• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১৯)

যুদ্ধ যুদ্ধ

উনিশ

রাত গভীর। নতুন বসতির মানুষগুলো ঘুমে। চারিদিকে চঞ্চলতা বলতে কিছু রাতচরাদের আনাগোনা। বসতির মাথার ওপর দিয়ে তাদের উড়ে যাওয়ার শব্দ। পৃথিবীজুড়ে শুক্লপক্ষের চাঁদজ্যোৎস্নার ঢল। পুরুষ কোকিলটার ডেকে ওঠার অপেক্ষায় মানুষটা। ওই ডাককে সে হেলায় অবহেলা করে বেশ তৃপ্তি বোধ করে। কিন্তু কই, আজ তো পুরুষ কোকিলটা ডাকছে না! সময়ের মনে সময় বয়ে যাচ্ছে শুধু। তবে কি পুরুষ কোকিলটা সব আশা ছেড়ে দিয়ে রণে ভঙ্গ দিল! মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে মানুষটা। তাহলে এ খেলায় জিৎ তারই হল শেষপর্যন্ত! এখন পরম নিশ্চিন্তে নিজেকে ঘুমের কোলে সঁপে দিতে চায় সে। নিশ্চিন্তি তার বাকি জীবনের জন্যও।
এমন সময় বাইরে কারোর উপস্থিতি টের পেল মানুষটা। এই অসময়ে কে হতে পারে, ভাবতে না ভাবতে তার দরজায় টোকা পড়তে সে চমকে ওঠে। এত রাতে কে এল আবার। এ নির্ঘাত চোরডাকাত না হয়ে যায় না। বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করে ওঠে মানুষটার, গলা শুকিয়ে কাঠ। তবুও যথাসাধ্য সাহস করে বিছানা থেকে নেমে ত্রিশূলটা হাতে তুলে নিল। ওটা এখন আর মরচে ধরা ভোঁতা নেই। বেশ ঝকঝকে তকতকে, টকটকে লাল সিঁদুর মাখা।
কে বাইরে? ক্ষীণ কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করে মানুষটা।
আমি অগস্টিন, দরজা খোল গোঁসাই!
অগস্টিন! তা এত রাইতে আমার লগে তোর কী দরকার শুনি?
দরকার আছে গোঁসাই, তুমি দরজা খুলবে কিনা তা জানতে চাই আমি! ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে অগস্টিন।
না, খুলুম না। তুই কী মতলবে আইছস তা আগে ক?
তৎক্ষণাৎ দরজায় এক মোক্ষম ধাক্কা পড়তে ডাঁশাটা ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে পাল্লা দুটো হাটখোলা হয়ে গেল।
অগস্টিন এখন মানুষটার মুখোমুখি। অগস্টিনের খালি গা। পাথরকুঁদা টনটনে পেশীবহুল শরীরের ঘামে লেপ্টে আছে জ্যোৎস্নার রেণু। তার মুখাবয়বে গনগনে আগুনের আঁচ। ডান হাতে উঁচিয়ে ধরা হাঁসুয়ায় পিছলে যাচ্ছে আকাশের চাঁদ।

আমাদের দুজনের সম্পর্ক ভাঙ্গতে পারুকে তাবিজ পরিয়েছ তুমি? বজ্রকঠিন গলা অগস্টিনের।
মিথ্যা কথা!
মানুষটার দিকে আগ্রাসী দৃষ্টি নিয়ে দুকদম এগিয়ে আসে অগস্টিন। দেখে কুঁকড়ে যায় মানুষটা। ওই হাঁসুয়াটা যেন মানুষটার বুকের ভিতরে রক্ত নেওয়ার খেলায় মেতেছে।শুধু কোপটা পড়া যা বাকি।
নফরগঞ্জের হাট থেকে তুমি তাবিজ কেনোনি? পারুকে ঘরবন্দি করে রাখার পরামর্শ তুমি দয়ালজ্যেঠুকে দাওনি? আর তুমি এখন পারুকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাইছ! তা হবে না জেনে রেখো। আমি তোমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছি গোঁসাই, যদি তুমি আমাদের দুজনের মাঝখান থেকে সরে না দাঁড়াও তাহলে এই হাঁসুয়া তোমার রক্ত নেবে!
মানুষটার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুখে শব্দ ফুটছে না। চোখদুটো মৃত পশুর চোখের মতো ভাষাহীন।
অগস্টিন ফের কঠিন গলায় বলল, কাল সকালেই যেন নয়া বসতির সবাই জানতে পারে, তুমি পারুকে বিয়ে করছ না!
ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে অগস্টিন। পারুকে হারানোর আশঙ্কায় মানুষটা হঠাৎ প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠছে। সামান্য একটা অনাথ, বংশপরিচয়হীন ছেলের কাছে হেরে গিয়ে সে কিনা বাকি জীবনটাকে নষ্ট করবে, কক্ষনো না! শত্রুকে নিকেশ করার এই তো মোক্ষম সময় যায়! মানুষটার বুকের ভিতর কালনাগিনি হিসহিসিয়ে ওঠে। হাতের মুঠিতে ত্রিশূলটাকে শক্ত করে ধরে কাঁধের ওপর উঁচিয়ে নিয়ে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে সামনে ছুড়ে দেয়। ত্রিশূল অগস্টিনকে আমূল বিদ্ধ করে।
ও মাগো, হে প্রভু! তীব্র যন্ত্রণায় কাতর অগস্টিন সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে। হাঁসুয়াটা হাত থেকে দূরে ছিটকে যায়। মানুষটা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পিঠে গাঁথা ত্রিশূলটাকে ধরে প্রবল শক্তিতে শরীরের আরও গভীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তার পাদুটো এখন অগস্টিনের পিঠ আর ঘাড়ের ওপর শক্ত হয়ে বসেছে। অগস্টিন বারকয়েক শরীরে মোচড় মেরে দুর্বোধ্য কিছু শব্দ উচ্চারণ শেষে একসময় নিথর হয়ে যায়। তবুও নিশ্চিত হতে নাকের কাছে হাত রাখে মানুষটা, বুঝতে পারে, না শ্বাসক্রিয়া আর চলছে না। তারপর দেহটাকে কাৎ করে বুকের স্পন্দন পরীক্ষা করে। না, হৃদযন্ত্রের কোনও ক্রিয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ শত্রু নিকেশ হয়েছে। কিন্তু এই লাশ এখন সে কী করবে? হ্যাঁ, লোপাট করে দিতে হবে। কেউ যেন এর সামান্য চিহ্নটুকুও কোত্থাও না পায়। কিন্তু একটা ম্লেচ্ছর লাশকে সে তো কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না, বুকে জড়িয়ে ধরেও নিয়ে যেতে পারবে না। খানিক ভেবে একটা উপায় বার করল সে। ত্রিশূলে গাঁথা লাশটাকে কাঁধের পিছনে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভারি লাশ, ত্রিশূলের দন্ডটা মানুষটার কাঁধের মাংসকে কামড়ে ধরে। শরীরের একটা দিক বেয়াড়ারকমভাবে ঝুঁকে পড়ে।খুব কষ্ট হচ্ছে, তবুও তাকে লাশ বয়ে নিয়ে যেতেই হবে। কুলকুল করে ঘামতে থাকে। অতি সন্তর্পণে চড়াই ভেঙ্গে ভেড়ির উপর উঠে দাঁড়ায়। হাঁপ ধরা বুকটা ঢিসঢিস করছে তার। বড় বড় শ্বাস টেনে খানিক দম নেয়। তারপর উৎরাই ভেঙ্গে নদীর চরার দিকে এগিয়ে চলে। গভীর রাতের আকাশে ভরা যুবতী চাঁদ এখন। তারাদের উৎসব। রাতচরা পশুপাখি আর দিশাহারা বাতাস এ দৃশ্যের সাক্ষি থাকে। বেখেয়ালি নদী শুধু আপন বেগে বয়ে যায়।
চরায় এখানে ওখানে অনেক চৌখুপি। তা থেকে উপযুক্ত একটা বেছে নেয় মানুষটা। চৌখুপিটার বুকে জমে দলদলে কাদামাটি। ওই মাটি সরিয়ে গর্ত করতে হবে। তারজন্য একটা কিছু চাই মানুষটার। লাশ থেকে ত্রিশূলটাকে বিচ্ছিন্ন করে নিতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। নোনামাটি আর কাদা জড়ানো ঘাস রক্তে ভেসে যেতে থাকে। সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট করার উপায় নেই মানুষটার। নোনা হাওয়ায় তাজা রক্তের গন্ধ এখন। ত্রিশূলটাকে হাতে নিয়ে সে চৌখুপিটায় নেমে পড়ে। গর্ত তৈরিতে দ্রুত হাত চালাতে থাকে। যদিও এই কাজে ত্রিশূলটা উপযুক্ত যন্ত্র নয়, কিন্তু এছাড়া আর উপায় কী। ত্রিশূলটা দিয়ে মাটি আলগা করে নিয়ে তা দুহাত দিয়ে তুলে পাশে স্তুপ করে রাখে। শরীরজুড়ে ঘামের নদী বয়ে যেতে থাকে তার।
হাঁসুয়াটা নদীতে ছুড়ে ফেলে দেয়। নোনাধরা ত্রিশূলের মাংসাশী দাঁতগুলো ভাল করে নদীর জলে ধোয়। নররক্তের স্বাদ পেয়ে নদী হিংস্র হয়ে উঠছে যেন। আজ তাহলে জোয়ার লাগবে জোর! সেরকমই তো চায় মানুষটা। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।
হ্যারিকেনের আলোয় বসে ত্রিশূলটায় তেলসিঁদুর মাখে মানুষটা। ওটাকে ঠিক আগের মতো দেখতে লাগছে এখন। ভাল করে পরখ করে নিয়ে ফের একই জায়গায় গেঁথে দেয়। যেন এই রাত্রে পৃথিবীতে বাড়তি কিছুই ঘটেনি।বড় ক্লান্তি লাগছে তার। কিন্তু ঘুম কি আর আসবে? যতই সে সাবধানে কাজটা করুক, বুকের ভিতরের আশঙ্কার ঝড় সে কী করে থামাবে। কাদামাটি মাখা শরীর খুব ভাল করে ধুয়েমুছে পরিস্কার নিয়েছে সে। ত্রিশূলেও আর রক্তের গন্ধ নেই। তারপরও…!ফের বিছানায় আসে। শরীরটাকে যতদূর সম্ভব বিশ্রাম দিতে চায়, যাতে করে রাত জাগার চিহ্নগুলো আর অপরাধের কালো ছায়া চোখেমুখে ফুটে না ওঠে।পৃথিবীতে জেগে না ওঠে এই হত্যার ঘটনা। একটাদুটো কাক ডেকে ডেকে ফেরে। ঘুমের কসরতে মাতে মানুষটা। কিন্তু তা কী আর সহজে আসার! ওই হাঁসুয়াটা যে এখনও তার বুকের ভিতরে রক্তের নেশায় বনবন করে ঘুরছে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *