ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ২২)

রূপকথা পৃথিবীর
তোরা জানিস আমার মায়ের খবর ?
লক্ষ্মীপুজোর পরেই মায়ের ছুটি ছুটি ছুটি…
আমায় কে পায় ? আহ্লাদে ষোলোখানা !
ইচ্ছে আমার ঘুড়ির সঙ্গে হাওয়ায় লুটোপুটি !
দিদি বাবাকে আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলো — আচ্ছা বাবা , মাকে তো পুজোর এক সপ্তাহ আগেই হাসপাতাল থেকে ছাড়তে পারতো ! বাবা চুপ ! এবার আমি বললাম — মাকে ছাড়তে ছাড়তে সেই লক্ষ্মীপুজোর পরে ?
বাবা তখনও চুপ। দাদা এবার রোববারের চায়ের আসরটাকে গরম করতেই যেন একটু রাগ দেখিয়ে বললো — ধুত্তোর , মা না এলে পুজোটাই তো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাবে। আমি এবার ভাবছি শিবপুরের হোস্টেলেই থেকে যাবো। বাবা এবার চায়ের কাপটা নামিয়ে , আমার দিকে একটা বেকারির গন্ধ লেগে থাকা পাঁউরুটির টুকরো এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো — হ্যাঁ রে বিলু,শিখা ,জেনো — তোরা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছিস তো, এইটুকু জানিস না ,যে তোদের বাবা রাইটার্সের সেক্রেটারিয়েটে বসে আর যাই পারুক,ডাক্তারিটা করতে পারেনা ! কলম পেশা আর ডাক্তারি করাটা এক নয় । একজন মানসিক রোগীকে ডাক্তাররা কখন ছাড়বেন , সেটা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যাপার ! বিদ্যাসাগর যেমন পড়াশুনোর ভগবান , অসহায় রোগীদের কাছে ডাক্তার তেমনই ভগবান , এ কথাটা কখনও ভুলবিনা । তোদের মায়ের অসুখে তোরা যা করেছিস ….. আসলে এটা তো একটা পারিবারিক যুদ্ধ । সে যুদ্ধে জেতা বা হারা নেই , শুধু ফিরে পাওয়া আছে।প্রত্যেক রোগীকেই ডাক্তাররা এমনভাবেই বাড়ি পাঠান , যাতে তাঁদের আর দ্বিতীয়বার হাসপাতালের বদ্ধ খাঁচায় ফিরে আসতে না হয় !
দিদি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলো। বড় বড় চোখে টলটল করছে জল । দাদা ঠোঁট কামড়ে খোলা দরজা দিয়ে , দূরের নারকেল গাছের পাতায় চোখ রেখেছে , যেখানে অন্তত একশোটা টিয়া আমাদের তিন ভাইবোনকে ধমক দিচ্ছে— বাবার কথা মন দিয়ে শোন , বাবার কথা মন দিয়ে শোন…. আর, আমি কিচ্ছু করছিনা । চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে ভাবছি ,ভগবান কি ঠিক এইরকমই দেখতে ? বাবা হঠাৎ হেসে ফেলে , টেস্ট ক্রিকেটের হিন্দি কমেন্টেটারদের মতো বললো — আশমান মে ছায়ে হুয়ে হ্যায় বাদল ….
স্থিতি বহুৎ গম্ভীর হ্যায় ?
তোরা এমন ভাব করছিস , যেন শূন্য রানে ভারতের চারটে উইকেট পড়ে গেছে । নে ওঠ শিখা ,বাজারের ব্যাগটা দে । আজ মাটনটা আমিই রান্না করবো। দাদা একটু চিমটি কাটলো — তাহলে তোমার রোববারের তাসের আসর কাঁদবে যে !
বাবা দাদার গালের হালকা দাড়িতে আঙুল ছুঁয়ে বললো — কেন তুই প্রক্সি দিবি ! কনটাক্ট ব্রীজটা তো তুই ভালোই বুঝিস । শোন , সামনের রোববার কিন্তু তোদের নিয়ে পুজোর বাজারে যাবো । আমরা তিন ভাইবোন প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললাম — না না না… এবার পুজোর বাজার বন্ধ। মা নেই ,আমরা কিচ্ছু চাইনা । বাবা দিদির এক ঢাল চুল ঘেঁটে দিয়ে বললো — দূর পাগলী ,পুজোতে নতুন জামাকাপড় না পরলে মা কান্নাকাটি করবে । তাছাড়া অন্যদের দেওয়া-থোওয়ার ব্যাপারটাও তো আছে। শিখা, তুই একটা লিস্ট করে রাখ।
পরের রোববার , দুপুর বারোটায় আমরা যখন , আশ্বিনের রোদ মাথায় নিয়ে কলেজস্ট্রিটের মোড়ে নামলাম , তখন হরলালকা স্টোর্স , ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউস ম-ম করছে পুজো পুজো গন্ধে! অন্যবারের পুজো বাজারে বাবা আর মায়ের একটা শর্টকাট মেথড আছে কেনাকাটা করার। প্রথমেই সোজা হরলালকায় ঢুকে পড়ে , রেডিমেড জামাকাপড়ের বিভাগের দিকে এগিয়ে যাওয়া , তারপর আমার একসেট জামাপ্যান্ট , দিদির লেটেস্ট ডিজাইনের ফ্রক , দাদার শার্ট প্যান্টের পিস , বাবার এক জোড়া ফিনলের ধুতি , আর অফিস যাওয়ার জন্য ভালো কোয়ালিটির লঙক্লথের কাপড় কেনা; যাতে বড়োসড়ো বুকপকেট সমেত দুটো হাফ হাতা পাঞ্জাবি তৈরি করানো যায় । বাবা অনেকটা হেমন্ত মুখার্জির মতো পোশাক পরে। বাবার প্রিয় গায়কও হেমন্ত মুখার্জি। এবারে তো মা পুজোর বাজারে নেই , তাই , সময়ের আগে বড় হয়ে যাওয়া আমার দিদি, হরলালকার পর্ব চুকিয়ে , কু ঝিকিঝিক ইঞ্জিন হয়ে , তিনটে বগি সমেত ( বাবা দাদা আর আমি ) সোজা ঢুকে পড়লো কলেজস্ট্রিট বাটায় ! আমার জুতোর বাক্স সবসময় আমার কাছে থাকে। ওটা আমি হাতছাড়া করিনা। এবার আমার ভাগ্যে জুটেছে বাটার সুপার-টাফ বুট। ওটা বাবার পছন্দ । বাবা জানে তার ফুটবল খেলোয়াড় ছোটো ছেলে , বাড়ির সামনে থেকে যে স্টোনচিপের টুকরোটা বুটের ডগা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে ইস্কুল পর্যন্ত নিয়ে যায় , ছুটির পরে সেইটাই আবার বাড়ি অব্দি ফিরিয়ে নিয়ে আসে পায়ে সট মারতে মারতে। যাওয়া আসা নিয়ে পাক্কা দু কিলোমিটার ! যাওয়ার সময় ডানপায়ে , ফেরার সময় বাঁ পায়ে । বাটার জুতো ছাড়া অত সহ্য ক্ষমতা আর কারোর নেই । কারণ , আমার স্বপ্নের নায়ক চুণী গোস্বামী দুটো পায়েই সমানভাবে ড্রিবল করতে পারতেন বলে শুনেছি । তাই আমিও…..
দিদির লঙমার্চ এগিয়ে চললো এবার ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউসের দিকে। আমরাও ঘাস- বিচালি , ঘাস-বিচালি করতে করতে , দিদিকে ফলো করছি । আমার ভুরু অলরেডি কোঁচকাতে শুরু করেছে । সব কেনা হচ্ছে , কিন্তু আমার দেব সাহিত্য কুটিরের পুজোবার্ষিকী কেনাটাই এখনও বাকি ! দিদিকে ফিসফিস করে বলতেই কড়া ধমক — আগে মায়ের শাড়ি কেনা হবে ,তারপর তোর বই।
আর খাওয়া ? খাওয়া কখন হবে ? দিদি এবার ঠিক হিটলারের ভঙ্গিতে বলে উঠলো , কেন জলখাবারের পরোটা , আলুচচ্চড়ি আর দরবেশ পেট থেকে উধাও হয়ে গেল ? হবে হবে , সব হবে। অপেক্ষা কর ! একটুও ধৈর্য নেই ! তাই শুনে বাবা আর দাদার মুচকি হাসিটা যেন বাঁধিয়ে রাখার মতো। দিদি সত্যিই মা’র জন্য একটা অপূর্ব শাড়ি পছন্দ করলো। মা বোধহয় কোনো সময় দিদিকে বলেছিল , একটা কোড়িয়াল শাড়ি কেনার কথা । হালকা ঘিয়ে রঙের জমিতে গাঢ় লাল পাড় ! আর আঁচলের বর্ণণা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই । দাদা কবিতা লেখে ,ও হয়তো পারবে। কিন্তু এইটুকু জানি , সেলসম্যান কাকু শাড়িটা মেলে ধরতেই পুরো ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউসটা যেন আলোয় আলো হয়ে উঠলো….
কলেজস্ট্রিটের মুখে, পাতিরাম থেকে কেনা আমার পুজোবার্ষিকীটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই আমি বিস্ময়ে পুরো থ মেরে গেলাম! পাতায় পাতায় সুখ দুঃখ হাসির গল্প…গা ছমছম ভূতের গল্প ,অ্যাডভেঞ্চার ,কমিকস , উপন্যাস ,পুজোর কবিতা ,আর রঙিন ছবিতে সাজানো একটা পাঁচশো পাতার বই। আমার নিজের পৃথিবী! আমি এই কদিন রাত্তিরে মাথার বালিশের একপাশে পুজোবার্ষিকী ,অন্য দিকে বাটার জুতোর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ভোরের শিউলির কাছে পৌঁছে যাবো।শিউলির গন্ধটা যেন মায়ের শাড়ির আঁচলের গন্ধের মতো ! তাই না….
আমার দুহাতে পুজোবার্ষিকী, আর বাটার জুতোর বাক্স সামলে আমরা দিলরুবাতে গিয়ে ঢুকলাম।জমিয়ে খিদে পেয়েছে। আর বলতে না বলতেই চোখের সামনে হাজির , স্পেশাল মোগলাই পরোটা আর মাটন কষা ! সঙ্গে বড় কাচের গেলাসে গোলাপি রঙের লস্যি ! আমাদের তিন ভাইবোনেরই চোখে হঠাৎ এক সমুদ্র জোয়ার উথলে উঠলো। সে জোয়ারের দু ফোঁটা জল বাবার চশমার কাচকেও ঝাপসা করে দিলো। মায়ের কথা ! আমরা চারজনই আসলে মায়ের স্মৃতিতে ডুবে গেছি। খিদে বাড়িয়ে দেয়া, জিভে জল আনা খাবারগুলো টেবিলের ওপর অনাদরে পড়ে আছে…. আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
আচ্ছা , আমাদের শান্ত আর কম কথা বলা মা এখন কী করছে ?