সম্পাদকীয়

একটি না সম্পাদকীয় 

আহা! চারপাশে এত আ-আ-আ-আ-আ… পুরো হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির  রেশমি রেশমি সুর! বায়ুমণ্ডল থেকে নভোমণ্ডল অব্দি যতদূর শোনা যায় আ-আ-এ আনন্দ-ই আনন্দ! উপভোগ করুন, করতে অভ্যাস করুন! না হলে  পুজোর আনন্দই মাটি।
মা থ্রি -র জামানায় সরকারি অনুদানে সব মাখন মাখন।যে যতটা পারেন চেটে- লুটে নিন।পুজো হলো এক তৈল-প্রদান উৎসব! ঠিকঠাক ঢালতে পারলেই সব পুরো স্মুথ,মাখন- মাখন। ইচ্ছে মতন গিয়ার চেঞ্জে নো প্রবলেম। তেল(পড়ুন,মাল)ঠিকমতন ঢালতে না পারলে, প্রবলেম হি প্রবলেম।
‌পুজো এলেই অনেকদিন আগে শোনা, পদ্মর বাপের এই গল্পটা মনে পড়ে। আসুন, জেনে নিই সেই গল্পটি —
‌‌গরীব মানুষ পদ্মর বাপ।বুড়ো মা-বাপ,তারপর লাইগেশনের টাকার লোভে ও মায়ায় দুটি সন্তান আর ওরা দুজন।মোট এই ছজনের ছোট্ট সংসার।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পেশায় ক্ষেতমজুর। দিন আনে দিন খায়। পদ্মর মা তার থেকেই একটু একটু করে জমিয়ে-টমিয়ে রোগ-অসুখ, পরব-পাল সামলানোর চেষ্টা করে। সবসময় যে পারে তা বলা যায় না। তখন সুদে টাকা ধার নিয়ে গতরে বা শরীরে মেটাতে হয়।
‌কিন্তু দুগ্গাপুজোর সময় বাপের ঘর, নিজের ঘর সবাইকে একটা  কিছু-মিছু দেওয়ার চেষ্টা করেও পারে না।পরবে ওর শাড়িটা তাও ফিবছর, ওর বাবা দেয়। পদ্মর বাপ মানুষটা ভালো। সাধারণত পরব-পাল ছাড়া নেশাভাঙ করে না, নিজের শখ-আহ্লাদ বলে কিছু নেই, বাজে আড্ডা না দিয়ে অবসরে বিড়ি বাঁধে।
‌তো এই পুজোয় সবাইকে দিয়েথুয়ে যদি কিছু বাঁচে, তবে পদ্মর বাপেরও কিছু একটা জোটে। এবছর তার আর কিছুই জুটলো না।পুজোর আর মাত্র দুদিন বাকি।পদ্মর মায়ের মন খুব খারাপ।বলে, হ্যাঁ গো, আমরা সবাই নতুন কাপড় পরে ঠাকুর দেখতে যাবো আর তুমি…।  বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে। পদ্মর বাপ বলে, না গো অত মন খারাপ করো না। বলছো যখন, তখন আমিও একটা কিছু  নতুন কিনবো,চিন্তা করো না। ঘুমাও।কাল সকালে আবার কাজে যেতে হবে। এদিকে পদ্মর বাপ ভাবে, হাতে গোটা পঞ্চাশেক টাকা আছে  আর কাল যদি কাজ পায়, কাজ হয়, তবে আরো গোটা চল্লিশেক টাকা বাঁচাতে পারলে…পরশু পুজো। ভাবনায় বেচারার ঘুম হয় না।
‌পরেরদিন বউকে বললো,ভেবো না আমারও নতুন পোশাকই হবে। রাতে পদ্মর মা আবার জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ গো,কিনলে? জোরে, হুঁ গো বলে পদ্মর মাকে জড়িয়ে ধরে।
‌‌অষ্টমীর দিন, সন্ধি পুজোর সময়, ওদের গাঁয়ের এই পাঁচদিনের পরবে ভিড় সবথেকে বেশি হয়।সবাই মোটামুটি সেজেগুজে তৈরি। বের হবে এবার। পদ্মর বাপ চান করে এলেই বের হবে একসাথে।পুকুরে ডুব মেরে পদ্মর বাপও চলে এলো। তৈরি হয়ে-টয়ে বেশ কায়দা করে একটা টেরি কেটে বের হলো । পদ্মর মা বললো, কই গো, তোমার নতুন. ..!  কথা শেষ করার আগেই  পদ্মর বাপ বলে, আছে গো আছে। পদ্মর মা বলে, ইশ!লুঙ্গিটাও পুরনো আর জামা-গেঞ্জিটাও তো তাই! পদ্মর বাপ বলে, উঃ! আমি বলছি তো আছে, মানে আছে।ঠাকুর দেখতে যাওয়ার পথে পদ্মর মা সারা রাস্তা গজগজ করতে থাকে। তখন পদ্মর বাপ রহস্য ফাঁস করছে যেমন, তেমন ভাবেই ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বলে,আমি নীচে পরার একটু নতুন প্যান্ট কিনেছি গো! সন্দেহের চোখে পদ্মর মা তাকালে,লুঙ্গি তুলে পদ্মর বাপ নতুন আন্ডারপ্যান্টের নীচটা টেনে দেখায়। পদ্মর মা বলে, এ হে হে, তুমি আর রং পেলে না! পদ্মর বাপ জিজ্ঞেস করে, কেন কী হয়েছে!
‌ইশশশ!  লাল রং!  তারপর তোমার লুঙ্গি তুলে ওটা কে দেখবে শুনি?
‌পদ্মর বাপ বলে, হুঁ হুঁ বাওয়া, ঐ জন্যই তো লাল রং গো। দেখবে না সন্ধিপুজোর সময় লুঙ্গির ছোট গুঁজে এমন গড় করবো যে, গোটা গাঁয়ের লোক দেখতে পাবে আমার নতুন ঐ প্যান্ট।
‌আমআদমির তো পদ্মর বাপের অবস্থা। দেখনদারিতেই ব্যস্ত আমরা।কোনোকিছুরই  তল দেখি না, তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে। শুধুই জয় জয় করে যাই।কেউ জিতলেই আমরা সব এখন
জেতা-পার্টি হয়ে যাই। লুঙ্গি তুলে ছোট গুঁজে আমরা গড় করিনা  ঠিকই। কিন্তু অন্দর কি বাত আন্ডারে রেখেও আমরা হাসি হাসি ফাঁসি না চড়ে, সেল্ফি তুলে দেওয়ালে চিপকে দিয়ে কে কত দেশ বা দ্বেষ-কে ভালোবাসি জানানোর চেষ্টা করি, অন্যমতের হলেই, স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করলেই দেশবিরোধী উল্কি দেগে দেওয়া হয়। ‘মেরা ভারত মহান’ বা ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’-এর কিসসা তো পুরনো। এখন চলছে এন আর সি, কাশ্মীর,দেশের সোনা বন্ধক,জিডিপি পাঁচের নীচে, এসব শুনলে কানে তুলো নিতে হবে বলে কেউ বলেন নি কোনো রাতে বা বাতে। এখন শুধুই উল্লাসের উন্নয়ন-দিন।
যারা ৩৭০ তুলে নেওয়ার পর ভেবেছিলেন এবার কাশ্মীরে জমি কিনে, সুন্দরী কাশ্মীরী এক মেয়েকে বিয়ে করে জীবনটা কাটিয়ে দেবেন, তারা তো কাশ্মীর যাওয়ার টিকিটই পাবেন না।আর পেলেও আটকে যেতে হবে লক্ষ্মণরেখায়। ওদিকে আবার পাকিস্তান পারমানবিক জুজু দেখাচ্ছে। আর যারা দেশে কাজ নেই কাজ নেই বলে চিৎকার করবেন বলে ভেবেছিলেন,যুদ্ধ নয় শান্তি চাই বলে মিছিল বা পদযাত্রা করবেন বলে ভেবেছিলেন। তারা তারা সব এখান-ওখান সেটিং করে আত্ম পুজোর জন্য ১০৮ নীলপদ্মের খোঁজে ব্যস্ত কিংবা তারা সব এন আর সি বা ডিজিটাল রেশন কার্ড বা প্যান কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযোগ ঘটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যতই নারদ নারদ করে ঝগড়া করার চেষ্টা করুন না কেন তবুও উর্ধ্ব-নিম্নচাপ কাটিয়ে পুজো এসেই যায়।রোজ যাদের পেটের চিন্তা করতে হয়না তারা বাদে সকলেই আ-আ-আ-আ শুনতে শুনতে আনন্দ উপভোগ করুন। এনজয় করুন।সব ভুলে যান। ভুলে যান আইনের চোখে সকলে সমান নন। আপনি আপনি, আর তিনি তিনি। হাফ-শোল খেয়ে না হাফিয়ে, মজা লুটুন না হলে ফুটুন। এই তো সিধাবাত! বাদ দিন, থাক সেসব কথা।
শুধু এই উৎসব নয়, আপনাদের জন্য সবদিন  ভালো থাকার শুভকামনা জানাই । জানি, ভালো থাকাটা চাপের, তবু্ও চেষ্টা করুন ভালো থাকতে।বাজার অর্থনীতিতে এখনও  ফ্রি-তে শুভেচ্ছা, শুভকামনা পাওয়া যাচ্ছে যখন,আসুন তাই নিয়ে আমরাও আ-আ-আ-আ করে আনন্দে মাতি..
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।