ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ৫)

রূপকথা পৃথিবীর – ৫ 

তাইতো এখন সব কুঁড়িদের, কচিপাতাদের কানে ,
আকাশ বলেছে বৃষ্টি আসবে , মেঘে ঢেকে দেবে রোদ ,
সরষে ফুলের নরম ছোঁয়ায় ,মাঠের অঢেল ধানে ,
এই জন্মের মানুষ করবে, জন্মের ঋণ শোধ ।
যাক যা বলছিলাম।কী যেন বলছিলাম ! ও হ‍্যাঁ ,মনে পড়েছে । খেলার মাঠের গল্প ! বাড়ির সবাই আমায় চেপে ধরলো আজকের ফুটবল ম‍্যাচের গল্প শোনার জন‍্যে। দিদি এবার সময় বুঝে একটা মোক্ষম চাল ছাড়লো । সবাইকে উদ্দেশ্য করে যেন শূন‍্যে ছুঁড়ে দিলো কথাটা। জানো ,ঝন্টু আজকে একটা নতুন গান তুলে এনেছে খেলার মাঠ থেকে । ব‍্যস ! আমার দারুণ গল্পের মজাটাই দিলো নষ্ট করে । এই হচ্ছে বড়দের দোষ । কোথায় আমি নিজে ব্যাপারটা বলবো , তা না , আগে থেকেই রহস্য ফাঁস করে দিলো ? অথচ শার্লক হোমস পড়ার সময় (বঙ্গানুবাদ ) আমাকে কোনো গল্পই শোনায় না ।বলে , নিজে পড়ে নিবি । কী আর করি ! বলে ফেলতেই হল মাঠের অভিজ্ঞতা। তাই শুনে মণিমামার কী আনন্দ! বড়দি ,বলছিলাম না , শ্যামল মিত্রের গানটা এবার দারুণ হিট করবে ! দুই ভাইবোন মিলে আমাকে চেপে ধরে পুরো গানটাই গড়গড় করে লিখিয়ে নিলো , আর আমিও তেমনি কমা দাঁড়ি ফুলস্টপসহ লিখে গেলাম। বাবা আমার দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে বলল –তুই খেলতে খেলতে পুরো গানটা তুলে নিয়েছিস ? আমি গম্ভীর হয়ে বললাম– খেলতে খেলতে নয় , খেলার ফাঁকে। আমি মোটেই খেলাতে ফাঁকিবাজি দিই না । বাবা এবার চেপে ধরল — খেলার ফাঁকেই বা কী করে শুনলি ? তখন তোদের কমলদা কোচিং করছিল না ? তুই সেগুলো না শুনে গান শুনেছিস ? অবাক হয়ে বললাম, খেলার মাঠে প্রত্যেকদিন কথাগুলো শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে । ওই যে তুমি আমাদের যখন বকো ,দাদা বলে না , যে , বাবা এত কষ্ট করো
কেন ? কথাগুলো একবারেই টেপ করে রেখে দিতে পারো তো । সময় হলে বাজিয়ে দেবে ।তোমারও কষ্ট কম হবে, আমরাও বেঁচে যাব। সবাই হো হো করে হেসে উঠল । মণিমামা কিন্তু তারই মধ্যে হারমোনিয়ামে তুলে নিয়েছে গানটা । মা উন্মুখ হয়ে বলল — মণি, গানটা একবার শোনা তো । ও হ‍্যাঁ , বলতে ভুলে গেছি, যখন গানটা আমি মণিমামার খাতায় লিখে দিচ্ছিলাম , তখন তেমন লজ্জা পাইনি ; কিন্তু , মণিমামা যেই এবার গানটা ধরলো , আর গানের সেই জায়গাটা এলো — ধরা পড়ে গেছি আমি নিজেরই কাছে ,জানিনা তোমার মনেও যে এত প্রেম আছে — অমনি কটমট করে দিদির দিদিগিরি করা তাকানো সরাসরি আমার দিকে । দাদার ফিকফিক ফিচেল হাসি , বাবার অন্যমনস্কতার ভান করে বইয়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া , আর , মায়ের যেন কিছুই হয়নি , এমন একটা ভাব ।আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি । আসলে ‘প্রেম’ শব্দটা বললেই , কেমন যেন একটা ……
যাই হোক ,গানের আসর ভেঙে যাওয়ার পরে , মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ইলিশের ভাপা , সঙ্গে মাছভাজা, ইলিশের তেল আর গরম গরম ভাত —– মা যেন নিমেষের মধ্যে সব বানিয়ে ফেলল ! আসলে আমাদের মতো বাড়িতে তো ফ্রিজ থাকেনা । চন্দনদের বাড়িতে থাকে । ওদের সাদা রংয়ের ফ্রিজ দেখলেই আমার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করে ;আর , চন্দনের মা আমাদের জন্য আইসক্রিম বানিয়ে রাখেন । সে ভারি মজা । আচ্ছা নাই থাকলো ফ্রিজ । এত বড় ইলিশকে ঘিরে আমাদের সে রাতের পিকনিক দারুণ জমে গেল ! তারপর নতুন জামার গন্ধ শু়ঁকতে শুঁকতে টানা লম্বা ঘুম ।
পরের দিন স্কুলে যেতেই বজ্রতে মস্তকপাত (মোটেই ভুল বলিনি । আমরা ওইভাবেই বলে থাকি । সবকিছুকেই উল্টে দেওয়া আমাদের স্বভাব ।যেমন একটা উদাহরণ দিই । চেনা বামুনের পৈতে লাগেনা। আমরা বন্ধুদের মধ্যে মোটেই তা বলি না। আমরা বলি চেনা পৈতের বামুন লাগেনা )। প্রেয়ারের পরে ক্লাসের দিকে সবে পা বাড়িয়েছি ,বংশী যে খবরটা দিলো , সেটা শুনেই আমার আক্কেল গুড়ুম। হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে বংশী আমার পেটে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বললো — ওরকম হাবাগোবার মতো চেয়ে আছিস কেন ? শোন , ভালো করে শোন । অঙ্ক পরীক্ষা যা হওয়ার হবে । আজকে বাড়ি ফিরেই
সাহাদার স্টুডিওতে যাবি । তারপর পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলবি ।ফটো লাগবে প্রত্যেকের। মানে ডানপিটে ক্লাবের সব খেলোয়াড়দের । আমি এমন ভাবে ‘কেন’ শব্দটা বললাম , যেন এই মাত্র জন্মগ্রহণ করলাম পৃথিবীতে ! বংশী ধমকের সুরে বলল, কমলদা এসে বলে গেল । কোথায়? স্কুলের গেটে এসে দাঁড়িয়েছিল তোর জন্যে ।তুই দেরি করলি কেন ? এক্ষুনি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে , যা বলছি ভালো করে শোন। সন্ধেবেলায়় ফটো তোলাবি নিজের ।দুদিনের মধ্যে আর্জেন্ট ডেলিভারি নিবি। আমাদের প্রত্যেকের সার্টিফিকেটে সেই ছবি থাকবে । আমি আবার বোকার মতো বলে ফেললাম — যদি ফাইনালে হেরে যাই ? বংশী আরও তেরিয়া হয়ে জবাব দিলো — দূর বোকা ! জিতলেও পাবি , রানার্সআপ হলেও পাবি । এটাতো সার্টিফিকেট । দারুণ জিনিস ! সারাজীবন বাড়িতে ব়াঁধিয়ে রাখতে পারবি । আর , ফাইনালে কে মাঠে চিফগেস্ট হয়ে আসছে জানিস ? চুনী গোস্বামী রে পাগলা , চুনী গোস্বামী ! ব্যস , আমার মাথায় সবকিছু ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। চুনী গোস্বামী ফাইনাল খেলা দেখতে আসবে ? আমাদের ? আমি পাগল না বংশী পাগল !

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।