গদ্যের পোডিয়ামে ঈশানী রায়চৌধুরী

   সাহিত‍্যে প্রেম ও পরকীয়া

সাহিত‍্যে পরকীয়া অনেকটা কমলহীরের মত… এর থেকে যে জ‍্যোতি বিচ্ছুরিত হয় তাই প্রেম!
অথবা প্রেম এখানে পরশপাথর, যা কোন সম্পর্ককে ছুঁয়ে দিলে তা কোহিনূর হয়ে যায়!
লক্ষী নারায়ণ  বা হরগৌরী র মত পুরাণকথিত বিখ‍্যাত দম্পতির প্রাত‍্যহিক প্রেম নিয়ে সাহিত‍্যিকদের তেমন মাথাব‍্যথা দেখা যায় না। হতে পারে পাথরে ধাক্বা খেয়ে ঝর্ণা যে সৌন্দর্য বিকীরণ করে তার কাছে শান্ত নদীর আকর্ষণ কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে যায়। তাই  যা নিষিদ্ধ বা সমাজে অনুমোদিত নয় তেমন সম্পর্ক নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে অনন্ত রস। জীবনের সেই ছবি সাহিত‍্যের ক‍্যামেরায় কালজয়ী হয়ে আছে, থাকবে। আভিধানিক অর্থ যাই হোক এই পরকীয়া রস বিশ্বসাহিত‍্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করে আছে। সম্পর্কের এই টানাপোড়েন, কখনও বিনষ্টি কখনও বিনির্মাণ  আশ্চর্যভাবে মানুষের চরিত্রের নানা রহস‍্য উন্মোচন করেছে এবং করে চলেবে  অনাদিকাল। যা সহজেই পাওয়া যায় তার জন্যে অভিসার, আকুলতা  জীবন স্বীকার করে না আর তাই দুর্লঙ্ঘ হিমালয় এত আকর্ষণ করে,অতল মহাসমুদ্র চুম্বকের মত টানে মানুষকে।

পদকর্তারা  বলেছেন :
” আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা
তারে বলি কাম,
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা
ধরে প্রেম নাম।”

এই কৃষ্ণ ই তো অনন্তের জন‍্য সুন্দরের জন‍্য জীবের আকুল আকাঙ্খা!

ইংরেজ কবি পি বি শেলি লিখেছেন
Desire of the moth for
the star
Of the night for the morrow
Devotion to something afar
From the sphere of our sorrow

এই তৃষ্ণা এই অণ্বেষণ ই ভিত তৈরী করে পরকীয়ার। এক সম্পর্ককে ছুটিয়ে মারে অন‍্য অভীপ্সায়। বিশেষজ্ঞদের মতে পরকীয়া হল :
” ঠিক মানুষের সঙ্গে ভুল সময়ে দেখা হওয়া”।
আর এই ঘাতপ্রতিঘাত, অন্তরে বাইরে  এই দড়ি টানাটানিই  পরকীয়াকে এত আকর্ষণীয় করে তুলেছে । যদিও কারণ হিসেবে অনেক   সমাজতত্ত্ববিদ বলছেন যৌনজীবনে অতৃপ্তি , বিবাহিত জীবনের একঘেঁয়েমি, বৈচিত্রের তৃষ্ণা ইত‍্যাদি  কিন্তু এর শেকড় ছড়ানো আছে সমাজ- সম্পর্কের অনেক গভীরে।
সুপ্রাচীন  চর্যাপদেও এই পরকীয়ার  বীজ নিহিত আছে। তবে এই রসের অতি উৎকৃষ্ট  নিদর্শন আমরা পাই বৈষ্ণব পদাবলীতে।
সাহিত‍্যে  বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনা হয় চতুর্দশ শতকে বিদ‍্যাপতি ও চন্ডীদাসের  সময়ে। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল তত্ত্ব হল, শ্রীকৃষ্ণ সৎ-চিৎ-আনন্দের মূর্তিমান বিগ্রহ। আর এই পরমাত্মার হ্লাদিনী শক্তি রূপে সৃষ্ট হয়েছেন শ্রীরাধিকা। তত্ত্বের দিক থেকে আত্মা, পরমাত্মার  স্বকীয় হলেও এই পঞ্চভূতের পৃথিবী তার মায়া – আবরণে আচ্ছন্ন করে রাখে আত্মাকে। তাই ভগবানের বাঁশি যখন জীবের মর্মমূলে সাড়া তোলে, ঘটে যায় সন্ধিক্ষণ।  আত্মঞ্জান লুপ্ত হয়ে জীবের অভিসার ঘটে পরমাত্মার উদ্দেশ‍্যে।  এই হল পদাবলীর নিহিতার্থ।
অভিসার শব্দের অর্থ সংকেত স্থানে যাওয়া।
প্রমের আগুনে পরিশুদ্ধা নায়িকা যখন সব জাগতিক  ভয়, লজ্জা , প্রতিবন্ধক বিস্মৃত হয়ে যাত্রা করেন প্রিয় মিলনে তাকেই পদাবলীতে  বলে অভিসার। আছে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার,  মাথুর। সমুদ্রের মত এর বিস্তার সেখানে অসংখ‍্য রত্নরাজি অতল গভীরতা।চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে মৈথিলকবি বিদ‍্যাপতি তাঁর মাতৃভাষায় এই অলৌকিক প্রেমলীলাকে   লৌকিক বা মানুষের প্রেমকাহিনী হিসেবে রূপ দিয়েছেন। উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী রাধিকা ছিলেন কামকলায় অনভিজ্ঞা। বিদ‍্যাপতি তাঁর  রচনায় রাধাকে শৃঙ্গাররসের পূর্ণাঙ্গ নায়িকায় রূপান্তরিত করেছেন।  রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
” এই পদগুলি পড়িতে পড়িতে একটি সমীর চঞ্চল সমুদ্রের উপরিভাগ চক্ষে পড়ে। কিন্তু সমুদ্রের অন্তর্দেশে যে গভীরতা, নিস্তব্ধতা যে বিশ্ববিস্মৃত ধ‍্যানশীলতা আছে তা বিদ‍্যাপতির গীতিতরঙ্গের মধ‍্যে পাওয়া যায় না “।
তথাপি ছন্দে,অলঙ্কারে, বাগবৈদগ্ধে তাঁর পদগুলি যে বর্ণময় হীরকচ্ছটা বিচ্ছুরণ করেছে তা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর  হয়ে আছে। “আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু ”
” মাধব বহুত মিনতি করি তোয় ”  ইত‍্যাদি পদ বহুচর্চিত।
চৈতন‍্যদেবের পূর্ববর্তী বাংলা  সাহিত‍্যে চন্ডীদাস এক অনন‍্য স্থান অধিকার করে আছেন। যদিও প্রায় ১২৫০ টিরও  বেশি কাব‍্যের সন্ধান  পাওয়া যায় যেখানে  বড়ু চন্ডীদাস, দীন চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস এই তিনজন রচয়িতার নাম  উল্লেখ আছে।
‘সই কেবা শুনাইল শ‍্যামনাম’
‘রাধার কি হইল অন্তরে ব‍্যাথা ‘
‘ বঁধু কি আর বলিব তোরে ‘
এইসব পদ লোকের মুখে মুখে অমর হয়ে আছে।

“গাগরি বারি ঢারিকরি
পিছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি ”

পায়ের নূপুর খুলে ফেলে অন্ধকার রাত্রিতে বিদ‍্যুতের আলোয় রাধার এই অভিসার যাত্রা যুগযুগ ধরে আলোড়িত করে রেখেছে পাঠককুলকে।
মানুষের  ইতিহাসে আদিকালে মানুষ ও অন‍্য জীবের যাপনে তেমন পার্থক‍্য ছিল না , শুধু চিন্তাশক্তির  প্রয়োগ ছাড়া। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী  হওয়ায় তার জীবনযাপন কিছু সুশৃঙ্খল ছিল।  বেঁচে থাকার সেই তুমুল লড়াইয়ের দিনেও সে নিজেকে সুরক্ষিত করার নিত‍্যনতুন উপায় আবিষ্কার করত। তফাৎ ছিল না নারী ও পুরুষে। তবে অন‍্য প্রাণীর মত সন্তানধারণ ও লালন করতে হয় বলে শরীরবৃত্তিয় ক্ষেত্রে নারী আলাদা। অবশ‍্যই ছিল ভিন্ন হরমনের প্রভাব তার মস্তিষ্কে।
পুরাণকাহিনীতে এবং মহাকাব‍্যে আমরা কন‍্যা বা স্ত্রীকে উপঢৌকন দিয়ে তুষ্ট করার নজির দেখেছি অনেক। বলশালী রাজাদের তো বটেই এমনকি  অতিথিদের জন‍্যেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। নারীকে সম্পূর্ণ মানুষ মনে করা হত না বলেই বোধহয় তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল‍্য ছিল না। নারী ধীরে ধীরে পুরুষের অধীনস্থ গার্হস্থজীব হয়ে উঠছিল বলেই বিদ্রোহের, পরকীয়ার সম্ভাবনাও যারপরনাই বেড়ে উঠেছিল। চর্যাপদ থেকেই এই পরকীয়ার বীজ পাওয়া যায় বাংলা সাহিত‍্যে।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে শুরু করে বৈষ্ণবপদাবলীতে তো অনন‍্য উচ্চতায় উঠেছে সাহিত‍্যের এই পরকীয়া রস

এক নারী বা এক পুরুষে বদ্ধ জীবন  মানুষের অন্তর্গত চাহিদা নয় বলে স্বীকার করেছেন সমাজতত্ত্ববিদরা। তবে সমাজগঠনের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদেহী নারী ও তার কোমল মনোবৃত্তিকে পদানত করে সমাজের শৃঙ্খল তার ওপর আরোপ করেছে পুরুষ। তারপর যুগের অগ্রগতির সঙ্গে  পুরুষসমাজও নিজেদের কিছু সামাজিক অনুশাসনে আবদ্ধ করেছে। যদিও বহু বিবাহের খবর পেতে ইতিহাসের পাতা বেশি ওল্টাতে হয় না।      মধ‍্যযুগের সাহিত‍্যে আমরা সঠিক অর্থে পরকীয়ার নিদর্শন দেখি কারণ ততদিনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শেকল শক্ত হয়ে চেপে ধরেছে নারীকে । বিবাহিত পুরুষের কিন্ত অবিবাহিতা নারীর প্রতি আকর্ষণ বা বিবাহের কোন বাধা ছিল না সমাজে।
নারীপুরুষের এই ভিন্ন সামাজিক অবস্থান থাকলেও তাদের পারস্পরিক আকর্ষণকে রুদ্ধ করতে পারেনি কোন বিধিনিষেধ।
পৌরাণিক সাহিত‍্যে পুরুষের তো নয়ই নারীরও বহুগামিনী হওয়ায় কোন বাধা ছিল না।মহাভারতে মহর্ষি উদ্দালক  ও শিশুপুত্র শ্বেতকেতুর  সামনে দিয়ে ঋষির স্ত্রী যাচ্ছেন অন‍্য ব্রাহ্মণের সঙ্গে,শিশুর কাতর জিজ্ঞাসার উত্তরে ঝষি বলছেন এটা নারীধর্ম। সুধীজন আলোচনা করেছেন এটা কি শুধু দৈহিক কামনা? ভালবাসার টানে কুলের গন্ডী অস্বীকার করা  বা পরনারী প্রীতিতে সমাজের ভ্রুকুটি অগ্রাহ‍্য করার প্রয়োজন হয়নি তখনও  তবে যেহেতু বিবাহপ্রথা সেদিনও সমাজস্বীকৃত ছিল তা সে গান্ধর্ব বা রাক্ষস যে রীতিতেই হোক না কেন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কিছু শৃঙ্খল  বা শৃঙ্খলা মানুষ স্বীকার করেছিল।
পৌরাণিক  সাহিত্যে আমরা এর অজস্র উদাহরণ পাই।
সংস্কার ও স্বাধীনতা এখানে তুল‍্যমূল‍্য ভিত রচনা করেছে আর তাই মানবমনের অতলচারী  প্রবৃত্তির সার্থক রূপকল্প হয়ে উঠেছে তারা।
বৃহস্পতি তারা  গৌতম অহল‍্যা  অগ্নি স্বাহা অগস্ত‍্য লোপামুদ্রা সংবরণ তপতী ইত‍্যাদি পুরাণকাহিনীর চরিত্ররা এক অপার রহস‍্যময় মানবচরিত্রের ভান্ডার খুলে দিয়েছে।কখনও বিপরীত বা পরস্পরবিরোধী মনোভঙ্গি ও অবাধে উন্মুক্ত হয়েছে এখানে। তাই পুরাণকাহিনী স্বকীয়া বা পরকীয়া নয়, প্রেমের বিচিত্রবিহার, তার নিজস্ব অণ্বেষণ অপূর্ব দক্ষতায় উন্মোচন করেছে।
বিশ্বসাহিত‍্যেও এই পরকীয়া সম্পর্কের অজস্র উদাহরণ।রাজা আর্থারের স্ত্রী ও বীর নাইট ল‍্যান্সলটের প্রেম কালজয়ী হয়ে আছে। মহাকবি শেক্সপীয়রের বিখ‍্যাত অ‍্যান্থোনি ক্লিওপেট্রা নাটকও মূলত বিবাহ বহির্ভুত প্রেমেরই  উপাখ‍্যান।
মানবহৃদয়ের প্রধান আকাঙ্খা  মুক্তি। তাই নিয়মের নিগড় থেকে বিদ্রোহাচরণ  তার স্বাভাবিক ‍প্রবৃত্তি। রামধনু সুন্দর বলে তার দূরত্ব বা ক্ষণস্থায়িত্ব হিসাব করতে মন চায় না।
দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার প্রতি আকৃষ্ঠ  হয়ে চন্দ্র তাঁকে প্ররোচিত করেন প্রেমনিবেদনে এবং পরবর্তীতে তাদের সন্তান জন্মায়। তার নাম বুধ।
সুশোভনা  নারীচরিত্রের এক অন‍্যমাত্রার উন্মোচন  যা আধুনিক সাহিত‍্যেও অত‍্যন্ত দুঃসাহসী পদক্ষেপ। বরবর্ণিণী সুশোভনা নিজের প্রণয়কলায় রূপমুগ্ধ প্রেমিকের হৃদয় দগ্ধ করে তাকে পরিত‍্যাগ করেন অবলীলায়। আবার অন‍্য প্রেমিককে যৌবনশরবিদ্ধ করে  নতুন বাসর রচনা করতেন। বারবার ঐ একই  নিষ্ঠুর খেলাতেই তার আনন্দ। অন‍্যদিকে স্বাহা ও অগ্নির কাহিনী পরম্পরা র প্রতি পরম নিষ্ঠা আর ভালবাসার কাহিনী।
প্রেমাস্পদকে ঝষিপত্নী সম্ভোগের পাপ থেকে বাঁচাতে  নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে তিনি অন্তর্হিতা।  তাই আজও অগ্নিদেবের আহুতিতে স্বাহা উচ্চারণ অবশ‍্যকর্তব‍্য বলে কথিত।
গ্রীক ও বৈদিক দুই পুরাণেই আমরা  দেবরাজ জিউস আর দেবরাজ ইন্দ্র দুজনকেই  দেখি পরনারীকামনায়  সিদ্ধহস্ত।  তাতে কিন্তু তাঁদের দেবরাজ হওয়া আটকায়নি।
এই স্বেচ্ছারতিবিহার চরম ঔৎকর্ষে পৌঁছেছে যখন তা নিষিদ্ধ সম্পর্ক।
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে সংস্কৃত ভাষায়  লেখা শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কালিদাসের  “অভিজ্ঞানশকুন্তলম ” সাহিত‍্যের নন্দনকাননে কল্পতরুর ফুল হিসেবে মনে করা হয় এই নাটককে। সংলাপের  মাধুর্য, ঘটনার বৈচিত্র,কল্পনার বিশালতায় এই নাটকটি ক্লাসিক। নাটকীয় বৈশিষ্ঠকে  গীতিকাব‍্যের মাধুর্য মন্ডিত করে  কবি এক অবিনশ্বর স্বাক্ষর রেখে গেছেন বিশ্বসাহিত‍্যে। ভারতীয় সমালোচক  বলছেন,  “কাব‍্যেষু নাটকং রম‍্যং তত্র রমা শকুন্তলা। ” ইউরোপের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মনীষি ‘গেটে’ বলেছেন,
” Young years blossoms and the fruits of its decline and all by which the soul is charmed, enraptured, feasted, fed…..” সমস্ত শকুন্তলা এই নামে যুক্ত আছে।  সৌন্দর্য সম্ভোগের কবি কালিদাস ভারতের শাশ্বত আত্মার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন এই নাটকে। নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট বলেছেন কালিদাসের সূক্তি সমূহ অমৃতরসে সিক্ত, চন্দনসুধায় অনুলিপ্ত এবং চন্দকিরণে প্রোজ্জ্বল।
যদিও কাহিনী অতি প্রাচীন। শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে  বৌদ্ধজাতক পর্যন্ত  বহু জায়গায় এই কাহিনীর উল্লেখ আছে।  এমনকি মহাভারত, ভাগবত, হরিবংশেও এই কাহিনী দেখতে পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণের কাহিনীর সঙ্গে এই নাটকের যে গল্প তার খুব মিল পাওয়া  যায়। তাই মনে করা হয় কালিদাস এই পুরাণ থেকেই তাঁর উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। মহাভারতের নীরস অবহেলিত কাহিনীতে কালিদাস নিপুণ হাতের তুলিতে সরস ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। পৌরাণিক কাহিনীর এই কঙ্কালে  প্রাণসঞ্চার করেছিলেন কবিকুলশ্রেষ্ঠ  কালিদাস।
রাজা  দুষ্মন্তের অন‍্যনারীগমনকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে  এই নাটকের মূল কাহিনী। নাটকের প্রথমেই কবি যে ভাষায় তপোবন, শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদার বর্ণনা দিয়েছেন তা অত‍্যন্ত সুললিত। প্রাচীন ভারতের অন্তরাত্মা  যেন এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে।
শিকার করতে এসে রাজা দুষ্মন্ত নিজেই শরবিদ্ধ হয়েছিলেন আশ্রমবালিকার অপরূপ রূপে  মুগ্ধ হয়ে। শকুন্তলার প্রতি দুষ‍্যন্তের অনুরাগ এত শীলিত ও স্বাভাবিক ভাবে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন যে পাঠকের মন এক অনন‍্য রসের আস্বাদ পায়। রাজার প্রতি শকুন্তলার   অনুভব পত্রাচ্ছাদিত কমলকলির মত এত চমৎকার নৈপুণ‍্যে মেলে ধরেছেন কবি যে কোথাও রসাস্বাদনে কোন আঘাত লাগে না। মহাভারতের কাহিনীতে ছিল রাজা শুধু লোকাপবাদের ভয়ে সপুত্র স্ত্রী, যাকে তিনি  গান্ধর্বমতে বিয়ে করেছিলেন, তাকে প্রত‍্যাখ‍্যান করেছিলেন।  নায়ক চরিত্রের এই নীতিভ্রষ্টতা কালিদাস অনুসরণ করেননি তাই তিনি কোপনস্বভাব ঝষি দুর্বাসার  অভিশাপ পর্বের অবতারণা করেন। বিরহতাপিতা শকুন্তলা যখন বাহ‍্যজ্ঞানশূণ‍্য হয়ে স্বামীর চিন্তায় মগ্ন, সেই নাটকীয় মূহুর্তে ঝষি দুর্বাসা তাকে অভিশম্পাত দেন এবং সখীদের সনির্বন্ধ অনুরোধে  বলে যান যে রাজা যে অভিজ্ঞান বা অঙ্গুরীয় শকুন্তলাকে দিয়েছেন  তার  দর্শনমাত্র রাজা আবার তাঁর স্মৃতি ফিরে পাবেন। কালক্রমে  শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে  রাজচক্রবর্তী লক্ষণযুক্ত পুত্রসন্তান প্রসব করেন। পুত্র সর্বদমনের বয়স যখন ছয় তখন মহর্ষি কণ্ব তাকে সপুত্র হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদে প্রেরণ করলেন। আশ্রমের অধিকাংশ তপস্বী মধ‍্যাহ্নের উত্তপ্ত রৌদ্রে হস্তিনাপুরের রাজপথে চলেছেল পুরোভাগে একজন অনিন্দ‍্যসুন্দরী, সে এক অসাধারণ দৃশ‍্য। তবে অতিদূর এই যাত্রাপথে অভিশাপের দুর্ভাগ‍্যে রাজার নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়টি শচীতীর্থের জলে হারিয়ে যায় । অতঃপর  ঘটে যায় সেই দুর্দৈব । এই অভিজ্ঞান আভরণ না থাকায় রাজা প্রত‍্যাখ‍্যান করেন শকুন্তলাকে। কাহিনীর নিপুণ বিন‍্যাসে সেই অভিজ্ঞান পুনরুদ্ধার হয় ও রাজার স্মৃতি  ফিরে আসে। অবশেষে মারীচাশ্রমে দুষ্মন্ত শকুন্তলার  পুনর্মিলন ঘটে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।