কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ২

বাংলার ভুঁইয়াতন্ত্র

বারো ভূঁইয়ার প্রতাপ এবং দাপট ব্যাখ্যা করতে গেলে একে একে বাংলার বিভিন্ন পরগনাগুলির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা অত্যন্ত জরুরি। এই বারো ভূঁইয়ারা মূলত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আধা-স্বাধীন রাজন্যবর্গ হিসেবে নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা একদিকে দিল্লির বা গৌড়ের সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করতেন বটে, কিন্তু অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের উপর তাদের ক্ষমতা ছিল প্রায় স্বৈরতান্ত্রিক। এদের মধ্যে একধরনের আত্ম-অহমিকা এবং শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইও চলত সর্বদা। যেসব ভূঁইয়ারা নিজেদের অঞ্চলকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন, তারা ক্রমেই ইতিহাসে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন।

এইসব ভূঁইয়াদের মধ্যে সোনারগাঁয়ের ইশা খাঁ এবং যশোরের প্রতাপাদিত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের নিয়ে আজও বাংলার ঘরে ঘরে নানা কথা প্রচলিত আছে। অনেক ক্ষেত্রে লোককথা ও লোককাহিনীর আকারে এই কথাগুলি রূপান্তরিত হয়েছে, যা থেকে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য আলাদা করা কঠিন। তবে এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইশা খাঁ এবং প্রতাপাদিত্য ছিলেন এক অসাধারণ কৌশলী এবং প্রভাবশালী শাসক। এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যেই ফুটে ওঠে বাংলার আঞ্চলিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব, একতা এবং বিদ্রোহের কাহিনি।

প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে বিশদে জানার জন্য আমাদের প্রথমেই যশোর রাজ্যের ভূগোল এবং তার রাজপরিবারের উত্থানের ইতিহাস জানতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশে ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমার মধ্যে অবস্থিত চন্দনা নদী, যা পদ্মার একটি শাখা নদী, তার তীরে একসময় ছিল চন্দনা গ্রাম। এখানেই এক সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবার — গুহ পরিবার — বাস করত, যারা সাঁতোড়ের রাজাদের অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন।

এই গুহ পরিবার থেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্রের উত্থান ঘটে — রামচন্দ্র গুহ। তিনি সাঁতোড়ের রাজা দ্বারা ‘নায়ক’ পদে অভিষিক্ত হন এবং রাজ্য প্রতিনিধি হিসেবে গৌড়ের সুলতানের দরবারে পাঠানো হয়। রামচন্দ্র গুহ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং কৌশলী। সুলতানের দরবারে তিনি নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে অতি দ্রুত সুলতানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একবার এই সুযোগ পেলে তিনি তার বংশের প্রভাব বাড়াতে কোনও কসুর করেননি।

রামচন্দ্রের পুত্র ভবানন্দ মজুমদার সেই উত্তরাধিকারের ধারক ও বাহক ছিলেন। ভবানন্দ নিজেও দক্ষ শাসক ছিলেন এবং তার বংশধরেরাই পরবর্তীতে যশোর রাজবংশের ভিত রচনা করেন। ভবানন্দের পুত্র শ্রীহরি, যিনি আবার মতান্তরে রায় বিক্রমাদিত্যের নামে পরিচিত, ছিলেন আরও পরাক্রান্ত। তাঁর পুত্র প্রতাপ রুদ্র ছিলেন সেই কিংবদন্তি চরিত্র, যিনি পরবর্তীতে ইতিহাসে ‘প্রতাপাদিত্য’ নামে প্রসিদ্ধ হন।

প্রতাপাদিত্য ছিলেন একাধারে রাজনীতি, যুদ্ধকৌশল এবং প্রশাসনিক দক্ষতার নিদর্শন। তাঁর রাজত্বে যশোর একটি সুসংগঠিত, সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তার রাজপ্রাসাদ, সেনাবাহিনী, জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযানের রণনীতি, এমনকি তার কূটনৈতিক সম্পর্ক — সব কিছুই ছিল সমকালীন বাংলা সমাজে অনন্য।

প্রতাপাদিত্য শুধু নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে গড়ে তুলতে চাননি, বরং তিনি চেয়েছিলেন বাংলার আঞ্চলিক রাজন্যবর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে। এই লক্ষ্যে তিনি ইশা খাঁর মতো অন্যান্য ভূঁইয়াদের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। কেউ কেউ বলেন, তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতা ছিল তার পতনের অন্যতম কারণ।

তবুও প্রতাপাদিত্যর গৌরব আজও বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তার বীরত্ব, রণকৌশল এবং শাসনদক্ষতা বারবার আলোচিত হয়েছে নানা ঐতিহাসিক দলিলে। যে সময় অন্যান্য ভূঁইয়ারা অন্ধ আনুগত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন, সে সময় প্রতাপাদিত্য নিজের প্রতিপত্তি ও রাজসিংহাসনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল বাহিনী এবং প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।

বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে অনেকের নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় হারিয়ে গেলেও প্রতাপাদিত্যর নাম আজও উজ্জ্বল। কারণ তিনি শুধু একজন শাসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সংগ্রামী চরিত্র, যিনি চেয়েছিলেন বাংলাকে নিজের কৌশল ও নেতৃত্বের মাধ্যমে গৌরবের শিখরে নিয়ে যেতে।

তাঁর জীবনী এবং রাজ্য পরিচালনার কাহিনি আমাদের শেখায় কিভাবে স্থানীয় শাসকরা দেশের ইতিহাসকে প্রভাবিত করতে পারেন। তাঁর মতো চরিত্ররা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস শুধু বড় সাম্রাজ্যের নয় — স্থানীয়, আঞ্চলিক বীরদের গল্পও তার অঙ্গ। প্রতাপাদিত্য সেই ইতিহাসেরই এক জ্যোতিষ্ক পুরুষ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *