গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

ইচ্ছেডানা

আমার পুবের জানলাটা খুললেই দেখা যায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। বসন্তে এমন অহঙ্কারী হয়ে ওঠে যেন ও একাই সোহাগে রাঙা। ওর শরীর থেকে যখন সূর্য কিরণ চুইয়ে পড়ে তখন আমারও খুব হিংসা হয়। বর্ষা এলে একমনে ভিজতে থাকে। কতবার মনে হয়েছে ওর সাথে ভিজি কিন্তু ওর ঐ অহংকার। তাই জানলা দিয়ে মন ভেজাই। আবার ঝড়ে যখন ডাল ভাঙে অভিমানে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন আমার মনেও মনখারাপের মেঘ জমতে থাকে।

একদিন এক শালিক দম্পতি ওর ডালে বাসা বাঁধল,সারাদিন কিচিরমিচির কিন্তু রাতে দুজনের ভালোবাসা দেখার মত। ওরা ঐ অহংকারী কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে যেমন আপন করে নিয়েছিল তেমনি আমার এক চিলতে বারান্দাটাকেও ভালোবেসে ফেলেছিল। দিন দিন ওরা আমার বড় কাছের হয়ে উঠছিল। ওদের কে দেখতে না পেলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। আবার যখন দেখতাম দু’টোতে খুনসুটি করছে,মনটা ভালো হয়ে যেত। হঠাৎ দেখলাম ওরা পালা করে বাসায় বসে থাকছে। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁক দিয়ে ঝিলমিল রোদ্দুর এসে পড়েছে ওদের বাসায়। মুখটিপে হাসলাম। কি বুঝল কে জানে। একটা মিষ্টি বাতাস চোখেমুখে ঝাপটা মেরে চলে গেল। বুঝলাম মা পাখিটা ডিম পেড়েছে। আমিও দিন গুনতে থাকি ওদের ছানাদের জন্য। দেখতে দেখতে একদিন ডিম ফুটে পৃথিবীর আলো দেখল ওদের সন্তান। দেখতে পেতাম না। শুধু চিঁ চিঁ করে একটা শব্দ শুনতে পেতাম। দু’চোখ ভরে দেখতাম ওদের সন্তান পালন। দুজনে মিলে পোকা,ফড়িং ধরে এনে ওদের খাওয়াতো। আমি অপেক্ষায় থাকতাম কবে ওদের দেখব। আমার জানলা খোলাই থাকত ওদের জন্যে। ভাত,মুড়ি,বিস্কুট দিতাম। দেরী হলে জানলা দিয়ে এসে ঘরে ঘুরে বেড়াত। খাবার দিলে তৃপ্তি করে খেতো। ওদের সাথে আমার বন্ধন দিনদিন গাঢ় হচ্ছিল।

একদিন ভোরে ওদের চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি জানলা দিয়ে দেখি একটা শালিখের বাচ্চা মাটিতে পড়ে গেছে। প্রাণপণ ডানা ঝাপটাচ্ছে কিন্ত উড়তে পারছে না। ওর বাবা মা কাক তাড়াচ্ছে। হুলো বেটা ঠিক খবর পেয়ে গেছে। জিভ চাটতে চাটতে গাছের নীচে বসে আছে। কোনরকমে নিচে গিয়ে ওকে তুলে আনলাম। পড়ে গিয়ে ডানায় চোট পেয়েছে। উড়ো পাখিও বোঝে কে রক্ষক আর কে ভক্ষক। শুধু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব চিনতে পারে না কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ।

আমার এক চিলতে বারান্দায় ওকে রেখে দিলাম,পায়ে একটা হালকা সূতো বেঁধে। ভালো করে খেতেও শেখেনি। আমি তো চিন্তায় পরে গেলাম। কোনরকমে আর্ণিকা খাওয়ালাম। একটু পরেই দেখি ওর মা মুখে করে খাবার এনে ওকে খাওয়াচ্ছে। পৃথিবীর সব মা একই রকম। খুশি হলাম,ও হয়তো বেঁচে যাবে। মা পাখিটা সারাক্ষণ সামনের গাছে নয় বারান্দার কার্ণিসে বসে থাকত। আমি ছাড়া বারান্দায় কেউ গেলেই কামড়াতে আসতো।

এইভাবে ক’দিন যাবার পর শুরু হল ওর ডানা ঝাপটানো। বুঝলাম,ও ডানায় জোর পাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি ও ওর পায়ের বাঁধন কাটবে। ও যত ডানা ঝাপটাচ্ছে আমার হৃদয় আকাশে মেঘ জমছে। ডানার ক্ষতটা ধীরে ধীরে সেরে উঠল। মনকে যতই বোঝাই মন বোঝে না। ওর আকাশ তো ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ওর নাম দিয়েছিলাম টুকটুকি। ক’দিন আগে টুকটুকি উড়ে গেছে ঐ আকাশে। ওর মা শিখিয়ে দিয়েছে কি ভাবে আকাশ ছুঁতে হয়। আজ ও আকাশের মালিক। আজ ও স্বাধীন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।