• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ৬)

চললুম ইউরোপ 

‘ মা, কাল আমরা রাতে ক‍্যানাল ট‍্যুরে যাব, আজ আমি টিকেট বুক করেছি।
শোন বাবাকে রাজি করাবে.. বাবা তো আবার ঠান্ডায় বেরোতে চায় না ‘
আমি চুপ…. ছেলের কথা তো বাবার কানে ঢুকছেই !
পরদিন সন্ধে আটটা থেকে সাড়ে ন’টার জার্নি। একটু ঢোক গিলে বললাম তা কত দাম টিকিটের,মানে বাড়ি ফিরে তো আবার কেউ জানতে চাইতে পারে!
’24 ইউরো ইচ ‘
বাপরে প্রায় পনেরশ’ টাকা।যাই হোক এখন চুপচাপ থাকাই ভাল……।
সেন্ট্রাল পর্যন্ত ট্রামরাস্তার চারপাশ দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ…. রূপসি আমস্টারডাম আলোর মেকওভারে এক্কেবারে তিলোত্তমা থুড়ি ক্লিওপেট্রা।
হঠাৎ আমার খুব মন কেমন করে উঠল বাড়ির জন্যে। আমাদের দুগ্গাপুজোর আগে যেমন সাজোসাজো রব হয় ক্রীসমাসে দেখছি এদেরও তেমন হৈ হৈ রৈ রৈ !
তবে যাই বল আর তাই বল বাপু আমাদের সেই শরতের অপরূপ আয়োজন ……. আকাশের নীলে আর রোদের সোনায়.. সাদা মেঘে আর শিউলির গন্ধে সে এক পাগলকরা পরিবেশ। আর সর্বোপরি ব্রাহ্মমূহুর্তে সেই উচ্চারণ
” আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর ” ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় ! তবে এরা তো এসব পায় না তো কি করবে বল! তবে ডাচরাও তাদের আনন্দ সাজায় টুকরো টুকরো নক্ষত্রে। মানে আলোর নক্ষত্র। ওদেরও সারা বছরের জমিয়ে রাখা আনন্দ হীরের কুচি হয়ে ছড়িয়ে থাকে ক‍্যনালে, সৌধে রাস্তায় আর মানুষের চোখে মুখে।
লিফ্টে করে ক্রুজ স্টেশনে নামলাম। তারপর উঠে বসলাম…বাঃ দিব‍্যি গরম ভেতরটা! ছেলে কফি নিয়ে ঢুকল। বোটটা কাঁচের মত স্বচ্ছ ঢাকনা পরানো। মানে আমরা সব দেখতে পাবো কিন্তু জল থেকে কোন বরফের ছুরি ধাওয়া করতে পারবে না। বেশ বেশ। ইংরেজি আর ডাচ দুটো ভাষাতেই পর্যায়ক্রমে শুরু হল ধারাবিবরণী। কিন্তু শুনবো না দেখবো বুঝতে পারছি না। ভাষ‍্যকার বলে যাচ্ছে আমস্টারডামে নাকি ১৬৮টা ক‍্যানেল আর হাজার হাজার হাউসবোট আছে। তা তো থাকবেই, এদেশ তো অনেকটা সমুদ্র থেকে তুলে নেওয়া। তবে আমরা এমন হাঁসের মত ভেসে যাচ্ছি কি করে ! শুকনো পাতা যেমন নদীর জলে হেলে দুলে ভেসে যায় অনেকটা সেইরকম। ছেলেকে কানে কানে বললাম কিরে ইঞ্জিন নেই নাকি। ‘ উঃ মা সব আছে। এই ইঞ্জিন ইকো ফ্রেন্ডলি, ইলেকট্রিক ইঞ্জিন। নিঃশব্দে চলে। আমস্টারডামের আসল ভাইভ ফিল করা যায় এই ইভনিং ক্রুজে। এই জলের রাস্তাটা হ’ল গোল্ডেন এজ ক‍্যানাল বেল্ট ‘।
তবে শুনেছিলাম সিজনে কপাল ভাল থাকলে নাকি সূর্যাস্ত দেখা যায় বোট থেকে। তখন গলানো সোনা গড়িয়ে এসে ঝাঁপ দেয় ক‍্যানালের জলে। আলো এসে আত্মসমর্পণ করছে কালোর গভীরে…আহা! কত ইতিহাস আর সংস্কৃতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে এই ভেসে চলা। আমস্টেল রিভার, ভাসমান ফুলের বাজার,আশ্চর্য সব ব্রীজ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আলোর ফুল ফুটে আছে জলের শরীর জুড়ে, হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে রহস‍্যময় আইল‍্যান্ড।আর হাউসবোটগুলো আলোর ইশারায় কার প্রতীক্ষায় রয়েছে কে জানে!
হঠাৎ একটা জায়গায় ক্রুজ থেমে গেল আর বেশ কিছু ট‍্যুরিস্ট দেখলাম নেমে যাচ্ছে। এ‍্যানাউন্সমেন্ট শুনলাম
‘অ‍্যানা ফ্রাঙ্ক হাউস ‘। আচমকা একটা বিদ‍্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল শরীরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই নির্মম অধ‍্যায়, ইতিহাস… সব কিছুর ওপরে একটা কিশোরীর বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ ঝলমল করে উঠল।
তার হাতে একটা ডাইরি যা আজও পৃথিবীকে বিস্ময়মুগ্ধ করে রেখেছে।বিশ্বের প্রায় ১০০টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এই ডায়েরি। কি আছে এই ডায়েরিতে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নির্মম ইহুদিবিদ্বেষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে জন্মভূমি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা এক ইহুদি পরিবারের আত্মগোপনের রোজনামচা।
পরিবারের এক নির্ভীক কিশোরীর অনুভব আর দিনযাপনের হৃদয়স্পর্শী দলিল এই দিনলিপি। নিজের তেরো বছরের জন্মদিনে এই ডায়েরিটা উপহার পেয়েছিল অ‍্যানা তার বাবার কাছ থেকে। কালো অন্ধকার জীবনে এই ডায়েরিটা ছিল তার আলোর ডানা।
সে লিখেছিল,” When I write I can shake off all my cares “.
অ‍্যানা তার নাম দিয়েছিল “কিটি “। এই কিটি ছিল তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু যার কাছে সে তার সব অনুভব সব যন্ত্রণা এমন জীবন্ত করে রেখে গেছে যে সারা পৃথিবী আজও যেন শুনতে পায় তার দমবন্ধ দিনগুলোর কথা । মৃত‍্যুভয়কে নস‍্যাৎ করে তার বাঁচতে চাওয়াই মানুষ মনে রেখেছে। মনের মত কিছু কথা অ‍্যানা ধরে রেখেছে তার ডায়েরিতে।
এটা কি চমৎকার যে কাউকে এক মিনিটও অপেক্ষা করতে হয় না যদি সে পৃথিবীর ভাল করতে চায়
তোমার চারদিকে যে সৌন্দর্য বাকি রয়ে গেছে তার কথা ভাব আর সুখী থাক।

এটা খুবই আশ্চর্যের যে আমি আমার সব আদর্শ ছুঁড়ে ফেলে দিইনি যদিও সেগুলো মেনে চলা এত অবাস্তব আর অসম্ভব।কারণ সব কিছু সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি মানুষ সত‍্যিই সৎ ও হৃদয়বান।

বন্ধু কিটিকে সে বলছে “Can you please tell me
exactly what a bundle of contradiction is ? ”
নিজের দ্বৈত চরিত্রের কথায় সে লিখছে আমার চরিত্রের যে অপ্রিয়, অগভীর দিক দিয়ে লোকে আমায় চেনে সেটা আমার বাইরের দিক আর অন‍্যদিকে আছে আমার নিভৃত শুদ্ধ গভীর স্বভাব। তার হদিশ কেউ জানে না। সমস্ত নেদারল‍্যান্ড তখন আমার কাছে যেন আনেলিস মারি ফ্রাঙ্ক।
‘ মা ওমা , মা, কি ভাবছ… একটাও কথা বলছ না যে! ‘
ছেলের ডাকে সম্বিত ফিরল, মনে মনে ভাবলাম আমায় আসতেই হবে এই বাড়িতে যার নাম ……..
” Anne Frank House “

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।