মেহেফিল -এ- কিসসা পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দা শর্মিলী জাহান

‘নৈর্ঋতে’ গভীর মানবীয় অনুভূতির খেলা

শুরুতেই বইটির নামকরণ সম্পর্কে কিছু লেখছি , “নৈর্ঋতে” নামকরণের সার্থকতা খুঁজতে আমায় বেশ ঘোলাপানি খেতে হয়েছে ; বই ঘেটে জানতে হয়েছে, বিস্তর ভাবতে হয়েছে। “নৈর্ঋত” দশটিদিকের একটি দিক। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণকে “নৈর্ঋত” বলা হয়। এর আরেকটি অর্থ পেয়েছি অভিধানে তা হলো “রাক্ষস বা দৈত্য-দানব”। পুরো বইটি জুড়ে আছে গভীর মানবীয় অনুভূতির খেলা ; যা ব্যক্তি-মনের কোন এক গহীন কোণে শেকড় গেড়ে বসে অবিরত দোলা দিয়ে যায়, কুড়েকুড়ে খায় । প্রভাব পড়ে ব্যক্তি জীবনেও। মনের কোণে লুকিয়ে থাকা এই মানবীয় অনুভূতিগুলোকে হয়তো লেখক দৈত্য-দানবের সাথে তুলনা করেছেন । মনের দানব জীবন তছনছ করে বটে।

বইটিতে মোট ১৪ টি গল্প আছে । আগেই লেখেছি পুরো বইটিই অনুভূতির খেলা অর্থাৎ গল্পগুলোর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বুঝতে পাঠককে প্রখর অনুভূতিশক্তি কাজে লাগাতে হবে । প্রতিটি গল্প ভাবনির্ভর এবং উত্তমপুরুষে বর্ণনামূলক । কোন ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ বর্ণনা নেই। ডায়ালগও যৎসামান্য । এখানেই মুগ্ধ হয়েছি আমি । অসাধারণ শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যালংকরণে ঘটনা ও পরিবেশের বর্ণনায় লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন ; ফলে কম ডায়ালগ সম্মৃদ্ধ , ভাবমূলক এবং বর্ণনামূলক গল্পগুলোর মাঝে ডুবে যেতে সমস্যা হয়নি একদম । একঘেয়ে লাগেনি । এক কথায় অসাধারণ মুন্সিয়ানা !

” শেষরাতে ঘরে ফেরা মানুষগুলো পূর্ণিমার অর্ধমৃত শরীরটা জারুলগাছের ছায়ায় পড়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু কেউ সেদিকে যাবার সাহস পায়নি। রাতভর বনজারুলের ফুল টুপটাপ ঝরে পড়েছে ওর শরীরে। অঘ্রাণের হিমহিম হাওয়ায় হয়তো শরীরটা জুড়িয়ে যাচ্ছিলো । কেউ জানে না সেই হাওয়ার সাথে পূর্ণিমার শেষ নিঃশ্বাসটা কখন হারিয়ে গেছে । ‘লবান’-এর পূর্ণিমা তিথিতে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়লে রাতটা আজও একা কাঁদে। আর সেই ছায়ার বুকে বনজারুলের সবগুলো ফুল ঝরে পড়ে।” মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের শেষ গল্প ” একজন পূর্ণিমা মাহালী” তে পূর্ণিমার পরিণতি বর্ণনায় লেখকের কথাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেছে ।

১৪টি গল্পের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়বস্তুও মুগ্ধ করার মতো।

কিছু মানুষের হৃদয় সহানুভূতিশীল ও মমতাপূর্ণ হওয়া সত্বেও বৈরাগী মনটা তাদের এতোটাই শক্তিশালী হয় যে সংসারে থিতু হতে পারে না তারা । ফেলে আসা পথের বাঁকে বাঁকে হাহাকার করতে থাকে সংসারের মায়াগুলো তবু কারো কারো ফেরা হয় না সংসারে । মাথার উপর সংসারটা যেন “ছায়ামেঘ” হয়ে তিরস্কার করতে থাকে আজীবন ; মুক্ত স্বাধীন, বাঁধাহীন বৈরাগ্য জীবনটাও তাই উপভোগ্য হয় না । ভুক্তভোগী হয় সংসারের প্রতিটি মানুষ । চমৎকার গল্প ” ছায়ামেঘ”

শেকড়ের গন্ধ ও টান কতোটা গভীর হতে পারে তা উপলব্ধি করিয়েছে  “সন্ধ্যারানির কলকাপাড় শাড়ি”- টা ।

ভালোবাসা’- র মতো মন ও আন্তরিকতা থাকা সত্বেও কিছু মানুষ আজীবন নিজের ও অন্যের প্রেমিক মনটা নিয়ে খেলে বেখেয়ালে । এমনতর বেখেয়ালী প্রেম প্রেম খেলা খেলতে খেলতে জটিলতা সৃষ্টি করে মানবমন ও সংসারজীবনে ! সে জটিল জাল ছিঁড়ে নিজের ও ভালোবাসার মানুষগুলোর মুক্তি মেলে না কখনো ।…মল্লিকা নামে সমাজের অসাধারণ একটি চরিত্র তুলে এনেছেন লেখক “কাচফুল” গল্পে ।

“সমকামিতা” জটিল একটি সমস্যা । একটি সংসারে সমকামিতা ঘিরে তিনটি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন লেখক “সরোজ জীবন”-এ । ছোট গল্পটিতে স্বল্প কথায় তিনটি ভাগে উত্তম পুরুষে তিনজনের মনোকথন তুলে ধরার বিষয়টি মুগ্ধ করেছে ।

হৃদয় আছে , আছে সব মানবীয় গুণ ও অনুভূতি ; তবু যখন একটিমাত্র শারীরিক অক্ষমতা সরাসরি স্বাভাবিক সংসার জীবন হতে বিচ্যুত করে কাউকে, কেমন হয় তখন তার জীবন? তবু সোনালির মতো কেউ কেউ এক চিলতে আলো কুড়িয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে ; বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে শেখায় সমাজের বৈষম্যগুলোকে । অসাধারণ গল্প ” তৃতীয়া”

সত্যিকারের ভালোবাসা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করে না । গভীর অনুভূতির চাপে মুখটি হয়তো বন্ধ হয়ে যায় ; মুখ খুলে বলা হয় না “ভালোবাসি”। দু’চোখের লাজুক পাতা অবিরত পলক ফেলে যায় অপর দুটি চোখে সাড়া ফেলতে। অপর সে চোখে যদি লাজুক চোখের ছায়াটা না পড়ে তো?… ভালোবাসাটা নিরবে নিভৃতে কাল-মহাকালে ডুব দিয়ে ধূসর ছায়া-কাঁটা হয়ে বিদ্ধ করতে থাকে হৃদয় । এমন ভালোবাসা যার জীবনে এসেছে সে-ই বুঝেছে এর মর্মপীড়া ।…হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প ” বিষুব”

অবুঝ, সরল শিশুমনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা যদি পিতা-মাতারা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান করেন তো শিশুর বিকাশটা হবে চমৎকার । একা একা মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করে অবসাদগ্রস্ত শৈশব কাটাতে হবে না তাকে ।  সুন্দর মেসেজসম্পন্ন গল্প “টুটুলের বাইনোকুলার”
ভালো লেগেছে “প্রজাপতিরা উড়ে যাক” এবং “চতুষ্পদ” গল্পদ্বয়ও।

কৈশোরে যে মন-হৃদয় শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হতে হাসতে খেলতে বিকশিত হবার কথা সে বয়সে যদি পুরো সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়? নিম্ন আয়ের জীবন সংগ্রামী মানুষের সুখ-দুঃখের খন্ড  চিত্র লেখকের অপূর্ব বর্ণনাশৈলীতে জীবন্ত হয়ে উঠবে “দৈনিক রাশিফল” গল্পে । শুভকামনা রইলো লেখক নিবেদিতা আইচ- এর জন্য । বইয়ের নামঃ “নৈর্ঋতে”লেখক, নিবেদিতা আইচ ,প্রকাশনীঃ পেন্সিল , প্রচ্ছদঃ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।