আজকের লেখায় অমিতাভ ভৌমিক

বর্ষা, ভারচ্যুয়াল প্রেম আর রথের গল্প

বর্ষা মানেই চোখ জুড়ানো হাল্কা আর গাঢ় সবুজের কোলাজ।
মন কেমনকরা মায়াময় মামলায়, কালো আকাশ ছিঁচকাদুনী মেয়ের মতো যখন তখন কাঁদতে পারে। সূর্যদেব গোঁসাঘরে কুলুপ আঁটলেও সুযোগ পেলেই মেঘের সাথে লুকোচুরি, আলতো করে রামধনু রঙে মুচকি হাসে আকাশ জুড়ে।
ঋতুরানীর দূত জলধর  – মেঘাগমপ্রিয় কবির গানে চিরঞ্জীবী। কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, বাদল দিনে রূপে, গুণে নীরদের জুড়ি মেলা ভার।
গোলাপের মতো বহুল প্রচারিত ও সমাদৃত না হয়েও “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” কিন্তু আজো মনে প্রেমের ছোঁয়া এনে দেয়। মন কে ভাবায় “এমন দিনে তারে বলা যায়…”।
রূপময়ী বর্ষায় ভালোবাসা যেন এক ছোঁয়াচে রোগ।  সাধারণ মানব, মানবী কোন ছাড়, ক্যাসানোভা কৃষ্ণ পর্যন্ত রাধার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে। সেই সুরভিত কদম বৃক্ষের তলায় মন‌কাড়া বাঁশির সুরে প্রেম, বিরহ, ফস্টিনস্টি, লীলাখেলা থেকে বিচ্ছেদ…বৈষ্ণবসাহিত্য খুঁজলে ভাবরসে টই টম্বুর এমন মনোহর কাহানিয়া আরো জানা যাবে। চিরকাল মেঘলা দিনে মানুষের মন আকুলিবিকুলি করে গাইতে থাকে, এ ভরা বাদর মাহ ভাদর… শূন্য মন্দির মোর।
প্রেমেরও ইহকাল পরকাল আছে। স্বকীয়া,পরকীয়াও তো সেই আদিকাল থেকেই আছে। প্রেম এখন ফাস্ট ট্র্যাকে। ইয়ং পেপসি জেনারেশন, এমন কি অ্যডাল্টস্, সবারই মন্ত্র হচ্ছে- ওহ্ , ইয়েস্, আভী !
কিন্তু বাদ সেধেছে করোনা। সময়টা ঠিক প্রেমোপযোগী নয়।  রিম্ ঝিম্ বৃষ্টিতে ভিক্টোরিয়ায় ছাতার আড়ালে, গড়ের মাঠে বা গঙ্গার পাড়ে কোমরে বা কাঁধে হাত জড়িয়ে গল্পগানে পথচলা…এখন ভাবা মুস্কিল।
কার নিঃশ্বাসে ভাইরাস লুকিয়ে কে জানে?  সামান্য বাহুডোরে ধরা দিয়ে চুমু খেতেও চাই হাতেগরম “আর টি পি সি আর ” রিপোর্ট, তাও আবার- সীমিত সময়  গ্ৰাহ্য।
ভ্যাকসীন দুটো ডোজ নেয়া তো?
নিলেও ফেক নয় তো?
প্রশ্ন অনেক।
কফি শপে, বড় কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে অস্পষ্ট হয়ে যায় ভালোবাসা।
ঠান্ডা হয়ে আসা কাপে শেষ চুমুক ইতি টানে একটা অধ্যায়ের, দুজনেই এক সুরে, “নারে ঠিক জমছে না আমাদের!”
ভাগ্যিস মাস্ক গুলো ছিল। মুখ ঢেকে, দুজন দুই পথে।
এখন অনেক তৃপ্তিহীন, বহুগামী শরীর আর মন,  আপাত ঝুঁকিহীন ভারচ্যুয়ালে মজে। স্ন্যাপ্ চ্যাট এর মতো অ্যাণ্ড্রয়েড অ্যপ আর মোবাইল ক্যামেরার দৌলতে, তথাকথিত প্রেমিক প্রেমিকাদের পোয়াবারো। চাইলেই বাথরুমের শাওয়ারে “টিপ টিপ্ বরসা পানি, পানি নে আগ লাগাই…”  চানঘরে গান – একেবারে লাইভ ইন কালার, যেমন খুশী তেমন।
তবে আজকাল বিশ্বাস মহার্ঘ্য। চাহিদায় ডুবে থাকা মন, নিম্নগামী। ভবিষ্যতে খেসারত দিতে হতেই পারে।
উৎসব পার্বণ ছাড়া তো সব ঋতুই অসম্পূর্ণ। এই সময়েই ঠুঁটো অবতার চান টান করে, সর্দি জ্বর কোয়ারেনটাইন্ ইত্যাদী সেরে দাদা আর বোন কে নিয়ে মনসুন হলিডে সেরে আসেন, সাজুগুজু করে ঘটা করে রথে চড়ে। সোজা থেকে উল্টো রথের দড়িতে ” জয় জগন্নাথ” বলে টান পড়লেই, ব্যবসা।
এই উপলক্ষে, ছুটি ছুটি মেজাজে আমরাও একটু মেতে উঠি। পোস্ট আর মেসেজে ছয়লাপ  স্যোশাল প্ল্যাটফর্ম আর মিডিয়া ও। অকাতরে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইভ সংগে মুখরোচক ট্রিভিয়া। আধুনিক যুগে ও চলছে রথদেখার সংগে মেলায় চুড়ি কেনা, পাঁপড় খাওয়া ও কলা বেচা।
এখন  বৃষ্টিভেজা রথের ভাঙ্গা হাটে, দরিদ্র রাধারানীর বনফুলের মালা শুকিয়ে গেলেও চিন্তা নেই ; সহৃদয় রুক্মিণীকুমারের মত অ্যমাজন বা ফ্লীপকার্ট  ঠিক সব কিনে নেবে বা বিক্রি করে দেবে।
আজ ও মেলায় নিয়ম করে লোকজন হারিয়ে যায়, অনেক বছর পর ” বিছ্ড়ীহুয়ে এক ভাই ” অপর ভাইকে খুঁজে পায়, যেমন সিনেমায় দেখা যায়, তবে এক্ষেত্রে,অবদান কিন্তু কোনো না কোনো টিভি নিউজচ্যানেলের  কনটেন্ট এডিটরের। আর মেলা যদি কারো অনুপ্রেরণায়  অর্গানাইজ্ড হয়, ফাঁক তালে তিনি ও একটু ফুটেজ ভাগ করে নেন।
বর্ষার মেলায় নাগরদোলার
ওঠানামাতেই গল্পগুলো ডানা মেলে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।