সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১৮)
by
·
Published
· Updated
আমার মেয়েবেলা
মাধ্যমিক পরীক্ষা
স্কুলের জীবনটা আমার দারুণ ছিল। অংক ক্লাস বাদ দিয়ে সব ক্লাসেই আমি পড়া শুনতাম খুব মন দিয়ে।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তাই এই পরীক্ষার গুরুত্ব অত বুঝতাম না। অংক ক্লাসে দরজা দিয়ে পাখি ওড়া দেখতাম।
কোনও কোনও সময় জল খাওয়ার নাম করে বারান্দায় এসে নীল আকাশ দেখতাম। সারি সারি পাখি ওড়া দেখতে দেখতে কটা পাখি উড়ে গেল সেটাও গুণতাম। আর সমান ভাবে কি করে উড়ে যাচ্ছে এটা ভেবেও অবাক হতাম।
অংক ক্লাসে বসে আমার ভাবনার শেষ ছিলনা। চৌবাচ্ছা জলের অংক,আর একটা বাঁশের উপর বাঁদরের ঐ এগিয়ে যাওয়া আর পিছিয়ে আসার অংক যেদিন শিখেছিলাম সেই দিনই বুঝে গিয়েছিলাম আর যার জন্যই হোক অংক আমার জন্য নয়। আমার বাংলা ইংরেজি ইতিহাস ভূগোল জীবন বিজ্ঞান লজিক সব বেশ ভাল লাগত। কিন্তু অংকটাকেই কোনও দিন ম্যানেজ করতে পারিনি।
আমি খুব ছোট্ট থেকেই একটু ভাবুক প্রকৃতির মেয়ে ছিলাম।
চৌবাচ্চার জলের সঙ্গে মেলাতে চেয়ে ছিলাম জীবনের ওঠাপড়া।
পাঁজরের কোণায় কোণায় সবটুকু ভালোবাসা দিতে গেলে, সময়ের খাতায় কতটুকু অভিমান জমা থাকে তার হিসেব করতাম।
আবার বাঁশের ঐ বাঁদর টার মতো এগিয়ে যাওয়ার পর কতটা পিছোলে, আর এগিয়ে যাওয়ার অংকটাই যে থাকে না,,, এসব ভাবনা সেই তখন থেকেই।
আসলে বই এর অংক কষতে গিয়ে জীবনের আসল অংক শিখে ফেলেছিলাম খুব অল্প বয়েসে। যার ফলে আমি ভেতরে ভেতরে খুব পরিণত হয়ে উঠেছিলাম, যেটা সেই সময়ে আমার জন্য একদমই ভাল ছিল না।
######
ছোট থেকেই ঠিক হয়ে ছিল আমি ল’ পড়ব।বাবা মার খুব ইচ্ছে। বিশেষ করে আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়ে আমার উকিল হবে।
আমিও জানতাম ওকালতি পড়তে গেলে অংক লাগে না। তাই সেই পড়ায় কোনও টেনশন নেই।
সেই ছোট্ট বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, কালো কোর্ট গায়ে দিয়ে আমি এজলাসে কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছি। তখন থেকেই মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেছি। ভয় পেলে চলবে না। মাথা উঁচু করে চলতে গেলে নিজেকে সৎ থাকতে হবে। সত্যি কথা বলতে ভয় কিসের? আর সেই ছোট্ট বয়েসে এসব ভাবার ফল হল মারাত্মক। অংক মাথায় উঠল।
বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে শুরু করলাম।, সবার মধ্যে থেকেও কেমন যেন একা হয়ে যাচ্ছিলাম। কোন কোন সময় কথা বলতে ইচ্ছে করত, আবার কোন কোন সময় করত না। তখন কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করে কথা বন্ধ করে দিতাম।
এইভাবে ধীরে ধীরে
আমি বেশ একটা ঝগড়ুটে টাইপের হয়ে গেলাম।
কেউ কোনও কথা বললেই পাল্টা উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও সময় নিতাম না। মাথায় থাকত জিততে হবে, হেরে গেলে চলবে না। সেটা যদি সত্যি কথা হয়, তাহলে তো কোন কথাই থাকতে পারে না। আমি তো বলবই। হাত দিয়ে গুণতাম আর কত বছর পর আমি কোর্টে যেতে পারব। সব অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে পারব।
কিন্তু একটা ছোট্ট মেয়ের এত টরটরে সত্যি কথা সবাই ভাল চোখে নেবে কেন? সেই থেকে শুরু হল আমার অপ্রিয় সত্য কথা বলার সমস্যা।
সেই থেকে আমি আমার আত্মীয় স্বজনের সমালোচনার একটা বিষয় হয়ে উঠলাম। যে অপগুণ টা এখনও আমার আছে এবং বর্তমান জীবনে সেইজন্য আমি কারো কারোর বেশ অপছন্দের একজন।
তবে এখন অনেক পাল্টে ফেলেছি নিজেকে। নিজের বাড়িতে যে জোরটা থাকে পরের বাড়িতে তো সেই জোরটা থাকে না। আমার শ্বশুর বাড়ি একদমই আমার শ্বশুরেরই বাড়ি। স্বাধীন ভাবে এবং মাথা উঁচু করে থাকতে গেলে যে একটা নিজের বাড়ি থাকতে হয়, সেটা আমি শ্বশুর বাড়িতে পা দিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। বাবা বলেছিল কিচ্ছু করার নেই মেনে নেওয়া ছাড়া। সেই শুরু হল আমার মেনে নেওয়া। যাইহোক যে কথা বলছিলাম—-
আমি কোনও দিন কারোর ক্ষতি করি নি। উপকারী বন্ধু হিসেবে আমি বেশ পরিচিতই ছিলাম। আজও বন্ধুরা আমাকে সেরকমই ভাবে।
বন্ধু দের সঙ্গে ঝগড়ায় জিতলেও আমিই কিন্তু আবার আগে এগিয়ে এসে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে ভাব করতাম। বেশিক্ষণ আড়ি করে থাকতে পারতাম না।
আবার দুই বন্ধুর ঝগড়ার মধ্যস্থতা করতাম আমিই। ছোট থেকেই আমার মধ্যে একটা মাতব্বরি ভাব ছিল। যে কোন ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে খুব পছন্দ করতাম। আর বন্ধুরাও সেটা শুনত। এখনও শোনে। এখনও আমি না থাকলে ওদের কিছুই ঠিক হয় না। আমরা একে অপরকে এতটাই ভালোবাসি, সম্মান করি যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এমন একটা মজবুত বাঁধন তৈরি হয়েছে। যেটা আমরা মানে আমার স্কুলের এই দশ জন বান্ধবী কেউই ছিঁড়ে বেরোতে পারব না।
যা বলছিলাম-
সেই সময় আমি বেশির ভাগ সময়টাই একা থাকতে পছন্দ করতাম। তখন বয়স তের/ চোদ্দ। মনের ভেতর একটা ছটফটানি শুরু হয়েছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি,, ছোট থেকে যে বন্ধুর সঙ্গে পড়েছি, খেলা করেছি, মারামারি করেছি, তাকে ছুঁতে লজ্জা পাচ্ছি। তখন ছেলে মেয়ে যে আলাদা একটা ব্যাপার সেটা টের পাচ্ছি। ততদিনে মা আমার বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছে। ডাংগুলি, ক্রিকেট, ভলিবল, ফুটবল সব খেলাই বন্ধ তখন। শাসনে শাসনে প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বাইরে সাইকেল চালানো বন্ধ, যখন তখন রাস্তায় বেরোনো বন্ধ।
তখন আমি সময় পেলেই পাঁচিল টপকে ছাদে চলে যাই। পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো কুলগাছ টাকে মনের সব কথা বলে নিজেকে একটু হালকা করে নিই। এইভাবে সেইসময় ঐ কুল গাছটার সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায় ।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। হেড স্যার বাবাকে ডেকে বললেন বয়সটা একটু গন্ডগোল এর। বাবা বললেন বাড়িয়ে দিন দুবছর। সেই আমি খাতাকলমে ষোল হলাম। কিন্তু হলে কি হবে অংক তো সেই মাথার বাইরে দিয়ে বেরিয়েই যাচ্ছে। টেস্ট এর পর স্কুল বন্ধ হল। আমি খুব মন দিয়ে অংক করতে শুরু করলাম। যেমন করেই হোক অংক কে টাটা বাই বাই করতে হলে এই তিন মাস আমাকে খুব মন দিয়ে অংক করতে হবে। বীজগণিত জ্যামিতি টা বেশ ভালোই রপ্ত করলাম। আর পাটিগণিতের কয়েক টা অংক একটু মুখস্থ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আসলে আমার প্রধান সমস্যা ছিল অসম্ভব ভয়। পরীক্ষার সময় অংক করতে বসলেই ভেবে নিতাম আমি যদি কিছু না পারি? কিছুই পারব না ভেবেই পরীক্ষা দিতে যেতাম।
যাইহোক মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল। প্রথম দিন বাংলা। সকাল সারে সাতটায় বাস ছাড়বে। তখন আমাদের মাধ্যমিকের সিট পড়ত ধুলিয়ানের কাঞ্চনতলা স্কুলে (মুর্শিদাবাদ জেলা)। ভোর সারে চারটেয় উঠেছি একটু চোখ বুলিয়ে নেব। যাআআআ শুরু হয়ে গেল পেটেব্যথা। শরীরটা ভাল নেই। জানি এই ব্যথা আট/দশ ঘন্টা চলতে থাকবে। আমি উঠতেই পারছিনা বিছানা ছেড়ে। বাবা ওষুধ খাইয়ে কত আদর করে হাত পা টিপে কাতর গলায় বলল, তোর একটা বছর লস হয়ে যাবে। একটু চেষ্টা কর, ঠিক কমে যাবে। আমি তোর সঙ্গে যাব। তোকে একা ছাড়ব না। চল মা। সারে সাতটায় বাস চলে গেলে তখন তোকে কিভাবে নিয়ে যাব? আমি বললাম পরের বছর পরীক্ষা দেব। খুব পেটে ব্যথা করছে। যাইহোক বাবার কথায় কোনও রকমে রিক্সা করে স্কুলে পৌঁছালাম। বাস ছাড়ল। একজন গার্জেন যেতে পারবে। বাবাই উঠে পড়ল বাসে। আমি বললাম তুমি তো কিচ্ছু খেয়ে এলে না বাবা, তোমার তো ক্ষিদে পেয়ে যাবে। সে সময় আমাদের দুটো করে পরীক্ষা হত। আসতে আসতে রাত আটটা বেজে যাবে। বাবা বলল তুই আগে পরীক্ষা টা ঠিক করে দে, আমার চিন্তা করতে হবে না। কি বলি চুপ করে গেলাম। খুব কান্না পেল। সব বাবারা বোধহয় এমন ই হয়। বাইরের দিকে তাকিয়ে চোখ টা মুছে নিলাম। পেট্রলের গন্ধে বমি পায় বলে জানলার ধারের সিটটায় বসে ছিলাম। তাই আমার কান্না কেউ দেখতেই পেল না। এখন বসে ভাবি, মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় একমাত্র আমার বাবাই গিয়েছিল। আমাকে ঐ টুকু পথও একা ছাড়ে নি। কিন্তু যখন আমার সব থেকে বেশি দরকার ছিল সেই সময়েই মাত্র একষট্টি বছর বয়সে বাবা যে কিকরে চলে যেতে পারল সেটাই বুঝতে পারলাম না। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় অংক পরীক্ষার দিন অনেক অঙ্ক মেলাতে পারলেও জীবনের এই অঙ্ক আর মেলাতেই পারিনি। বাবা একবার আমার কথা ভাবল না?