সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিজয়া দেব (পর্ব – ৪৩)

গোপনে গড়েছে কত স্বপ্নিল সাঁকো

এই খন্ড বিখন্ড জীবনে একজায়গায় স্থির হয়ে থাকা যায় না। কখনও বর্তমান,  কখনও ইশকুল জীবনের শেষ পর্যায় কখনও ছুটি এসে হাত ধরে। সোস্যাল মিডিয়ায় মোটিভেশনাল টক শো তে শুনি, শুধু বর্তমানকে নিয়ে ফোকাস করতে বলা হচ্ছে, না অতীত, না ভবিষ্যৎ।  ভালো কথা, এতে যদি ভালো থাকা যায়, বেশ কথা। কিন্তু যদি জ্বলন্ত বর্তমান অতীতের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ইতিহাস ভুলে যেও না।  তখন তো অতীতের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে।
ছুটি,  ছুটি এসে আবার হাত ধরে। কলমে হাত রেখে বলে – ভুলে গেলে সেই সত্তরের দশক!
বাড়িতে রেডিওর সামনে বসে থাকে সবাই। সুধাময়কে চিন্তিত দেখায়, মা- ও কী সব ভাবেন। যখন সংবাদ পরিবেশন হচ্ছে বাবা বড়দা মা রেডিওর সামনে এসে বসেন।  পুব পাকিস্তানের এক রাজনৈতিক দল ভোটে জিতেছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান তাঁকে মেনে নেয়নি। পুব পাকিস্তানের নেতা ভাষণ দেন ভরাট কণ্ঠে। জনতা জয়জয়কার দেয়। অনেক নতুন গান রক্তে মাতন ধরিয়ে দেয়। একটা শব্দ চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে – মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ.. যুদ্ধ – যুদ্ধবিমান উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। রূপমতী চা বাগানের কারখানার গেটের কাছে ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে।  বোমা নাকি পড়তে পারে। যুদ্ধ তো কত দেখেছে ছুটি পুজোর সময় যাত্রাপালায়। তবে সে যুদ্ধ রাজায় রাজায় হয় তলোয়ার দিয়ে। আবার প্রবাদ প্রবচনে সে পড়েছে “রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাঁধে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।”
দেখতে দেখতে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। শরণার্থীর ভিড়। ভারতে অনেক শরণার্থী শিবির খোলা  হয়েছে। এক নিবিড় সন্ধ্যায় এক খুনখুনে গলা বুড়ি আধময়লা থানকাপড় পরনে একগলা ঘোমটা দিয়ে ঢুকল ছুটিদের কোয়ার্টারে। লম্বা উঠোনের একপাশে তুলসীগাছের নীচে মা তখন প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রণাম করছেন। ছুটি ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলে “মা”। বুড়ি কি একটা বলে নমস্কার জানাল। কথাটা ঠিক বোঝা গেল না। প্রতিটি শব্দের আগে ‘নঞ’ বসিয়ে কথা বলে। তবে মাঝে মাঝে “আগুন “শব্দটা কানে বাজছিল। তারপর বলল – দু’ খান মুড়ি দ্যান মা জননী।  মা মুড়ি মেখে একবাটি খেতে দিলেন। বাইরে পথের পাশে তখন চা বাগানের হাট বসেছে। বুড়িটা মুড়ি খেয়ে উদভ্রান্তের মতো চলে গেল।
মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন।
ছুটি জিজ্ঞেস করল – কি হয়েছে মা? কথা তো কিছুই বুঝতে পারলাম না।
মা বললেন – কী দুর্ভাগ্য মানুষের যারা এদেশে জন্মেছে।
ছুটি বলল – মা, এই কি শরণার্থী?
– হ্যাঁ। কোথায় যাবে কোথায় যাচ্ছে এই রাতে। মনে হয় পরিবারের সকলকে হারিয়ে ফেলেছে।
কী ভাষায় কথা বলল? নোয়াখালী?  চট্টগ্রাম?  মৈমনসিং?
সন্ধ্যা সাতটায় নিউজ শুরু হয়েছে – “আকাশবাণী!  খবর পড়ছি নীলিমা স্যান্যাল…ভারতের শরণার্থী শিবির বেড়ে সংখ্যায় বাড়ছে… মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে…
মা বলেন – পড়তে বোস ছুটি।
ছুটি পড়তে বসেছে। কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্পের আলোয় চারপাশে অদ্ভুত আলোছায়া।  ছুটির শুধু মনে হয়- সেই খুনখুনে কন্ঠ – নাকি সুরে বলছে,  আগুন মা আগুন… এই অন্ধকার রাতে বুড়ি কোথায় গেল! বুড়ি কি মানুষ,  নাকি ভূত! বুড়ি কি প্রেতাত্মা?  ওই যে রেডিওতে বলল – যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে…  সেই মৃতদের মধ্যে কেউ কি?  ভেতরটা কেঁপে ওঠে। ভয়ে সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে যায়। এই সময়ে দরজায় খুট করে শব্দ। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ছুটি আপাদমস্তক সাদা কেউ দাঁড়িয়ে দরজায়। ছুটির অবশ দেহ এলিয়ে পড়ে,  কিছুক্ষণ পর টের পায় কেউ তার সর্বাঙ্গ নাড়িয়ে দিয়ে বলছে – ছুটি,  ছুটি,  আমি রে আমি।  এই ছুটি,  সেরেছে। বাবা শুনলে রেগে উঠবেন।  মজা করছিলাম,  এই ছুটি,  চোখ খোল প্লিজ!
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।