সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ৩০)

ঘণকবাদ (Cubist movement)

ঘণকবাদ আমরা যাকে বলি, ইংরেজিতে কিউবিস্ট আন্দোলন (Cubist movement), তা ১৯০৮ এর আগেই ছিল। কুয়াশা মগ্ন।

পল সেজান ১৮৯৫ এর দিকে অনেক স্টিল লাইফ নিয়ে কাজ করেন। সেই কম্পোজিশান গুলিতে জ্যামিতিক প্যাটার্ণ ও বস্তুগুলিতে জ্যামিতিক রূপকল্প দেন।  এবং এইসব তখন একদম কুমারী বিশুদ্ধতা শিল্প প্রেমীদের মনে আনন্দ দিয়েছিল। সেখান থেকে পিকাশোর ঘণকবাদ ভাবনা, ও তা তার নিজস্বকায়দায় প্রয়োগ এক নতুন দিশা দিয়েছিল। ১৯০৭ এই সময়, আগে পড়ে  ক্যানভাসে বস্তু বা ফিগারে কিউব Cube বসিয়ে ছবি নির্মাণ একটা চমৎকার  বা যাদুর মত দর্শকের চোখ আকৃষ্ট করে।

এই সময়টা বড় গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ, ইউরোপে বিশেষ করে প্যারিস্ স্পেন ইতালী জার্মান প্রভৃতি দেশের শিল্পীরা কে কত বেশী নিজেকে প্রদর্শন করতে পারে, ছবি ভাস্কর্যে তার একটা হূড়োহুড়ি পড়ে গেছিল। লোক বা দর্শককে কে কত বেশী মন্ত্রমুগ্ধ করে নেবে যেন তার লড়াই চলছিল। একঝাঁক  তরুণ প্রতিভা, তারা গতানুগতিক ছবি না এঁকে নিজেদের ভাবনা বা মেধার প্রকাশ চাইল।(André Derain, Henri Matisse. Albert Marquet, Charles Camoin, Louis Valtat, Jean Puy, Maurice de Vlaminck, Henri Manguin, Raoul Dufy, Othon Friesz, Georges Rouault, Jean Metzinger, Kees van Dongen and Georges Braque) তারা ইতিমধ্যে ফভিজম নিয়ে প্রাণচঞ্চল, ১৯০৬ /৭ প্যারিসে প্রদর্শনী করছে, সম্মেলক বা যূথবদ্ধ হয়ে। সবার বয়সের গড় কাছা কাছি ৩৫ থেকে ৪০ বছর। সবাই অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ ও দক্ষ। পিকাশো তার নীল ও গোলাপী ধারার চেয়ে ফভিজমে চলে এসেছে। এবং আগে পিকাশো আর্থ কালার earthy colours দিয়ে কাজ করতেন। সেখান অ থেকে উজ্জ্বল রঙ তার প্রিয় হয়ে উঠল। আর্থ কালারে আগে প্রচলন ছিল। মাতিশও আর্থ কালারে কাজ করতেন। হঠাৎ অনুজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলে আসার প্রবণতা মাতিশ থেকেই।
 পিকাশো তখন ছবিতে শব্দ অক্ষর বসাতেন। বস্তুকে সরাসরি না এঁকে তার একটা আদল দিয়ে,বা একটা আদরা বস্তুর সম্পর্কে ধারণা দেবে, বস্তুকে  আঁকা অপ্রয়োজনীয়  (which referred to concepts of objects rather than the objects themselves.)।কখনো স্টেনসিল stencilled ব্যবহার করে, বিমূর্ততা নিয়ে ঘণক ধর্মী ছবি আঁকা শুরু করেন। উদ্দেশ্য, জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তিনি ছবি অর্থবহ হবে। বা ছবিতে গল্প থাকবে এমন কোন ভাবনায় যাননি। তিনি শুধু তার অভিনবত্ব দিয়ে নতুন দৃশ্য দেখাতে চান , মানুষকে আনন্দ দিতে চান। তার এই ভাবনা, ব্যবসায়িক ভাবে সফল হয়েছিল, মিডিয়ার উপস্থিতি টানতে পেরেছিল। পরে তিনি কোলাজ ও বস্তুর বাস্তবিক রূপ, ও রেখা দিয়ে সাথে যোগ করেন বৌদ্ধিক বা বুদ্ধিজাত ভাবনার মিশ্রণ। পিকাশো সারা জীবন নানা পরীক্ষা বা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। সরাসরি অন্যের ছবি ভাস্কর্য কে নিজের কাজে ব্যবহার করেন কখনো ভাবনাকে। ছবি আঁকা, ভাস্কর্য গড়া ইত্যাদি নানা ভাবে করলেও ঘণক প্রকৃতি তার ছবিতে নানাভাবে থেকেছে। এবং এটা তিনি বাতিকগ্রস্থের মতো নিজেকে করে তুলেছেন। মানব যন্ত্রের মত ছবি এঁকেছেন, প্রচুর। সংগ্রাহক ছিল প্রচুর। চাহিদা গড়ে উঠাতে, তিনি যখন যেখান থেকে পেরেছেন ভাবনা বা রূপ ধার নিয়েছেন।
ফভিজম Fauvism হ’ল ১৯০৫ থেকে ১৯১০ সালের একদল শিল্পী (যার মধ্যে হেনরি ম্যাটিস এবং আন্ড্রে ডেরিন (Henri Matisse and André Derain)ছিলেন) যাদের রঙ ছিল উজ্জ্বল আর তুলির মারাত্মক আঁচর থাকত। যেমন নীচে দেখানো কাজ গুলি

কিউবিজমের আগে ফভিজম Fauvism। Fauve মানে হল বাঁধ ভাঙ্গা বন্যতা।”Wild And Uninhibited.”। আরো সহজ ভাবে বললে, আক্ষরিক অর্থ হল, বুনো, হিংস্র, বা বুনো জন্তু। যার মধ্যে সংযম নেই।  যেমন জংগলে যে জিনিস তড়িৎগতিতে ইন্দ্রিয়গোচর হয়। কথাটা ছবির জগতে প্রসিদ্ধি পেয়েছিল, ১৯০৫ সাল নাগাদ। যখন কিছু শিল্পী তাদের গ্রুপ প্রদর্শনীতে উজ্জ্বল রঙয়ের সমাহার রেখেছিলেন। আর ছবিগুলি একদম সাধারণ গোছের। রূপকল্প তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এই গ্রুপে Matisse, Vlaminck, এবং Derain এর মতো শিল্পীরা ছিলেন। তাদের বয়েস তখন ২৫ থেকে ৩৫। এক সমালোচক Louis Vauxcelles প্যারিসে করা গ্রুপ প্রদর্শনীতে গিয়ে ১৫ শতাব্দীর এক ইতালীর শিল্পীর মতো এক স্ট্যাচু দেখতে পান। তিনি কমেন্ট করেন “Donatello au milieu des fauves!” (“Donatello among the wild animals!”) দোনাত্তেল্লো (Donato di Niccolò di Betto Bardi, better known as Donatello)ও এই বুনো জন্তুদের মধ্যে আছে!। তিনি রীতিমত উৎকন্ঠিত হন। তিনি বলতে চান, অপ্রচলিত উজ্জ্বল রঙ আর রূপকল্পের সরল ব্যবহার- মানে যার যা ইচ্ছা তাই যেন স্বাধীনভাবে করেছে। (wild brush work and strident colors, while their subject matter had a high degree of simplification and abstraction)।
সমালোচকের এই ভর্ৎসনা ‘বন্য জন্তু’ ফরাসী ভাষায় ফভ মাতিশদের চিহ্নিত করেছিল ফভিস্ট শিল্পী বলে।
মোটামুটি এইভাবে বিংশ শতাব্দীর শুরুটা শিল্প আন্দোলন এমনই ছিল।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।