঙের
ঘোড়ায় চাপায় জিন ।
তুমি আলো, আমি আঁধারের আল বেয়ে
আনতে চলেছি
লাল টুকটুকে দিন‌ ।

উন্মনার আবেগ ও বিস্ময় থেকে ফিসফিস করে প্রবাহিত হলো দুটো মাত্র কথা —

সুভাষ মুখোপাধ্যায়
লাল টুকটুকে দিন।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।