• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য

স্মৃতিজাগরুক

নিদারুণ হইল মর্মব্যথা সাথীর মহাপ্রয়াণে।
তিমিরে নিভিল দিশারী সে দীপ দিশাহারা করি ভুবনে।।
ব্যাঙ্গালোরে বসেই খবরটা পেলেন অসিতবাবু সকাল সকাল ফেসবুকে। কোভিড তারপর হার্ট এটাক- সব শেষ। আর কত জীবনহানি হবে তার লেখাজোখা নেই; গোটা পৃথিবীটাই যেন পরিণত হয়েছে একটা শ্মশানভূমিতে।
-‘কি হল বাবা, কোন খারাপ খবর নাকি আবার?’ ছেলে এসে জিজ্ঞেস করছে। অসিতবাবু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন। আর কথা বাড়াবার প্রবৃত্তি হল না। তাড়াতাড়ি তৈরি হতে হবে- অনেক কাজ আছে সকাল থেকে। অনলাইন ক্লাস নিতে হবে, ফ্যাকাল্টি মিটিং আছে।
অসিতবাবু ব্যাঙ্গালোরের এক ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ। ছাত্রপ্রিয় হিসেবে খুবই নামডাক। ভালো ট্রেইনার হিসেবেও পরিচিতি তৈরি হয়েছে। জীবনে এতটা দূর অতিক্রম করে আসার পিছনে রয়েছে ঐ মানুষটার হাত।
ঠিক আঠাশ বছর আগে কলকাতার এক ম্যানেজমেন্ট কলেজে পার্ট টাইম লেকচারার হয়ে যোগ দিয়েছিলেন অসিতবাবু। কিভাবে তিনি ঐ পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি নিজেও জানেন না। হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে নিজস্ব বেকারি ব্যবসা চালাতে চালাতে একটা পার্ট টাইম লেকচারার কাজ পেয়ে ভালোই হয়েছিল। ছাত্রদের মধ্যে কয়েক বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠার দরুন কর্তৃপক্ষ ওঁকে ফুল টাইম লেকচারার করে দেয়। ঠিক সে সময়ে একই কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিন স্বরূপ শিকদার। প্রথম থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
অসিতবাবু পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকেই খারাপ- বড়লোক বাড়ির আদরের ছেলে। কলেজের বাকি অধ্যাপকদের তুলনায় শিক্ষাগত যোগ্যতা নগণ্য। আবার স্বরূপবাবু ফাইন্যান্সে পি এইচ ডি, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ তদুপরি ভালো স্কুলের ভালো ছাত্র- জ্ঞানী লোক হিসাবে চারিদিকে নামডাক। অসিতবাবু মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
পরিচিতি বাড়তে স্বরূপ অসিতকে পি এইচ ডি করতে পরামর্শ দিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ কে সে কথা স্বরূপ জানালেন। অধ্যক্ষ তাতে সায় দিলেন। কলেজের মান বজায় রাখতে অধ্যাপকদের যোগ্যতা বাড়ানো দরকার।
যেরকম ভাবে স্বরূপ তখন অসিতকে সাহায্য করেছিলেন তা অবিশ্বাস্য। বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে গাইডের ব্যবস্থা, গবেষণায় সাহায্য, ব্যবস্থাদি আর তার সঙ্গে প্রাথমিক খরচ অবধি। সেসব দিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি অসিতবাবু। অসিতবাবুর বিষয় ছিল অন্য, ফাইন্যান্স নয়, তাও যেভাবে স্বরূপ সাহায্য করতেন অবলীলায়, তাতে স্বরূপের অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন।
একসাথে দুজনে বহু কাজ করেছেন। পি এইচ ডি করার পরেও দুজনে একসাথে কাজ করেছেন। এক্সিকিউটিভ ট্রেইনার হিসেবে প্রথমে ক্লাসে অসিতবাবু থতমত খেয়ে যেতেন। স্বরূপবাবুই ওঁর মনে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিলেন। ওঁর জন্যই অতি সাধারণ ছাত্র অসিত বড় বড় কোম্পানির কর্ণধারদের ট্রেইনার, দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াতে যান আর একটা অভিজাত কলেজের অধ্যক্ষ। প্রতিটি পদক্ষেপেই মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন মানুষটি। জীবন এভাবেই কোথা থেকে কোথায় বয়ে যায়।
সেই স্বরূপ শিকদার আজ সকালে চলে গেছেন। ফোনে প্রায়ই কথা হত-কলকাতায় ছিলেন এতদিন-নিজস্ব ফার্ম চালাতেন। তিনদিন আগে কোভিড ধরা পড়েছিল- আজ সকালে তার মেয়ে ফেসবুকে মৃত্যু সংবাদ পোস্ট করেছে।
ভরাক্রান্ত হৃদয়ে দিনের কাজে লেগে পড়লেন অসিতবাবু। ভীষণ অসহায় লাগছে। মনে মনে এক সঙ্কল্প করে নিয়েছেন। কলেজের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেন তিনি। পরদিন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়ে দিল।
দুদিন পর একটি ভার্চুয়াল কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। স্বরূপ
শিকদারের স্মৃতিসভা। প্রচুর ছাত্র ছাত্রীরা- বর্তমান এবং প্রাক্তন, সহকর্মীরা বর্তমান এবং পূর্বতন, অংশগ্রহণ করছে তাতে। এই অভূতপূর্ব সাড়া দেখে ফের মুগ্ধ হলেন অসিতবাবু। আয়োজক ত তিনি নিজেই। উদ্যোগ ওঁর নিজেরই। অভ্যাগতদের বক্তব্য শুনে অশ্রুসংবরণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠল এক একবার। আর সবচেয়ে বেশি বললেন আর কেউ নয়, তিনি নিজে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা যেন থামতেই দিচ্ছিল না।
পরদিন আবার কাজের দিন। সুব্রহ্মণ্যম্ নামে একটি ছেলে ওঁর কলেজে পার্ট টাইম লেকচারারের কাজ করে-বেচারির বাবা মারা গেছে গত বছর তাই পড়াশোনা আর এগোচ্ছে না। তাকে সুযোগ তৈরি করে দিতে চান অসিতবাবু। ঠিক যেমনটা করে দিয়েছিলেন স্বরূপ তেইশ বছর আগে ওঁর নিজের জন্য। এই সঙ্কল্পই তিনি স্থির করেছেন। ফ্যাকাল্টি মিটিঙে জয়েন করেই বললেন ‘ সুব্রহ্মণ্যম্, কথা আছে তোমার সাথে- এই মিটিঙের শেষে আমাকে ফোন কোরো।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।