অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৪৮)
শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু
একটু ছায়া গ্রীষ্ম দিনে , একটু শ্যামলিমায় ,
যখন বিকেল ঘনিয়ে আসে কেন যে কান্না পায় !
ওষ্ঠ যখন ওষ্ঠ খোঁজে, চোখের পাতা কাঁপে,
জীবন জোড়া ভূমিকম্প বুকেরই উত্তাপে !
অবেলায় খেতে বসলে যা হয় , উন্মনা ও অমলেন্দু দুজনেই প্রায় কিছুই মুখে তুলতে পারলো না । প্রহর জোড়া ক্লান্তিতে উন্মনার শরীরও আর বইছিল না । তবু চা পকোড়া শেষ করা সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো উন্মনা ও প্রলয়কে । শেষ বিকেলে ধুলো উড়ছে সদ্য স্মৃতি হয়ে যাওয়া কবি সম্মেলনের ফাঁকা প্যান্ডেলে । শুভ ,বাদল মেঘ , তিথি , অরুণিমা , অর্ধেন্দু সবাই এখন বাড়ি ফেরার পথে । গানের বিন্দাস কিছুতেই তার গুরুকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না । অমলেন্দুর হয়তো একটু ইচ্ছে ছিল বিন্দাসকে রেখে দেওয়ার । শেষে উন্মনাদের পাশের গ্রামের এক তরুণ কবি তাঁকে নিয়ে গেল নিজের বাড়ি । ঠিক হলো — অমলেন্দুর শরীর খারাপ হলে তাকে ডাকা হবে । তা নয়তো পরের দিন সকালে সে অমলেন্দুর সঙ্গে ফিরবে । অমলেন্দুর বিষণ্ণতাকে নিমেষে ভাসিয়ে দিয়ে , যাবার মুখে পাগলা বিন্দাস গেয়ে উঠলো — “পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই ,আমি তো সেই ঘরের মালিক নই …”
অমলেন্দু অনুভব করলো, বিন্দাসের উপস্থিতি এমনই , যে তার চলে যাওয়ার শূন্যতা মা প্রকৃতিও তেমন করে ভরাট করতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও প্রলয় তাঁকে কিছুতেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি বসতে দিলো না । বরং কিছুটা জোর করেই বিশ্রামে পাঠালো । বললো — আমার জন্য ভাববেন না স্যার। আজ আমি মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছি । আজ আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে । কাল দুপুর বারোটা নাগাদ ফিরে এসে আপনাকে পাহারা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। বিন্দাসদাও তো সঙ্গে থাকবে,ভালোই হবে। ততক্ষণ আপনি রেস্ট করুন। দরকার হলে মোবাইল সুইচড অফ করুন । কোনো চাপ নেবেন না । আমি আর দিদিভাই সাংবাদিক সম্মেলন সামলে নিচ্ছি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘরের ভিতরে ফিরে গেলেন অমলেন্দু। দুতিনজন সাংবাদিকের সামনে গুছিয়ে বসলো উন্মনা। প্রলয় আগে থেকেই কথা শুরু করে দিয়েছিলো। উন্মনা আসতেই একজন সাংবাদিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো — দেরি করে ফেললেন ম্যাডাম। আমাদের ফিরতে হবে তো। উন্মনা সরি বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার দিকে চোখা প্রশ্ন ধেয়ে এলো — এটা কি কোনো বামপন্থী বা অতি বামপন্থী দলের গণ সংগঠন ? বিনীতভাবে উন্মনা বললো — না আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কোনো যোগাযোগ নেই । এটা একেবারেই সামাজিক সংগঠন ,কবিতার সংগঠন ।পরের প্রশ্ন — কবিজন্ম বা কবিতার আশ্রয় —যে কথাগুলো আজ বারবার উঠে এলো , সেগুলো কি আদৌ সম্ভব ? উন্মনার উত্তর — আমাদের বিশ্বাস,হ্যাঁ সম্ভব ।
এর অর্থনৈতিক ভিত্তি কি ? আড়ালে কি কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ? থাকলে কারা আছে ? এবার প্রলয় বিনীতভাবে উত্তর দিলো — আমরা সেরকম সাহায্য গ্রহণ করবো না । কেননা, অর্থ দানের পেছনে একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য অনেক সময় থেকে যায়। অর্থ গ্রহণ মানে , অর্থ দাতার ইচ্ছাধীন থাকা বা তার হাতের পুতুল হয়ে যাওয়া। অল্প কয়েকজন শিক্ষিত কর্মঠ ছেলে মেয়ে এখানে দুবেলা দুমুঠো জুটিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিজেরাই নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রশ্ন এলো — এটা তো আবেগের কথা । বাস্তবে কি আদৌ সম্ভব?
উত্তরে প্রলয় বলে উঠলো — সম্ভব।ছোটো করে ভাবলে সম্ভব। আমাদের অমলেন্দু স্যার প্রথম জীবনে মফস্বলের গ্রুপ থিয়েটার কমিউন তৈরির কথা ভেবেছিলেন । একসঙ্গে থাকা, খাওয়া, থিয়েটার তৈরি করা ,নাটক করা ও লেখার জন্য ওয়ার্কশপ, থিয়েটার থেকে রোজগার করা টাকার কিছুটা অংশ অভিনেতা পরিচালকদের মধ্যে বন্টন করা–চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দলের মেয়েদের থাকার অসুবিধে ছিল এবং ফিল্ম ও সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তেই , ছেলেমেয়েরা সেদিকেই দৌড়ালো। এবার উন্মনা যোগ করলো — কিন্তু সেই ব্যর্থতাই একটা মাইলস্টোন হয়ে গেল স্যারের কাছে । এখানে যেহেতু তরুণ কবিদের কাছে অর্থ উপার্জনের কোনো লোভনীয় প্রস্তাব নেই ,তাই হয়তো এটা চললেও চলতে পারে। একজন সাংবাদিক বাধা দিয়ে বললো — ম্যাডাম , আপনি নিজেই তো অনিশ্চিত। চলবে একথা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না — তাহলে? আরেকজন বললো– তাছাড়া , সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও তো একটা প্রতিবাদ উঠে আসতে পারে , আপনাদের একসঙ্গে থাকা নিয়ে । সাধারণ মানুষ কি কবিতা বা কবিতার আশ্রয় নিয়ে এত কিছু ভাববেন ? প্রলয় একটু বিষণ্ণ হেসে বললো — – আমরা মানুষকে বোঝাবো । আমাদের কবিতার পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করা, নানা ধরনের ছোটো ছোটো সেমিনার , কবি সম্মেলন ইত্যাদির ব্যবস্থা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন । তবে আপাতত আমরা পুরুষরাই একসঙ্গে কিছুদিন থেকে এই কবিতা সংসার চালাবো। ছুটির দিনে বা উইক এন্ডে উন্মনাদিরা আসবে ।তাছাড়া ,টেলি কনফারেন্সে আমরা সবাই মিলে আলোচনা চালাবো — এটাই বলতে পারি । আবেগ ও বাস্তবতার সংঘাত যে বাধবে এটা আমরা ভালো করেই জানি । কিন্তু অমলেন্দু স্যারের ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতাই তরুণ কবিদের কাছে কবিতার আশ্রয় নিশ্চয়ই হয়ে উঠবে। এবার উন্মনা খানিকটা অসহায় ভাবে বলে উঠলো — আমাদের স্যার একজন সিনিয়র সাংবাদিক যিনি তাঁর প্রফেশন ছেড়ে বাকি জীবনটা এই কাজের মধ্যে ডুবে থাকবেন। সেখানে এক প্রফেশনের বন্ধু হয়ে নিশ্চয়ই আপনারা সহযোগিতা করবেন — এটাই আমাদের আবেদন । এবার একজন তরুণ সাংবাদিক বিব্রত হয়ে বললো — আমরা পাশে থাকবো বলেই তো নানারকম প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছি । একজন নামী সাংবাদিক বড় হাউসে চাকরি না করে ,নিজের জেলাতেই গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন ,যিনি সাংবাদিকতায় আমাদের সিনিয়র ও গুরুর মতো ; তাঁর কাছে তো ছুটে আসতেই হবে। হঠাৎ উন্মনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো ,একটা চেনা গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়ছে ।তরুণ সাংবাদিকরা উঠে দাঁড়ালো। উন্মনা পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো তার কবিমন এসে দাঁড়িয়েছেন। একজন তরুণ সাংবাদিক ব্যস্ত হয়ে বললো দাদা আপনি উঠে এলেন কেন ? আমাদের ইন্টারভিউ শেষ হয়ে গেছে। অমলেন্দু যেন ঘোরের মধ্যে বলে উঠলেন — মেধা আর পরিশ্রম যদি এক জায়গায় মিলতে পারে, সেখানে সোনার ফসল ফলবেই । আমাদের এই কবিতা সংসার থেকেই যদি দুএকজন সত্যিকারের কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে , তাহলে বাংলা ভাষাজননী নিশ্চয়ই আমাদের আশীর্বাদ করবেন । কবি প্রলয়ের দু কাঁধে ভর রেখে কবিতার অমলেন্দু ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ থেকে —
দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-‘ পরে
ওরা কাজ করে।।
গ্রীষ্ম বিকেলের সমবেত স্তব্ধতার মধ্যে , সাইলেন্ট মোডে রাখা উন্মনার ফোন জানান দিলো ,লন্ডন থেকে একটা ফোন আসছে। অমলেন্দু বন্ধু মেঘলার ফোন।
ক্রমশ