সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র)

পাশ – ফেল

সময় এসেছে এবার সতর্ক হবার ছাত্র ছাত্রী দের পড়াশোনার ব্যাপারে ৷ দুবছর কোভিডের জন্য অনিচ্ছাকৃত অনেক ফাঁকি গেছে ,মোবাইলের ব্যবহার বেড়েছে ছাত্র ছাত্রী দের অনলাইনে লাভ থেকে ক্ষতি ই হয়েছে বেশী৷ মোবাইল আসক্তি বেড়েছে ৷ মানছি টিচারা অনলাইনে বরং অনেক সতর্ক ও আন্তরিক ভাবে খেটে পড়িয়েছেন কিন্তু নজরদারির অভাবে সেটা সুডেন্টদের আরো মোবাইল মুখী করেছে ৷ বাচ্চা অনলাইনে মা, বাবা ,দিদি,দাদ,দিদি, এমন কি অনেকেই গৃহ শিক্ষকের সাহায্য এবং বই দেখেও লিখেছেন ৷ মানছি কিছু ব্যতিক্রমী হয়তো আছে কিন্তু বেশীর ভাগই মুদ্রার এপিঠওপিঠ ৷ বাচ্চারা প্রায় একডেমিক দিক এবং গ্রহণযোগ্যতার দিক দিয়ে দুইবছর পিছিয়ে আছে ৷
আমাদের রাজ্যে ছয়টি ঋতু থাকলেও মোটামুটি তিনটি ঋতুর প্রাধান্য দেখা যায় ৷ শীত ,গ্রীষ্ম ও বর্ষা ৷ পরিকাঠামোর অভাবে আর দীর্ঘ দুইবছর বন্ধ থাকার দৌলতে অনেক স্কুলের বিশেষ করে প্রাইমারী স্কুলের অবস্হাও খারাপ ৷ বর্ষা কালে হয়তো জল পড়বে ক্লাসে ,গ্রীষ্মকালে ফ্যান চুরি হবার কারণে বাচ্চারা গরমে নাজেহাল আর শীতেও এখন অনেক জায়গায় এত ঠান্ডা পড়ে যে মাটিতে বসে পড়াশোনা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে ৷ এগুলি তো থাকবেই কিন্তু এর সাথে আমাদের মানিয়ে নিয়ে বাচ্চাদের স্বার্থে স্কুল খোলার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে ৷প্রয়োজনে সময় ও পরিকাঠামোর সামান্য বদল করে ৷ নিজের বাচ্চাদের স্বার্থে স্কুল খোলার উদ্যোগ নিতে হবে
Umbrella কে Amrela বানান করার বিতর্কে আমি যাচ্ছি না কারণ আমি একজন বাংলা মিডিয়াম স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। যেখানে ক্লাশ ফাইভে এমন ছাত্রী পাই যারা ABC ঠিকমত লেখা তো দূরের কথা ইংরেজী হরফ চিনতেও পারে না। এর অনেক কারণ আছে হয়তো অনেক পরিবারের অভিভাবকরা হয় লেখাপড়া জানেন না বা কর্ম ব্যবস্তার করাণে বাচ্চাকে ঘরে পড়াতে পারেন না ৷ আরো একটা প্রধান অসুবিধা ক্লাসে ভর্তির ব্যাপারে বয়স ৷ যদি কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর বয়স নয় বছর হয় আর কোনো কারণে সে যদি পড়াশোনা আগে না শিখে তবুও তাকে পিপিতে পাঁচ বছর হিসাব করে ক্লাস ফোরেই ভর্তি করতে হবে ৷ যার ভিত ই নেই সেখানে আমাদের যদি একতলা বা দোতালা বাড়ী বানাতে বলা হয় সেখানে কি হবে আর বলার অপেক্ষা রাখে না ৷সেই তরণী এদের দিয়ে পার করানো যে কী অবস্থা তা হয়ত আমার মত দীর্ঘদিন বাংলা মাধ‍্যম স্কুলে পড়ানো শিক্ষিকারাই জানেন। প্রচুর ট্রেনিং হয় আমাদের, এভাবে শেখাতে হবে ওভাবে শেখাতে হবে সব বলা হয়।
কিন্তু আমি সব মেনেও আমি মাঝে মাঝে হয়ে যাই আমার বাবার মত শিক্ষক যিনি syllable ভাগ করে উচ্চারণ শেখাতেন। বলতেন মনো,ডাই,ট্রাই,পলি এই এতগুলো সিলেবল আছে। শব্দের মাঝে দাগ দিয়ে ভাগ করে উচ্চারণ শেখাতেন আমরা এভাবেই কঠিন কঠিন শব্দ উচ্চারণ করতাম। তবে তার আগে আমরা শিখে এসেছিলাম গ্ৰামের প্রাইমারী স্কুলেই অনেকটা বেশি ইংরেজী। ফটাফট ইংরেজী মুখে বলতে পারতাম না তবে গ্ৰামারটা খুব ভালো জানতাম। একটা সময় ট্রেনিংয়ে শুনলাম আলাদা করে গ্ৰামারটা শেখানোর দরকার নেই। পড়তে পড়তেই সব শিখবে,বন্ধ হল পি কে দে সরকার বা পি কে মুখার্জির বইয়ের ওপর জোর দেওয়া। যদিও পাশাপাশি একটা বই রাখলাম কিন্তু যত বছর পেরোলাম দেখলাম ভয়েস চেঞ্জের খাতা আর ওদের দিয়ে করানো যায় না,বারবার লিখে দিয়েও ভাওয়েলের সংখ‍্যা গুলিয়ে ফেলে। উত্তর লিখতে দিলে নিজেরা না খুঁজে বলে দাগ দিয়ে দাও কতটা লিখব। ওরাও পাশ করে আসছে মাধ‍্যমিক,ইংরেজীতে পঁচিশের সিঁড়ি দিব‍্যি উঠছে তবে গ্ৰামার অনেকেই ছোঁয় না। গত লকডাউন পর্ব মিটলে যখন ওদের যখন অনলাইন থেকে সামনাসামনি পেলাম দেখলাম f লিখতে বললে চুপ করে বসে আছে, বলছে কোনটা এফ দেখিয়ে দাও। ওরা ফেসবুক করে,ইনস্টাতে রীল বানায়। রাত জাগে,সকালে হাই তোলে আর ভোলে। আমরা ঘষামাজা করি প্রতিদিন একটু চকচকে হয় তারপর ক্লাশ এইটের গন্ডী পেরিয়ে হঠাৎই একদিন আর আসে না। শুনি চলে গেছে পাড়ার কোন এক দাদাকে বিয়ে করে। তারপর হঠাৎই একদিন সিঁদুর মুছে শুকনো মুখে গার্জেন সঙ্গে নিয়ে দাঁড়ায়,” দিদি কন‍্যাশ্রীর পঁচিশহাজার পাব তো ? দিদিমনি আপনার তো বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান দিদিমনির সঙ্গেজানাশোনা আছে একটু বলে দিন না
আবার ভর্তি হব নাইনে।”
আমরা লুফে নিই ওদের, “বলি হ‍্যাঁ আয় কাল থেকেই।” আমি বলে দেবো বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কে ৷তারপরে পঁচিশহাজার পেয়ে হারিয়ে যায় আবার লং অ্যাবসেন্টের তালিকায়। বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ডেকে পাঠায় বলেন “ওই মেয়েটা তো আর আসছে না তো !”স্কুলের পুরানো খাতা খুলে ফোন করি ওই অভিভাবককে , জিজ্ঞেস করি” মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে না কেন ?” ফোন ধরে বাবা অথবা মা সোজা বলে,” দিদি ও আর পড়বে না।”
স্কুলের নিয়ম মেনে শেখাতে গেলেও অনেকসময় নিয়ম ভেঙেও শেখানোর চেষ্টা করি৷ যেমন ছোটো বেলায় বাবার কাছে শিখেছিলাম ছবি এঁকে ভয়েস চেঞ্জ,এত বছরেও ভুলিনি। যখন পারি না শেখাতে নিজেকেই অপদার্থ বলে মনে হয়। কতটা সঠিক আমরা? বানান ভুল বোধহয় আমাদের অনেকেরই হয়,কেউই পুরোপুরি শুদ্ধ নই। যারা শেখেনি বা ভুল করছে সেই ভুলের দায় কে নেব নেবে সরকার, শিক্ষক,বিদ‍্যালয়,অভিভাবক না যে ভুল করছে সে নিজে?দায় কেউ নেবে না,শুধু আঙুল উঠবে শিক্ষক সমাজের দিকে।
কিন্তু আমি বলব ওরা যে এই শিক্ষাই পাচ্ছে কিছু না জেনেও তরতরিয়ে এইট পাশ করে নাইনে ওঠা যায় কারণ পাশ ফেল উঠে গেছে।
পরিস্থিতির কারণে দিনের পর দিন স্কুল কলেজ বন্ধ রেখে যদি বলা হয় এবার তোমাকে পরীক্ষায় বসতে হবে,কী করবে ওরা? ওরা তো শিখতেই ভুলে গেছে কারণ ওরা এই জেনেই উঠেছে ক্লাশে না পড়েও পাশ করা যায়। যে অভ‍্যেস আমরা ছোট থেকে ওদের করে দিয়েছি পাশ ফেল তুলে দিয়ে সেই অভ‍্যেসেইপড়াশোনা না করতে চাইছে । একটা সময় অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হত। উঠে গেল সেটা,তোমার এরিয়ার স্কুল সুতরাং ছাত্রকে তোমাকে ভর্তি নিতে বাধ‍্য। সুতরাং যারা তেমন কিছু না জেনেও ফাইভে উঠেছে তারা সুযোগ পেল অবলীলাক্রমে ভালো স্কুলে যাবার।

ভালো মানে নামকরা স্কুলগুলোতে ছাত্র ছাত্রী বাড়তে লাগল। তলিয়ে যেতে লাগলো অনামী স্কুলগুলো,দ্রুতগতিতে কমতে লাগল সেখানে ছাত্রছাত্রী সংখ‍্যা। দিদিমণি আর স‍্যারেরা হাঁ পিত্তেশ করে বসে রইলেন কখন একটা ছাত্র বা ছাত্রী পাবেন তাঁরা। অদ্ভুত নিয়ম গড়ে,ছোট থেকে পাশ করিয়ে দিয়ে,বিভিন্ন ভাতা দিয়ে আমরাই ওদের সর্বনাশ করছি। আমার কিছু ছাত্রী দশম শ্রেণীতে যে বইগুলো কেনা দরকার কেনে না। তারা কন‍্যাশ্রীর টাকা তোলে পুজোর আগে সে টাকায় জামা কেনে,চুলে রঙ করে আর শ্রী বৃদ্ধি করে।

নিজেকে বোধহয় সবচেয়ে বেশি সংশোধন করা যায় নিজে নিজেই। তাই শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্ৰী থাকলেই হবে না তার পাশাপাশি শেখাটাও জরুরী। ভুল না হয় হলই তা বলে শিখতে লজ্জা কী? আমিও শিখি আমার দরকারে আমার সহকর্মী বা আমার চেয়ে ছোটোদের কাছ থেকেও ।সুতরাং হয়ত ভুল হয়েছে তবে শিখে নেব এই মনোভাব থাকাটাই জরুরী। এই রাজ‍্যের ছেলেমেয়েদের কিছু হবে না,এটা না ভেবে ভুল হয়েছে হয়ত কোন কারণে এটা ভাবাই ভালো। কারণ আমি আশাবাদী, ঐটুকু নিয়েই যে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে না পারা ছাত্রীদের বলতে শেখাই,” বল,সব পারব আমরা। না পারলে শিখে নেব।””

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।