• Uncategorized
  • 0

গল্পেরা জোনাকি তে অসীম বিশ্বাস

 স্বপন যদি মধুর হতো

অতিমারি, জীবন আর মৃত্যুর মাঝের দেওয়ালটা আস্তে আস্তে একটা পাতলা ফিনফিনে আস্তরণে পরিণত করেছে। তবুও আমাকে জীবনমুখী হতে হবে। এখনো অনেক কিছু দেওয়া বাকি আছে জীবন’কে, সমাজ’কে, আমার প্রিয়তমা শর্মিলা কে।
সকালে শর্মিলার ভেজা চুল থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে আামার কপালে।
চোখ মেলতেই এক কাপ চায়ে প্রেম মিশিয়ে এগিয়ে দিলো। এ ভাবেই ও রোজ ঘুম ভাঙ্গায় আমায়। চায়ের কাপ সাইডে রেখে হাত ধরে টানতেই শর্মিলা বুকের খোলা অংশে একটা লালচে দাগ দেখিয়ে বললো – দেখো তুমি কাল রাতে কি করেছো!
আমি – কই দেখি ভালো করে, বলতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো এক ঝটকায়। দূরে ড্রেসিং টেবিলে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো- প্রমিত, কাল রাতে তুমি কিন্তু আমাকে অনেক গুলো প্রমিস করেছো।
প্রমিসের কথা শুনেই ধরপর করে উঠে বসলাম। রাতে বিছানায় প্রমিস করা মানেই তো শুধু “হুুঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে” এগুলো বলা কিন্তু কি কি কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রমিস মনে করতে গিয়ে একটা মনে হলো, ওকে আজ চব্বিশটা ঘন্টা দিতে হবে, এই কথাটায় আমি ওর গালে চুমু খেতে খেতে হুুঁ বলেছিলাম।
অর্থাৎ আজ আমার অফিসের কাজে সারাদিন ল্যাপটপে বসা চলবে না।
হঠাৎ আমার মথায় একটা প্ল্যান এলো, শর্মিলা কে বললাম চলো শান্তিনিকেতন ঘুরে আসি দুজনে।
শর্মিলা সিঁদুর পরতে পরতে বলে উঠলো -সত্যি?
আমি বললাম একদম সত্যি।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে বাথরুম গেলাম, একেবারে স্নান টান করে বেরোলাম।
দেখি শর্মিলা ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে।
আমি সর্টস পরে, তাড়াতাড়ি করে ব্রকোলি, গাজর, শিমলা মির্চ আর বেবিকর্ণ দিয়ে ওটস্ বানিয়ে নিলাম।
দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট করতে করতে ফোন করে একটা রিসোর্টে রুম বুক করলাম।
ঠিক দশটার সময় দুজনে নিচে নেমে এলাম। ব্যাগ দুটো গাড়ির ডিকিতে রেখে, গাড়ি স্টার্ট দিলাম, শর্মিলা কে বেল্ট’টা লাগিয়ে নিতে বললাম।
ব্যানার্জী ভিলা থেকে বেড়িয়ে গাড়ী মেন রাস্তায় এলো। মিউজিক সিস্টেমে মান্নাদের গান ভেসে এলো- “স্বপন যদি মধুর হতো, হোক সে মিছে কল্পনা, আমায় জাগিও না…।”
শর্মিলা একটা কটনের স্লিভলেস ছোট ছোট প্রিন্টের জামা পরেছে আর গোলাপি রঙের সিগারেট প্যান্ট। চোখেও গোলাপি সেডের সানগ্লাস, দারুণ মিষ্টি লাগছে ওকে। আমাকেও পরানো হয়েছে গোলাপি রঙের ডোরাকাটা টি সার্ট আর ডিপ ব্লু রঙের ডেনিমের জিন্স।
এর মধ্যেই বড় নীলপুর থেকে বর্ধমান স্টেশন পেরিয়ে গেছি। ফায়ার ব্রিগেডের অফিসটা পেরোতেই পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল ভরিয়ে নিলাম।
শান্তিনিকেতন দুজনেরই বেশ ভালো লাগে। শর্মিলার ভালো লাগে রবীন্দ্রনাথের জন্য। ও বেশ ভালো আবৃত্তি ও গল্প পাঠ করে। আমার ভালো লাগে সবুজ প্রকৃতির জন্য, কেমন যেনো একটা রোমান্টিকতা খুঁজে পাই।
নবাবহাট থেকে ডান দিকে টার্ন নিলাম কিন্তু তালিত রেলওয়ে গেটে এসে আটকে গেলাম ১০ মিনিট।
গেট পেরোতেই আসতে আসতে গতি বাড়ালাম। এক ঘন্টায় গুসকরা পৌঁছে গেলাম। গুসখাড়া থেকে দুটো বিয়ারের বোতল কিনলাম।
আরো আধা ঘণ্টা লাগলো শান্তিনিকেতন পৌঁচ্ছাতে। রিসর্টের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই। একজন এগিয়ে এলো, ওয়েলকাম বলে মাল গুলো রিসেপশনে নিয়ে গেলো, রিসেপশনে সব মিটিয়ে সুন্দর একটা ঘরে পৌচ্ছে দিলো রুমবয়। এসি টা চালিয়ে দিতেই বিছানায় এলিয়ে দিলাম নিজেকে।
শর্মিলা বললো – বাইরে কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে, কত গুলো ছবি তুলে আনি।
আমি বললাম – যাও, আমি একটু রেস্ট করি, এতোটা পথ ড্রাইভ করে টায়ার্ড লাগছে, তুমি বরং স্যালাড আর একটা স্টার্টারের অর্ডার দিয়ে দিও।
চোখটা বোধ হয় লেগে গেছিলো, দরজায় দরাম্ দরাম্ আওয়াজে আর “দরজা খোলো, দরজা খোলো” চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেলো।
তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলতেই দেখি মা সামনে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে!
মা বললেন – কিরে সারারাত ঘুম আসেনি নাকি? বেলা দশটা বাজে! প্রায় দশ মিনিট ধরে ডাকছি তোকে!
আমি কিছু না বলেই মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
মা পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম।
মা বুঝতে পেরে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
মা বললেন – তুই কি আজও স্বপ্ন দেখেছিস?
আমি বললাম – হ্যাঁ মা।
গত ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে হয়েছিল শর্মিলা আর আমার। লাভ ম্যারেজ।
ও আর আমি দুজনেই কলেজের লেকচারার। আমরা গত ৭ই এপ্রিল টিকিট কেটেছিলাম প্যারিস যাবো হনিমুন করতে। ২৪ শে মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা হলো। টিকিট ক্যানসেল করলাম। শর্মিলা ও আমার দুজনেরই মন খারাপ হলো।
৭ ই এপ্রিল সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজনে মিলে শান্তিনিকেতনের পথে রওনা দিলাম। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম হোটেল খোলা আছে শুধু সোনাঝুরির হাট বসে না।
আমি ড্রাইভ করছিলাম, শর্মিলা খুশীতে টইটুম্বুর ছিলো, আমরা গুসখাড়া পেরিয়ে গেছি।
তখন গাড়ীর স্পিড ৭০ -৮০ তে ওঠা নামা করছিলো, হঠাৎ ফাঁকা রাস্তা পেয়ে শর্মিলা আমাকে গলা জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটে জোরে চেপে ধরলো। ঐ ভাবে কত সেকেন্ড ছিলাম দুজনে জানিনা, একটা গাড়ীর বিকট হর্ণের আওয়াজে সামনে তাকাতেই দেখি একটা ট্রাকটার গ্রামের রাস্তা থেকে হাইওয়ে তে উঠে এসেছে ঠিক আামাদের গাড়ীর কয়েক মিটার দূরে। আমি অল্প ব্রেক চেপে প্রাণপণে স্টিয়ারিং টা ঘুরিয়ে ট্রাকটার’টাকে বাঁচাতে গিয়ে
দেখলাম আমার গাড়ীর বাঁ সাইড টা একটা গাছে ভীষণ জোরে ধরাম করে ধাক্কা মারলো!
তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেলো! আর কিছু মনে নেই।
আজ ৭ই এপ্রিল, শর্মিলার পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার একবছর পূর্ণ হলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।