সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ২
by
·
Published
· Updated
|| দুই ||
মর্তকায়ার অন্তরালে
এরপর রবীন্দ্রকাব্য ক্ষিতিমোহনের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠল | তাঁর নিজের স্বীকারোক্তিতে এ’কথা প্রমাণিত হয় | “মত্ত ছিলাম শুঁটকি মাছে , এবার যেন পেয়ে গেলাম টাটকা মাছের স্বাদ – পেয়ে গেলাম তাঁর সন্ধান |” অন্যত্র বলছেন , “রবীন্দ্রকাব্য যে কত ভালো লাগত কী বলবো | সন্তবাণীতো শতশত বছরের পুরানো , আর রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত |”
রবীন্দ্রনাথের উচ্চ প্রশংসা ক্ষিতিমোহন একটি হিন্দি প্রবন্ধে করেছিলেন | তারই কিয়দংশ : “বিশেষত খুব বাল্যকাল থেকেই আমি সাধু সন্তদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়িয়েছি | সে সময় কবীর দাদূ আদি সন্তের বাণীতেই মনপ্রাণ পূর্ণ ছিল | তারপর উনিশ কুড়ি বছর বয়সে একদিন এক রবীন্দ্রভক্তের মুখে যখন প্রথম একটি কবিতা শুনলাম তখন মনে হল যে বাণীর সঙ্গে আমার আন্তরিক পরিচয় আছে , এই কবিতাও ঠিক সেই জাতীয় | তাই শোনামাত্রই তার সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয় হয়ে গেল | সে কবিতা মুহূর্তের জন্যও আমার বিজাতীয় বলে মনে হল না | বরং এমন হল যে-সব সন্তবাণী এতদিন আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল, সেও রবীন্দ্রকাব্যের সাহায্যে দিনে দিনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল , তার মর্ম প্রকাশ পেল |”
কাশীতে যজ্ঞেশ্বর তেলী নামে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে ক্ষিতিমোহন স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে ‘এ কি এ সুন্দর শোভা ‘ , ‘মরি লো মরি আমায়’ , ‘সখী আমারি দুয়ারে কেন আসিল ‘ যে কয়টি সঙ্গীত শুনেছিলেন তার স্থায়ী ছাপ ক্ষিতিমোহনের মনে পড়েছিল | উল্লেখ্য ক্ষিতিমোহন কিন্তু তখনো জানতেন না এ’সব গানের রচয়িতা কে |
১৩০২ ‘সাধনা’র বৈশাখ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের মানভঞ্জন গল্পটা বেরিয়েছিল | গল্পটা ক্ষিতিমোহনের অস্বাভাবিক রকমের ভালো লেগেছিল | সম্ভবত পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নাম ছিল না , তাই গল্পটা যে রবীন্দ্রনাথের তা ক্ষিতিমোহনের অজানা রইল | অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষিতিমোহনের ভালোবাসার সম্পর্কটা জন্ম নিল ক্ষিতিমোহনের রবীন্দ্র দর্শনের পূর্বেই |
ক্ষিতিমোহন প্রথম রবীন্দ্রনাথের দর্শন পেলেন ১৩১১ এর ১৩ই শ্রাবণ | সভারম্ভের বহু আগেই তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন | এর কারণ পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা | দিনকয়েক আগে ৭ই শ্রাবণ মিনার্ভা থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পাঠ শুনতে উপস্থিত হয়েছিলেন , কিন্তু ভিড়ের চাপে তা আর সম্ভব হয়নি ; উপরন্তু জামাটা ছিঁড়ে গেল | তাই ১৩ই শ্রাবণ আগে ভাগেই উপস্থিত | ভিতরে ঢুকেই দুই সতীর্থের সঙ্গে দেখা – প্রমথনাথ তর্কভূষণ ও রাজেন্দ্র বিদ্যাভূষণ | তাঁরা ছিলেন উদ্যোক্তার দলে | তাঁরা বন্ধু ক্ষিতিমোহনকে একেবারে স্টেজের উপর বসিয়ে দিলেন | এবারেও রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি দেখা হলো না | পিছন থেকে দেখলেন বলে মুখ ভালো দেখা গেলো না | যাইহোক রবীন্দ্রনাথের মুখে প্রবন্ধ শুনলেন | ক্ষিতিমোহনের মনে হলো গান শুনছেন |
ইতিমধ্যে শিবনারায়ণ দাস লেনে ‘ফিল্ড এণ্ড একাডেমি’ নামে এক বিপ্লবী সমিতি গড়ে উঠেছিল | কলকাতায় থাকলে কবি মাঝে মাঝে তরুণদের উপদেশ দিতে সন্ধ্যে বেলায় উপস্থিত হতেন | ক্ষিতিমোহনও বেশ কয়েকবার উপস্থিত ছিলেন সেইসব সান্ধ্যবৈঠকে | কিন্তু সাহসাভাবে আলাপ করা আর হয়ে উঠল না |
যাইহোক কালীমোহনের প্রসঙ্গেই আবার ফিরি | সেবার পাবনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মিলনীর অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল ১১-১২ ফেব্রুয়ারি ১৯০৮ , বাংলা তারিখ ২৮-২৯ মাঘ ১৩১৪ | রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কালীমোহনের পরিচয় হল | আলাপ- আলোচনার সূত্রে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেলেন তাঁর ‘স্বদেশ সমাজ’ এর পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেবার যোগ্য লোক | কালীমোহনও পেলেন তাঁর স্বপ্নের ক্ষেত্র – দরিদ্র , হৃতস্বাস্থ্য গ্রামবাসীর সেবা করার দুর্লভ সুযোগ | রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিযুক্ত করলেন শিলাইদহের পল্লীসেবার কাজে | পল্লীসেবার কাজ করতে গিয়ে কালীমোহন যে ত্যাগ ও তপস্যার পরিচয় দিলেন তা এককথায় অতুলনীয় | প্রতিষ্ঠিত , ধনী ও প্রখ্যাত আইনবিদ শ্বশুর দীননাথ বসুর আশা অপূর্ণ রেখে ; অর্থ উপার্জন , সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব কিছু হেলায় ত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া দিয়ে গ্রাম সেবার কাজে নিজেকে সঁপে দিলেন |
কিন্তু শিলাইদহের আবহাওয়া তাঁর সহ্য হলো না | শরীর ক্রমশই খারাপ হতে লাগল | পরিশ্রমসাধ্য কাজ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সরিয়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষকতার কাজে নিয়ে আসেন | শিশুবিভাগের দায়িত্ব পালন ও শিক্ষকতার কাজে সফল হলেও গ্রামসেবার সংকল্পও মন থেকে সরিয়ে দেয়নি |
কিছুকাল পরে ১৯২২ এর ৬ ফ্রেবুয়ারি এলম্ হার্সটের অধ্যক্ষতায় শ্রীনিকেতনে পল্লীসংগঠন বিভাগের কাজ আরম্ভ হলো | রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় ও প্রেরণায় কালীমোহন অন্যতম মুখ্য সংগঠকের ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ পেলেন | কারণ আশেপাশের গ্রামগুলির সঙ্গে কালীমোহনের যথেষ্ট পরিচয় ও গ্রামবাসীদের সমস্যার গতিপ্রকৃতি বুঝতে তাঁর অভিজ্ঞতা যথেষ্ট মূল্যবান ছিল | এমন কথাই এলমহার্সটের শ্রীনিকেতনের ডায়ারিতে উল্লেখ আছে |
এহেন কালীমোহনের কাছে রবীন্দ্রনাথ প্রথম শুনলেন ক্ষিতিমোহনের নাম | এর সমর্থনে অজিত কুমারকে লেখা চিঠির উল্লেখ পূর্বেই করেছি | ক্ষিতিমোহন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কারণও পূর্বেই উল্লেখ করেছি | এখানে আর একটু বাড়তি সংযোজন করব | “বিদ্যালয়ে ভাবের প্রবাহ সত্যরূপে জাগ্রত করতে হলে ভাবুকের প্রয়োজন , বিদ্বানের নয় | …..আমাদের বিদ্যালয় থেকে ভাবুকতার অভাব না ঘোচাতে পারলে এর মধ্যে জীবন সঞ্চার করতে পারব না – এ আমি নিশ্চয় জানি – ক্ষিতিমোহন নীরস কর্তব্যনিষ্ঠ নন – তাঁর চিত্তে ভাবরসের প্রবল আবেগ আছে এই সংবাদটি পেয়ে আমি তাঁর সম্বন্ধে উৎসাহিত হচ্চি |” ( বানান অপরিবর্তিত )