অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৫)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

সাতসকালে নূপুর বাজায় ফোন ,
কেন যে তুই এমন অবাক ডাকিস ?
হেমন্ত গানে , বউ কথা কও সুরে ,
সারাটা দিন এমনি ভাবেই থাকিস !

উন্মনা ফোনটা তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ও প্রান্ত থেকে ভারি মিষ্টি একটি নারী কন্ঠস্বর ভেসে এলো — তুমি উন্মনা তো ? আমি কিন্তু প্রথমেই তোমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করলাম । রাগ করলেও কিছু আসে যায় না , কেননা আমি সিওর যে , বয়সে তোমার থেকে আমি অনেকটাই বড়ো। হ্যালো , তুমি কি মৌনীমূক হিমালয় , যে কথা বলছো না ? আমি কিন্তু দূরে থেকেও তোমার উন্মনা মনের দিল ধক ধক শুনতে পাচ্ছি । এতক্ষণে খিলখিল করে হেসে ফেললো উন্মনা । তুমি তো দারুণ সুন্দর কথা বলো দিদি। আমি উন্মনা ঘোষ মাইতি । কিন্তু যখন লিখি …এবার ও প্রান্ত থেকে আবার সেই মিষ্টি সুর — তখন শুধুই উন্মনা। আমি জানি, আমি কবি উন্মনাকেই ফোন করছি । যাঃ , দিদিভাই , আমাকে কবি বললে কবিদের ছোটো করা হয় । আমি একটু-আধটু লিখি , এইমাত্র। সব বাঙালি ছেলে মেয়েরাই প্রথম জীবনে কবিতা লেখে। আসলে বাংলা এত মধুর ভাষা যে , মনের ভাব সবাই প্রকাশ করতে চায় কবিতায় কবিতায়। আর , আমি তো বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি ; তার আগে মেদিনীপুর কলেজে । কাজেই কবিতা নাটক গান মানুষের মিছিল সব কিছুতেই আমি অংশীদার ছিলাম। আশ্চর্য লাগছে যে তুমি আমার খবর কী করে পেলে ? ও প্রান্ত থেকে আবার চুড়ি ভাঙা গলায় উত্তর — ধীরে রজনী ধীরে । অপেক্ষা করো। তোমার খবর পেয়েছি …ও সরি , তার আগে নিজের পরিচয়টা দিই । আমি কলকাতার এক সাংবাদিক। আমার নাম মেঘলা। আমি কোন পদবী ব্যবহার করিনা। শুধু মেঘলা। মেঘ মেঘ মেঘ মেঘ মেঘলা আমি /বৃষ্টি শেষে অস্তগামী। দেখেছো , সাংবাদিকতা করলেও কেমন কবিতায় কথা বলি । এবার আসি আসল কথায়। আমাদের একটা কবিতা-বন্ধু গ্রুপ আছে। তার মধ্যে আমার সমবয়সী বন্ধু, তোমাদের জেলার সাংবাদিক অমলেন্দু মন্ডল যেমন আছে, তেমনি রয়েছে জঙ্গলমহলের বেলপাহাড়ি ফুলকুসমা অঞ্চলের দুই তরুণ কবি প্রলয় ও শুভব্রত । দুজনেই দারুণ লেখে , বিশেষ করে প্রলয়। এবার উন্মনা হেসে উঠলো — ও দিদিভাই , ওরা তো আমার খুব প্রিয় কবিবন্ধু , দুই দামাল ছোটো ভাই । শুভব্রত চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে , তবু কবিতা আঁকড়ে বেঁচে আছে । নিজে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করে । আর , বেলপাহাড়ির প্রলয় ? সে তো নিজেই আমাদের কত জানা অজানা কাহিনী তুলে ধরেছে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। ও তখন ঝাড়গ্রামের একটা ছোটো সংবাদপত্রে সাংবাদিকের চাকরি করতো। এতদিনে ওর অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে ও এখন একটু থিতিয়ে গেছে,স্তিমিত হয়ে আছে।কিন্তু দারুণ কবিতা লেখে। আমাদের কাছে , মানে গোটা বাঁকুড়া পুরুলিয়া পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রলয় দারুণভাবে পরিচিত । কবিতা নিয়ে লড়াই করা কবি ও সম্পাদক শুভব্রতও সবার প্রিয়। আমাদের বাড়িতে মাঝেমাঝে ওদের পায়ের ধূলো পড়ে । আমার হাতের রান্না , লালশাক , বড়িভাজা আর মায়ের বানানো কাসুন্দিতে ওদের কবিতার সুগন্ধ লেগে থাকে । তুমি ওদের কথা বলছো দিদিভাই ?
বাব্বা ! মেঘলা অবাক হয়ে বলে– আমি তো তবু শোকেস এর বর্ণনা দিচ্ছিলাম , তুমি তো একেবারে গোডাউনটাও খুলে দিলে ! ওদের সঙ্গে তোমার মতো আমার এতটা ঘনিষ্ঠতা নেই। আমার বন্ধু অমলেন্দুর মাধ্যমেই আলাপ শুধু । তাও ফোনে ফোনে । এখনো চোখে দেখিনি , শুধু বাঁশি শুনেছি। বাই দা বাই,তুমি কবি ,সাংবাদিক অমলেন্দু মন্ডলের নাম শোনোনি ? তুমি – আমি আমরা সবাই তো একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। আমাদের বাংলা বিভাগের পাঁচ বন্ধু জার্নালিজম পড়ার জন‍্য কলকাতায় চলে গেলাম। তুমি আমাদের অন্তত সাত-আট বছর পরে বিদ‍্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছো।উন্মনা ধীরে ধীরে জবাব দিল- অমলেন্দুবাবুর কথা আমি নিশ্চয়ই শুনেছি। উনি আমাদের জেলার লোক।তার বেশি কিছুই জানিনা।তাছাড়া ইউনিভার্সিটিতে আমাদের স্ট্রিম ছিল পিওর সায়েন্স। মাঝখানে আমার বিবাহিত জীবনে আমার জেলা বাঁকুড়ার সঙ্গে যোগাযোগটা কমে গেছিলো। যাক, ওসব কথা পরে হবে , তোমার কথা বলো।
শোনো উন্মনা –মেঘলা আবার হারানো কথার খেই ধরে নেয়। ওই দামাল দুটো ওদের আইকন কবি ও সাংবাদিক অমলেন্দুকে নিয়ে আমার সঙ্গে একটা ষড়যন্ত্র করেছে। আগামী ডিসেম্বরের শেষ রবিবার ঝাড়গ্রাম শহরের কাছাকাছি শালজঙ্গল ঘেরা একটা স্কুলের উঠোনে আমাদের সারা দিনের কর্মশালা আর কবিতা যাপন। উন্মনা একটু অবাক হয়। কর্মশালা ? সেটা আবার কি ? মেঘলা এবার সিরিয়াস হয়ে গেলো। আসলে অমলেন্দু মানুষটা একটু অদ্ভুত। সাংঘাতিক ভাল লেখার হাত , কবিতা বলার কণ্ঠ ,অভিনয়ে দক্ষতা ; সবকিছু থাকা সত্ত্বেও জঙ্গলমহলের একজন খুব সাধারণ সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। কিন্তু অগাধ জ্ঞানের ভান্ডার । যদি কেউ টোকা মারতে পারে, তাহলে একেবারে সেই আলিবাবার চিচিং ফাঁক , চিচিং ফাঁক ,চিচিং ফাঁক ….
ব্যস ! মণি মুক্তোর গুহার দরজা খুলে যাবে। সেখানে কত ধন-সম্পদ ! শোনো উন্মনা , ও দু’তিনটে প্রান্তিক জেলার তরুণ কবিদের নিয়ে কিছু কথা বলবে । সেই কথার মধ্যে থাকবে বাংলা ছন্দ নিয়ে ওর গভীর জ্ঞান ,আর কবিতার মুহূর্ত কেমন ভাবে তৈরি হয় সেই সব কথা । জানো ,অমলেন্দুর ঝোলা ব্যাগের মধ্যে সব সময় বই খাতা পেন থাকে ; আর সেখানে ওর প্রিয় কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের অভিযাত্রিক বইটাও থাকে। তুমি অভিযাত্রিক পড়েছো ? উন্মনা এবার সহজ হয়ে বললো– দিদিভাই আর পাঁচটা বাঙালি ছেলেমেয়ের মতো, খুব অল্প বয়স থেকেই মা আমাকে বিভূতিভূষণ ধরিয়ে দিয়েছে। তাই পথের পাঁচালী, অপরাজিত ,আরণ্যক , দৃষ্টি প্রদীপ যেমন পড়া ,তেমনি পথের মহাকাব্য অভিযাত্রিকও আমি বহুবার পড়েছি। তবে , সেই বই কেউ ব্যাগে নিয়ে ঘোরে , এটা জেনে খুব ভালো লাগলো । একটা কথা বলি দিদিভাই — ঐদিন হয়তো আমার যাওয়া হবেনা । আমার মেয়ের বয়স পাঁচ বছর । আমার মা প্রায় সিনিয়র সিটিজেনশিপের কাছাকাছি বয়সে। আমার এখান থেকে ঝাড়গ্রাম তো অনেকটা দূর । হয়তো সেদিন ফিরতে পারবো না। ওদের ফেলে রেখে তো আমি যেতে পারবো না দিদিভাই। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কখনো কিছু হলে ফোন করে জানিও , যাবো। আচ্ছা, এটা কি তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার ? আমি সেভ করে রাখতে পারি ? মাঝে মাঝে কথা বলবো। আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে , কিন্তু কোনো উপায় নেই। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও দিদিভাই । তোমাকে আমি পরে ফোন করবো , মা বোধহয় আমাকে রান্নাঘর থেকে ডাকছে । কেন ডাকছে দেখি । এখুনি আমার কাছে টিউশন পড়তে আসবে বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে। তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে । আপাতত রাখি , মেয়েকে স্কুলের জন্য রেডি করতে হবে । তুমি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝো না দিদিভাই । ফোনটা কেটে গেল। মনে হয় মেঘলাদি গম্ভীর হয়ে গেল। মেঘলাদির মতো মানুষেরা বোধহয় অনুরোধের উত্তরে না শুনতে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু উন্মনার তো উপায় নেই । সবে সুস্থ হয়ে ওঠা মা কিছুতেই সারাদিন সারারাত ওইটুকু মেয়েকে সামলাতে পারবে না ।
রান্নাঘরে একমনে দুপুরের রান্না করতে করতে , দুবার হাতে ছ্যাঁকা খেলো উন্মনা। আজ কেন বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে ? বেলা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে বারোটায় পৌঁছলে , মাছের ঝোলের কড়াই থেকে একটা হাল্কা সুগন্ধ ভেসে আসে , প্রথম ওঠা ফুলকপি দিয়ে যখন রুই মাছ রান্না করা হয় । উন্মনা ভাবছিল স্নানে যাবে । মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে ছোট্ট সাইকেলটা নিয়ে উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় চেয়ারে বসে সামনে রাখা একটা টুলে পা তুলে দিয়ে , মা একমনে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে ডুবে আছে । অন্যমনস্কতায় মাছের ঝোলে কাঁচালঙ্কা দিতে ভুলে গেছিল উন্মনা। তরকারির ঝুড়ি থেকে দু একটা কাঁচালঙ্কা তুলে নিয়ে, ধুয়ে, আলতো করে ঝোলের মধ্যে ছেড়ে দিতেই , তারা সুন্দর করে সাঁতরাতে লাগলো । সেই দিকে তাকিয়ে উন্মনা কিছু একটা ভাবছিল… যদি কোনো ভাবে ম্যানেজ করে যাওয়া যেত কবিতার কর্মশালায় , কত কিছু জানতে পারতো ! এসব সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে আবার ফোনটা বেজে উঠলো। প্রত্যেক বেজে ওঠা ফোনে উন্মনা অপেক্ষা করে …আচ্ছা কার জন্য অপেক্ষা করে ? প্রাণতোষের জন্য ? সেই আশ্চর্য মধুর বিবাহবার্ষিকীগুলো , তোয়ার আগমনবার্তা , কত জায়গায় বেড়াতে যাওয়া , আরও কত সুসংবাদ , দুঃখযাপন…না না , এ ফোন তার স্বামীর হতেই পারে না । কারণ , সেই ‘হারানো সুর’ সিনেমার মতো তার স্বামী তাকে ভুলে গেছে। ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল । এবার তাড়াতাড়ি ধরতেই , ও প্রান্ত থেকে হই হই করে উঠলো প্রলয় । দিদিভাই, তুমি এত বোকা কেন ? তোমাকে কেউ ঘর থেকে বার করতে পারবে না, তুমি এটা মনে করলে কী করে বলতো ? বিশেষ করে আমি আর শুবব্রত যখন আছি ! তাও তো এখনো অমলেন্দুদাকে দিয়ে তোমাকে ফোন করাইনি । ওইসব না-টা বলা ছেড়ে দাও। তোমাকে আসতেই হবে। মাসিমা-মেয়েকে নিয়ে তোমাকে আসতেই হবে ঝাড়গ্রামে। আমরা হোটেলের কয়েকটা রুম বুক করে রেখেছি । আমি জানি তোমার পক্ষে ঝাড়গ্রাম থেকে সন্ধের পর ফেরা অসুবিধে । হয় তোমাকে বেলপাহাড়িতে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো , তা নয়তো ঝাড়গ্রামে থেকে যেও। পরের দিন ফিরবে । আমরা সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেবো । আমি সিওর এই কবি সম্মেলনের অভিজ্ঞতা তোমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । দিদিভাই , তোমাকেই তো সারাদিন ধরে গোটা অনুষ্ঠানটা বুনে তুলতে হবে কথা আর কবিতা দিয়ে ; যেটা তুমি খুব ভালো করেই পারো। আমরা তো সেইরকমই ভেবে রেখেছি। আর যতক্ষণ আমি আর শুভব্রত তোমার পাশে আছি তুমি জানবে তোমার কোন ভরসা নেই । এবারে অ্যাঁ বলে চিৎকার করে ওঠে উন্মনা । না না , সরি সরি । গলায় বানিয়ে তোলার দুঃখ ঝরে পড়ে প্রলয়ের । ভরসা নেই বলতে চাইনি । আসলে বলতে চেয়েছি ভয় নেই । শোনো তোমাকে যেতেই হবে — এই মানসিক প্রস্তুতি নাও । আজ রাত সাড়ে নটা তিরিশে আমি আর শুভব্রত তোমার সঙ্গে কনফারেন্স কলে কথা বলবো। উন্মনা আবার আকাশ থেকে পড়ে। সাড়ে নটা তিরিশ ? মানে ? প্রলয় এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে–আচ্ছা টিউবলাইট তো তুমি দিদিভাই ! সাড়ে নটা মানে নটা পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ , যা খুশি হতে পারে ; কিন্তু সাড়ে নটা তিরিশ মানে কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজতে আধ ঘণ্টা আগে । বুঝতে পেরেছো ? তোমার সব ঘেঁটে দিলাম তো আমি ? ঠিক সময় তোমাকে ফোনে ডেকে নেবো । তুমি তোমার ফোন আর মন দুটোই খালি রেখো । এখন রাখছি । এক্ষুনি একটা নিউজ
কাভার করতে মুকুটমনিপুরের দিকে ছুটতে হবে । রাখলাম। রাতে কথা হবে…

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।