এখন তো শুধু ছোট পাখিদের খড়কুটো নিয়ে ফেরা,
আকাশের নিচে একফোঁটা বনে যেমন ইচ্ছে নীড়ে;
সবার চোখের আড়ালে সবুজ শাল মহুয়ায় ঘেরা,
ছুটোছুটি করা কাঠবিড়ালির, গাছগাছালির ভিড়ে…
হেড স্যারের ছাড়পত্র পেয়ে স্কুলের বাইরে আসতেই দেখি,ডানপিটে স্পোর্টিং ক্লাবের বিখ্যাত কমলদা আধভাঙা সাইকেল নিয়ে রেডি স্টেডি গো…
আমাকে ক্যারিয়ারে চাপিয়ে সোজা মাঠের দিকে রওনা দিলো। আর যেতে যেতে কত জ্ঞান ! যেন কোচ নয়, বাড়ির বড় জ্যাঠা। আজকে ঠিকমতো বাথরুম করেছিস ? খেলতে খেলতে আবার পেয়ে যাবে নাতো ? আজ গোল না পেলে কিন্তু তোর ঠ্যাং ভেঙে দেবো আমি।মাঝে মাঝে খেলা থেকে হারিয়ে যাস কেন ফুটবল মাঠে ? অন্য কিছু ভাবিস ? না– আমি ব্যাজার মুখে বললাম ।সামনে অংক পরীক্ষা ,খারাপ রেজাল্ট হলে বাবা ফুটবল খেলার বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে । কমলদা বেঁটেখাটো শরীরটা নিয়ে প্রাণপণে প্যাডেল করতে করতে বলল — তোর বাবা নাকি নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় ছিল ? তুই ভালো খেলিস বলে এত দেমাক কেন তোর ?
আমি কী করে বোঝাবো, যে আজকে বৃহস্পতিবার। আমাকে বাড়ি ফিরে গিয়ে,গরদের শাড়ি পরে চুপচাপ বসে পড়তে হবে মা লক্ষ্মীর সামনে। সামনের থালায় কি কি দেওয়া হয়েছে ,আমার লক্ষ্য থাকে সে দিকেই। বাবাই আমাকে বেশি প্রশ্রয় দেয় ।আমি লক্ষ্মীপুজো করবো জানলেই, আমার প্রিয় গুজিয়া, পেয়ারা, আপেল শশা, কলা আর বাতাসা আনে। এগুলো দেখলেই আমার সমস্ত ভক্তি হৃদয়ে এসে বাসা বাঁধে ।আহা ! কি সুন্দর গলায় আমি তখন শুরু করি —
দোল পূর্ণিমা নিশি নির্মল আকাশ,
ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ ,
কহিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন…
বেশ কিছুক্ষণ বলার পর আমার মনে হয়, শেষ লাইন গুলো কেন এখনো আসছে না ? ভেতরটা খিদেয় গুড়গুড় করে ওঠে। গুজিয়ার গন্ধটা আমাকে ভীষণ অন্যমনস্ক করে দেয় , আর তার সঙ্গে কাঁঠালি কলা।উফ , ভাবা যায় ! যে মুহূর্তে আমি উচ্চারণ করি — অচিরে হইল গৃহে শান্তিনিকেতন–
ওমনি মা উলু দেয় , আর দিদি শাঁখ বাজায়।আর আমি এক ঝটকায় গরদের শাড়ি খুলে হাফপ্যান্ট পরে স্যান্ডো গেঞ্জিটা কোনরকমে গায়ে গলিয়ে — দাও দাও ,তাড়াতাড়ি প্রসাদ দাও –বলে বসে পড়ি ।
আসলে, এসব কথাগুলো আমি এখন ফুটবল মাঠে বসে ভাবছি। আমরা এখন নওদাপাড়ার অশোক চক্র মাঠে নাইন-এ-সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বসে আছি। আর বসে বসে কমলদার একগাদা হাবিজাবি জ্ঞান শুনছি। ফুটবলের কত প্রকরণ কমলদা বলে যাচ্ছে । আমার এসব ছাই মাথায় ঢুকছে নাকি ! আমি শুনছি শ্যামল মিত্তিরের গলায় একটা দারুন গান। সেমিফাইনাল খেলা তো ! তাই লোক জড়ো করতে মাইকে গান বাজছে। আর তারই মাঝে মাঝে অ্যানাউন্সমেন্ট– আর মাত্র পনেরো মিনিট বাদেই খেলা শুরু হচ্ছে । যারা বাইরে আছেন ,তারা মাঠের ধারে চলে আসুন। আজ সেমিফাইনালের মুখোমুখি এই অঞ্চলের দুটো নামকরা দল — ডানপিটে —( কি মজা ! আমাদের নামটা আগে বলেছে ) আর রানিং বুলে.. এ..এ.. ট । ফাটাফাটি ফুটবল ! আসুন, আসুন, আসুন। মাতা জগন্ময়ী ফুটবল টুর্নামেন্টের আজ প্রথম সেমিফাইনাল। মহালয়ার দিন ফাইনাল খেলা । আজকে আপনারা দলে দলে এসে মাঠ ভরিয়ে দিন ।আসুন আসুন আসুন।
আমি একটা ঘাসের ডগা শেষ করে, আরেকটা ঘাসের ডগা চিবোতে শুরু করেছি। এতক্ষণ মান্নাদের গলায় গান বাজছিলো–আহা, তোমাকে লাথায় রোজ
বুট পরা কত পা,
এত লাথি খাও তবু
মুখে কিছু বলো না আ আ আ….
পুড়ে মরো রোদ্দুরে
কাদা মাখো বরষায় ,
তবু ফুলে-ফেঁপে থাকো অবিচল…
হাঁই হাঁই় হাঁই হাঁই — সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল…….
হঠাৎ শুনি রিনরিনে গলায় শ্যামল মিত্রের গান বেজে উঠলো । আরে , এ গানটা তো কখনো শুনিনি !
কী নামে ডেকে বলবো তোমাকে,
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে ।
আমি যে মাতাল হাওয়ারই মতো হয়ে ,
যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে …..
শুনতে শুনতে আমি ক্রমশ ফুটবল থেকে মায়ের গানের হারমোনিয়ামে পৌঁছে গেছি । এ গান মায়ের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। রেফারি মাঠে নেমে পড়েছে । কমলদা আমাকে কলার চেপে তুলে ধরল। শোন পরিচয়, আমার কোনো কথা শুনিস নি তুই। আমি খুব ভালো করে জানি ,তোর মন ছিল ওই গানের দিকে । তোর ফুটবলটাও হবেনা, গানটাও হবে না । আমি প্রাণপণে বলে উঠলাম,আমি সব শুনেছি কমলদা।আপনি কোনো চাপ নেবেন না। রাখ ওসব ফালতু কথা । আমি গোল চাই তোর কাছে । অন্তত একটা গোল চাই ।আর সব সময় খেলার মধ্যে থাকবি । জমিদার বাড়ির ছেলের মত কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াতে দেখলেই খেলার শেষে তোর মাজা ভেঙে দেবো আমি। নিচে নেমে এসে বল তৈরি করবি। ডিফেন্সকে সাহায্য করবি। বল ডিস্ট্রিবিউট করবি।তারপর গোলে শট নিবি। আর একা একা পায়ের কায়দা দেখাবি তো তোর পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো আমি ।স্বার্থপরের মত খেলবি না ।সবাইকে বল দেওয়া নেওয়া করবি। আরেকবার বলে দিচ্ছি — গোল কিন্তু চাই ।তারপরেই গালে চুমু খেয়ে, সোনা আমার –রাগ করিস না। তুই তো আবার একটুতেই ভ্যা়ঁ করে কেঁদে ফেলিস।এবার রেফারি এসে কড়া গলায় বলল- কমল, তুমি প্লিজ মাঠের বাইরে যাও। ওদের খেলতে দাও ,অনেক জ্ঞান দিয়েছো।
দেখতে দেখতে হাফ টাইম হলো , আমরা এক গোলে ডাউন। কমলদা আমার দিকে তাকাচ্ছে ।নুন লেবু জিভে ঘষতে ঘষতে আমি শুধু ভাবছি , কি করে দুটো ফাঁকা গোল আমি মিস করলাম ! এমন সময় আবার শ্যামল মিত্রের গান —
পালাতে পারিনি আমি যে দিশাহারা,
দুটি চোখ যেন আমায় দিচ্ছে পাহারা ,
ধরা পড়ে গেছি আমি নিজেরই কাছে ,
জানিনা তোমার মনে যে এত প্রেম আছে ,
সত্যি যদি হয় বলুক যা বলছে নিন্দুকে,
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে ….