রোজকার গল্পে প্রজ্ঞাপারমিতা ভট্টাচার্য

শেখার রকমফের 

“In recalling my childhood I like to picture myself as a beehive to which various simple obscure people brought the honey of their knowledge and thoughts on life, generously enriching my character with their own experience. Often this honey was dirty and bitter, but every scrap of knowledge was honey all the same. “—-Maxim Gorky, *My Childhood *…..
সকালে উঠতে বেশ দেরী হলো । রাত জাগা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে।
দোতলা থেকে নীচে নেমে দেখলাম চা তৈরি। বহুদিন বাদে মুখের সামনে চায়ের কাপ।
বেশ লাগছে। আসলে প্রাত্যহিকতা তো এমন বলে না। কিন্তু কাপে যতটা চা আমি খাই তার থেকে বেশ কম।
সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা চা-বিলাসী ঘরানায় বড় হয়েছি। আবার একটু বাড়িয়ে নিয়ে টেবিলে এলাম।… বাঃ দারুণ ফ্লেভার এসেছে….।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি…. না না মুলক রাজ আনন্দের সেই বিখ্যাত লেখার আলোচনা করছি না। বেশ ছোটবেলায় চা প্রসঙ্গে বাবা বা কাকার মুখ থেকে শোনা। ঐ অংশটুকুই চা পাতা। বাগান জ্যোৎস্নায় পাতায় জমে সৌরভ। খুব পেলব অঙ্গুলি স্পর্শে তুলে ফেলতে হয় পাতা। তাই ঐ কাজ মূলতঃ করে মহিলা ও শিশুরা।
চা গাছ ঝোপ জাতীয়। আমাদের দেশের দার্জিলিং এর চা বিশ্ববন্দিত। সবথেকে বেশী রপ্তানী হয় রাশিয়ায়। একটি বালিকা পরিবারের ভিতরে অপ্রত্যক্ষ পাঠ নিয়ে নিচ্ছে। তারপর সেই মেয়ে একদিন বাবার আর মায়ের হাত ধরে কোন এক রেলস্টেশন এর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো।রেল কোম্পানির চা এর স্টলে বড় বড় করে লেখা “দুধবিহীন লাল চা পান করুন ম্যালেরিয়াকে দূরে রাখুন “—–ও তাই বুঝি! শেখা হলো।
কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবান এসেছে দোকান থেকে। নীল প্লাস্টিকের প্যাকেটের জলরাশি ঢেউ ফেনা। নাম ‘সার্ফ’….এর মানে কী মা?… সমুদ্রের জলের ফেনাকে বলে সার্ফ… আর এই গুঁড়ো সাবানে ঐরকম ফেনা হবে… জানোতো এই নামকরণের কাজটি করেন কোম্পানির একজন দক্ষ কর্মী। বেশ মজা লাগে। দোকানের তাকে রয়েছে গায়ে মাখার সাবান ‘লাক্স’…. মা ওটা মানে কী সুগন্ধ?… না না। ওটা উজ্জ্বলতার একক।…ঐ সাবান মাখলেই উজ্জ্বল ত্বক। এইভাবে শেখা হলো।
সুন্দর ক্যালেন্ডার বছর শুরুতে দেওয়ালে টাঙানো হলো। পাতায় পাতায় হরেক খেলার ছবি। প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা এশিয়াড । বিকেলবেলা ভাই বোনেদের আনন্দ ধরে না। প্রিয় কাকু এসেছে। মা
বিশেষ খাবার বানিয়েছেন। পরোটা লিভারকারি মামালেড। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কাকু বললেন চমৎকার। তারপর ফস করে জিগেস করলেন…. আচ্ছা এশিয়ান গেমস না লিখে এশিয়াড কেন? জানা হলো ওটা নিজেই নাউন। এশিয়ান গেমস এ এশিয়ান এডজেক্টিভ হিসেবে আছে। গেমস এই নাউনকে কোয়ালিফাই করছে। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে শেখা হলো।
এ তো গেল একটু স্বচ্ছল সচেতন পরিবেশে অপ্রত্যক্ষ শিখে নেওয়ার উপায়। যেখানে এমনটি পাওয়া গেলনা সেখানে কী কিছুই পাওয়ার নেই? আছে সেখানেও আছে। ভাতের হাঁড়ি স্টোভে চাপিয়ে কলতলায় বাসন মাজতে যাওয়ার আগে মা বলে গেলেন …উথলোলে হাঁড়ির ঢাকা সরাস…. লাফিয়ে লাফিয়ে নীচের জল ওপরে আসছে। আর বাষ্প হু হু করে হাঁড়ি থেকে বেড়িয়ে চলে যাচ্ছে। দেখে নিলো। কিছু এপাশ ওপাশ শেখাও হলো।
হঠাৎ করে হুরমুডিয়ে ঝড় এলো। গ্রীষ্মকাল বিকেল থেকেই একটু দমবন্ধ গরম। কিন্তু এক জোরে ঝড়! ছোট্ট ঘর। দুটো জানলা। ঐ জানলা ঘেঁসেই চৌকি। আর চৌকির ওপর নীচ নিয়েই ছয়জনের সংসার। নানী মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে জানলা লাগাতে বলে। ছোট হাতে টানছে পাল্লা ।পুরো আসছে কই? মা ঢুকলে ঘরে….. আরে সোনু পাল্লার সামনে ধরে টানলে আসে? দূরটা ধরে টান দিতে হয়। তবে না কব্জা ঘুরে পাল্লা টেনে আনবে। বিজ্ঞান তো আছেই আশপাশ জুড়ে। একটু শেখা হলো।
এখন রোজই দুপুরের দিকে রান্নাঘরের সামনেটা দাঁড়িয়ে তেঁতুল মাখা খাওয়া হয়। বীজগুলো মুখ থেকে উড়ে গিয়ে পড়েছে সামনে রাখা দলা করা মাটিতে। কদিন বাদে ছুট্টে গিয়ে দেখে বীজগুলো কেমন আপনা থেকে দু’ভাগ। ভেতর থেকে সরু সুতোর মতো বেরিয়ে আসা শুঁড়। নমিতাদির জীবনবিজ্ঞান ক্লাসে এটাই তো পড়ছিলাম হঠাৎ ছুটির আগে। কী যেন বলে……অঙ্কুরোদ্গম….. আরে এটাই তো প্রজেক্টের কাজ। বইয়ের পাতায় শেখা জিনিষের চোখের ওপর দেখার অবকাশ। হলো তো দেখা আর তার পাশাপাশি শেখা।
কী এক নিদারুণ দুঃসময়। স্কুল পড়ুয়া শিশুটি নিত্যদিনের কথাবার্তা থেকে, ঘরবন্দী সময় থেকে ,পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষগুলির বেরোজগারির রোজনামচা থেকে পাঠ নেয় এক অসময় পরিচয়।সে বোঝে শারীরিক দূরত্ব, দুই থেকে তিন সেকেন্ডের হাত ধোওয়া ও নিতান্ত প্রয়জোনে বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করার গুরুত্ব। আর এগুলির মাঝে সে জেনে যায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পরার সরল সমীকরণ। এইভাবে সাময়িক লক ডাউনে অনলাইন ক্লাসের বাইরে তার অপ্রত্যক্ষ পাঠের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।
না নেই। ঘরে কম্পিউটার নেই, এ্যানড্রয়েড ফোন নেই। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার ই-বিদ্যা প্রনয়ন করেছে এবং বিদ্যালয়ে পরিকাঠামো প্রস্তুত। কিন্তু এন. এস. এস (ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে ) এর রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র চব্বিশ শতাংশ পরিবার এই টেকনোলজি ব্যবহারে সক্ষম। অধিকাংশ পারিবারিক পরিবেশ শিশুর পাঠ গ্রহণের উপযোগী না। অনলাইন অনুশীলনে সক্ষম না হয়ে উঠতে পারার গ্লানিবোধ শিশুর অবচেতনে জন্ম নেয়। সরকারের সব শুভ ইচ্ছা সত্বেও 2019-20 বাজেটে ই-শিক্ষা খাতে 604 কোটি অর্থ প্রদান 2020-21বাজেটে 469 কোটিতে এসে দাঁড়ায়।
অতিমারীর কালো ছায়ায় আচ্ছাদিত আকাশের ওপারেই আছে স্বাভাবিক দিনের শুভ সংকেত। এই সময়কালে যে শিশু দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী, আদর্শ পরিবেশ অনুযায়ী, অনলাইন ক্লাসে থাকতে পারলো ও পাঠ এগিয়ে নিতে সক্ষম হলো সেই শিশুদের অভিবাদন।
,পাশাপাশি যে বিরাট সংখ্যক শিশু বঞ্চিত হলো তাদের সম্পর্কে রাষ্ট্রের দ্রুত পরিকল্পনা জরুরী। তবে সেই শিশুরাও গ্রহণ করেছে এক অন্যপাঠ। অনলাইনের প্রথাগত পাঠের বাইরে জীবনের পাঠশালায় জীবনের পাঠ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।