সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ২১)

সালিশির রায়

কিস্তি – ২১

আর তখনই গ্রামের পথে ভেসে আসে মোটরবাইকের শব্দ। দিদি আসছে ভেবে সে ছুটে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। তখনই বাবা আর এক সঙ্গী কে চাপিয়ে নিয়ে দরজার সামনে এসে থামে শাসক দলের নেতা রাম নস্করের মোটরবাইক।রামবাবুকে দেখে ভুরু কুঁচকে যায় তার। আগে মাঝে মধ্যে তাদের বাড়িতে আসত। কিন্তু বাবার সেই জরিমানার পর থেকে আর তাদের বাড়ি মুখো হননি। তাদের বাড়িতে না এলেও কয়েকদিন ধরে পাড়ায় রামবাবু আর তার দলের লোকেদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে আন্দাজ করেছিল ঠিক কোন ভোট আসছে। ভোট এলেই তো রাজনৈতিক দলের নেতাদের তাদের পাড়ায় যাতায়াত বেড়ে যায়।মূলত শাসকদলের নিয়ন্ত্রণেই থাকে তাদের মতো আদিবাসী পাড়াগুলি।
বিরোধীরা চ্যাটাই পেতে বসার জায়গাটুকুও পায় না বললেই চলে। তাই আদিবাসীরা যাতে বিগড়ে না যায় তার জন্য সালিশি সভার মতো বিষয়গুলি সযত্নে এড়িয়ে যান রামবাবুরা। সব জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। বিরোধীরা যাতে ওইসব বিষয় নিয়ে রাজনীতি করতে না পারে তার জন্যও সদা সজাগ থাকেন। বাবার জরিমানার সময়েই সে বিষয়টি উপলব্ধি করেছে।সেই ঘটনার জন্য তারা এখনও তাদের দলের প্রতি বিগড়ে আছে কিনা তা যাচাই করতেই কি রামবাবুর তাদের বাড়িতে আসা ? যাই হোক এসেছে যখন, তখন জানা তো যাবেই। সে রামবাবুদের বসার জন্য চারপায়টা এগিয়ে দেয়। বাবা বসে একটা বাঁশের পায়ার টুলে। অঞ্জলি ভাবে অন্য কোন ফিকির নেই তো ?
এতদিনে রাজনৈতিক নেতাদের তার ভালোই চেনা হয়ে গিয়েছে।সে দূর থেকেই রামবাবু কি বলে শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকে। সেইসময় তার কানে আসে ফের মোটরবাকের শব্দ। এবারে নিশ্চয় দিদিই আসছে। সে ছুটে দরজার কাছে পৌঁছোতেই দিদিকে নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায় হৃদয়দার মোটরবাইক। সে দিদির হাত থেকে ব্যাগটা নেয়। তারপর একবার দিদি আর একবার হৃদয়দার মুখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা অনুমান করার চেষ্টা করে। কিন্তু কারো মুখ দেখে কোন আভাস পায় না সে। খুব দুশ্চিন্তা হয় তার। দিদি হৃদয়দাকে তেমন কিছু বলে নি তো ? এখানে অপমান করে বসবে না তো ? এসময় রামবাবুর তাদের বাড়িতে আসার জন্য সে মনে মনে রামবাবুকে ধন্যবাদই দেয়। আর যাই হোক ওদের সামনে নিশ্চয় দিদি হৃদয়দাকে কিছু বলবে না। দিদি হৃদয়দাকে অপমান করলে তার খুব খারাপ লাগবে। না পারবে দিদিকে কিছু বলতে, না পারবে হৃদয়দার অপমান সহ্য করতে।
রামবাবুরা থাকতে থাকতেই হৃদয়দাকে কায়দা করে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে।
— কি রে ব্যাগটা হাতে নিয়ে কি ভাবছিস অত ?
মোটরবাইক থেকে নেমে তাকে ঠেলা দিয়ে দিদি বলে। সে লজ্জা পেয়ে বলে , না না, ও কিছু নয়। আয় ভিতরে আয়। জামাইদা এল না কেন ?
— চল বাড়ির ভিতরে গিয়ে সব বলছি। আর একজনকে বাড়িতে ডাকবি না ? দরজা থেকেই বিদায় করে দিবি ? বলে তার আর হৃদয়দার দিকে অর্থবহ দৃষ্টিতে তাকায় দিদি। লজ্জায় সে কোন কথা বলতে পারে না। কিন্তু হৃদয়দা বলে ওঠে, না বললেও আমাকে তো বাড়ির ভিতরে একবার যেতেই হবে এ দুটো রাখতে — বলে হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগ দুটো তাদের সামনে নামায়।
শেষে দিদিই বলে — ভিতরে এসো হৃদয়।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে অঞ্জলি। গতি প্রকৃতি দেখে তার মনে হয় হৃদয়দা সম্পর্কে দিদির সেই খারাপ ধারণাটা সম্ভবত আর নেই। বাড়িতে আসার পর অবশ্য হৃদয়দাকে বসার জন্য মোড়াটা সে’ই এগিয়ে দেয়। দিদি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ঘরের ভিতরে যায়। তারপর সে দিদির আনা মিষ্টি দেয় সবাইকে। হৃদয়দাকে জল দেওয়ার সময় তার দিকে পরিপূর্ণ ভাবে তাকায় অঞ্জলি। হৃদয়দা ও তার চোখে চোখ রাখে। কিন্তু দিদি চলে আসতে পারে বলে রামবাবুদের দিকে সরে যায় সে।
আর তখনই রামবাবুদের বাবার কাছে আসার আসল উদ্দেশ্যটা জানতে পারে সে। সে শুনতে পায় রামবাবু বাবাকে বলছেন, সুখলাল তুমি আর না কোর না।দল থেকে তোমাকেই মোড়ল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
—- না – না বাবু , আমি ওসব পারব না। তাছাড়া পাড়ার লোকেরা আমাকেই বা মোড়ল বলে
মানবে কেন ?
— সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের দলের লোকেরা তলায় তলায় সব ঠিক করে রেখেছে। পাড়ার লোক তো এখন কালীরামের উপর বেজায় খাপ্পা। দল বিভিন্ন সময় পাড়ার লোকেদের দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জিনিস দিয়েছে। কিন্তু কালীরাম সেসব জিনিসপত্র একাই আত্মসাৎ করেছে। সেটা জানার পরই খেপে গিয়েছে পাড়ার লোক। পার্টিও কালীরামকে আর ভালো চোখে দেখছে না। পার্টির কাছে খবর আছে সে বিরোধীদলের নেতাদের সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ রেখে চলেছে। তাই পার্টি কালিরামকে সরিয়ে তাকে মোড়ল করতে চায়।
নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামেন রামবাবু। অঞ্জলি এতক্ষণে বুঝতে পারে রামবাবুদের আসার উদ্দেশ্য। তারাও কানাঘুষোয় শুনেছে কালীরাম নাকি পার্টির আর জরিমানার টাকা মেরে কিছু জমিজমা কিনেছে।কিন্তু তা নিয়ে পাড়ার লোকের ক্ষোভের কথা তাদের জানা ছিল না। কখন দিদি এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে সে টের পাই নি। রামবাবুর কথা দিদিও সবটা শোনে। রামবাবুর কথায় বাবা হ্যা, না কিছু বলতে পারে না। কিন্তু তারা তীব্র আপত্তি জানায়। মোড়ল হলে তো নিজের ইচ্ছার বাইরেও অনেক সময় পাড়ার লোকেদের চাপে সালিশিসভা বসিয়ে জরিমানা আদায় করে শত্রুতা বাড়াতে হয়। এমনিতেই পাড়ায় তাদের শত্রুর অভাব নেই, তার উপরে আর নতুন করে শত্রু বাড়িয়ে লাভ নেই। তাদের দুই বোনের কথা শুনে রামবাবু বলেন, চাইলেই কি তোমরা শত্রুতা এড়াতে পারবে ? দেখলেই তো দু’বার সালিশিসভা বসিয়ে তোমাদের কি হাল করল ওরা। আবার যে একই ঘটনা ঘটবে না কে বলতে পারে ? কিন্তু তোমার বাবা মোড়ল হলে অন্তত তোমাদের বিরুদ্ধে তো আর সালিশিসভা বসবে না। এবারে রামবাবুর কথাটা যুক্তি সঙ্গত বলে মনে হয় দু’বোনের। বিশেষত অঞ্জলি ভাবে, হৃদয়দা আর তাকে ঘিরে সেই আশংকা তো ষোল আনাই রয়েছে। চড় খাওয়ার পর শোভন তো সে রকমই শাসিয়ে গিয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে বাবা মোড়ল হলে ভালোই হবে। বিষয়টি শুনে হৃদয়দাও একই মত প্রকাশ করে। সবদিক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত তারা রামবাবুর মতেই মত দেয়।
যাবার আগে রামবাবু বাবার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে যান, যেহেতু বিষয়টি একেবারেই আদিবাসী সমাজের নিজস্ব ব্যাপার তাই তারা কেউ সরাসরি বাইরে থেকে নাক গলাবে না। কিন্তু তাদের লোক থাকবে। এবার মিটিংটা ডাকা হবে অঙ্গনওয়ারি সেন্টারে। সুখলাল যেন সেখানে সময় মতো পৌঁচ্ছে যায়। সব ঠিক করাই থাকবে। মোড়ল নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর টাকাটা আনন্দ ফুর্তির জন্য পাড়ার লোকেদের হাতে তুলে দেবে সুখলাল। রামবাবুর কথা শুনে ‘থ’ হয়ে যায় অঞ্জলি। মনে মনে ভাবে রাজনীতির লোকেরা কি না পারে ? অলক্ষ্যে থেকে মানুষকে পুতুলের মতো যেমন খুশী নাচায়। নাহলে যে পাড়ার লোকেরা কিছুদিন আগে বাবা-মা’কে পিটিয়ে মেরে দিতে যাচ্ছিল তারাই কোন যাদুবলে বাবাকে মোড়ল করতে চাইছে তা তো এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল। বাবার সংগে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে রামবাবুরা বিদায় নেন। হৃদয়দাও যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই দিদি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে – তুমি আমাদের সঙ্গে চাট্টি খেয়েই যাও। অতদুর থেকে আমাকে নিয়ে এলে তার উপরে আজ আবার অঞ্জু নিজে হাতে রান্না করছে। খেয়ে দেখেই যাও ও কেমন রান্না করে। দিদির কথায় খুব লজ্জা পায় সে। আবার ভালোও লাগে। সে তো মনে মনে এটাই চাইছিল। দিদিকে এখন তার বন্ধুর মতো মনে হয়। খাওয়া দাওয়ার পর হৃদয়দা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। খুউব ইচ্ছে হয় দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু লজ্জায় যেতে পারে না। এমনকি একবার চোখ তুলে তাকাতেও পর্যন্ত পারে না। দিদির মনোভাব স্পষ্ট করে জানার আগে ধরা দিতে চায় না সে। তাই এঁটো হাতে থালার সামনে বসে বসে সে শুনতে থাকে হৃদয়দার বাইকের শব্দ।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।