হাতে পায়ে লোশন মালিশকালে পড়লো মনে
বাবা তো এ বস্তু মাখেনি কখনো গায়ে…!
নাকে মুখে ছাকা ছাকা সরিষার তেল মেখে বলতেন-
‘খাঁটি জিনিস, বড়ো উপকারী, চোখে ধরলে আরও ভালো’
সে যুগের মানুষ ছিলেন কি না
এ যুগের কি বুঝবেন…! অথচ লোশন
তখনো দোকানে পাওয়া যেতো ঠিকই।
জেল মাখা চুলগুলো পরিপাটি আঁচড়াতে গিয়ে দেখি
আগেকার আয়নাটা ছিলো না তো এতো বড়
আর এতো মসৃণ…! ছিলো একফালি ভাঙা কাঁচ, তাতেও আবার
প্রতিবিম্ব বিকৃত। বাবার মাথায়
শুষ্ক চুল, চিরুণীর দাঁত কটা বিলীন, নতুন যোগানোর
নেই আয়োজন- টানাপোড়নে এমনি সাদামাটা বেঁচে থাকা।
রিক্সাতে উঠে যাই অনায়াসে, শুধাই না ভাড়া
বাবা ঠিকই চড়তেন দাম দড় কষে, যেন যাত্রা শেষে
ধূর্ত চালক না পারে খসাতে
একটি টাকাও বেশি। কিংবা রাজ্যের পথ
পায়ে হেঁটেই দিতেন পাড়ি, তবু
পকেটের টাকা পকেটেই থেকে যাক- এই যেন পণ।
সেন্টের ঘ্রাণমাখা জামা, সিগারেট ফুকে ফুকে চলি
পথের ভিখারি যেই চায় দুটো পয়সা হাত বাড়িয়ে
অমনি দিলাম রাম ধমক, অকথ্য গালাজ তো আছেই।
বাবা তাকে ফেরাতেন খালি হাতে
তবু ধমকটা দিতেন না; আর তার কাছে সিগারেট ফুকা মানে
অকাতরে অর্থ ওড়ানো। অল্প আয়ের লোক-
বাউন্ডুলে তোড়জোড় তাকে কি মানায়…?
অফিসে ঢুকেই দেখি বেশুমার মক্কেল প্রতীক্ষা গুণে,
চেয়ার টেনে বসতেই টেবিলের আবডালে চলে আসে টাকা।
ঘুষ বললে মন্দ শোনায়, বাঁ হাতের কারসাজি
ডাকি আমি এ-কে।
এমন সুপটুতা ছিলো দুষ্কর বাবার পক্ষে
অতি ভীতু ব্যক্তির দ্বারা হবে কেন
এ তো নির্ভীক সওদা…!
হয়তো তিনি বলতেন- ‘এ কাজ করার আগে
মরণ দিও প্রভু, তবু ঘুষ নয়।’
বাবাটার লাগি বড়ো মায়া হয়, জীবনটা তার
কোনদিন উপভোগ করা হলো না। সে যুগের মানুষ ছিলেন কি না
এ যুগের কি বুঝবেন…!
২। প্রথম পরিচয়
সেলিম ভাই, আপনার জন্য আমার ধাঁধাঁ, আচ্ছা বলুন তো…
আমাদের প্রথম দেখাটা কখন কোথায় হয়েছিল?
মুখ কাচুমাচু করার কিছু নেই, জবাব আমিই বলি-
এগারোতম ছড়া উৎসবে আপনার হাতে মাউথপিস, আমার হাতে
একটা চিক্কন কাগজ, হিজিবিজি কাটাকাটি সমেত কী সব লিখা।
আপনার মাথার গেরুয়া হ্যাটটা
বাঁ হাতে ঠিক করে নিয়ে বললেন,- ‘এবার স্বরচিত
কবিতা পাঠ করতে আসছে…’
হ্যাঁ, প্রথম একবার আটকে গিয়েছিলেন, তারপর ভুলের মতোই
শুনালেন সবাইকে আমার নাম। আমি তখনও অর্বাচীন এক আঁতেল-
কবিতাপত্র হাতে ঠকঠক কাঁপছি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁশিতে
সাফ করছি গলা।
সামনে অজস্র শ্রোতা, আমি কবিতা পাঠ
শুরু করলাম। কেউ কান চুলকায়, কেউ হাত চুলকায়, কেউ মাথার চুলে
আঙুল বোলাতে বোলাতে পায়ের জুতা ঠিক করে। আবার কেউ কেউ
ভ্রুয়ের পাশে রাজ্যের যন্ত্রণা নিয়ে কুচকানো কপালে তাকিয়ে থাকে
আমার দিকে, তাকিয়ে থাকতে হবে-
তাই হয়তো তাকিয়ে থাকা।
মনে মনে ভাবি, কবিতা নির্বাচনে
ভুল করলাম না তো…! প্রেমের কবিতা হলে
ভালো হতো, কিংবা হাসির ছড়া। চোখ বন্ধ করে
কাঠের পুতুলের মতো অনড় বসে শুনতো সবাই এক্কেবারে প্রত্নযুগের
কালো পাথরের মূর্তি যেমন; তারপর হাসতে হাসতে
পড়তো গড়িয়ে এদিক ওদিক।
আমার যে প্রেমিকা, আমি যার বাড়ির পথে যাবার বেলায়
খোলা জানালায় কমসে কম তিনবার চোখ রাখি, তাকে উদ্দেশ্য করে
দাঁত কটমটিয়ে বললাম-‘অন্তত তুমি তোমার
ওড়না ধরে টানাটানি বন্ধ করো, অনুরোধ করি, আমার প্রতিভাক
মাঠে মরতে দিও না। আমার অপমান তো তোমারও অপমান।’
একজোড়া জালালী কবুতর হাততালি দেওয়ার মতো শব্দে
উড়ে গেল হলরুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কারও দৃষ্টি
গেলো না সে দিকে।
একটা শিশু দেয়ালের লেজকাটা টিকটিকিটাকে
তাড়া করতে গিয়ে ছুঁড়ে মারলো হাতের বাঁশি, সেদিকে দিলো না
মনোযোগ কেউ।
ছোট বেলায় চোখে কাঁচপোকা পরে যেমন জল ঝরছিল
তেমনি টলমল করে উঠলো আমার চোখ। সবার দৃষ্টি
এবার আমার দিকে, শুধুই আমার দিকে…
আমি সেলাই কলের নিরবিচ্ছিন্ন ঘূর্ণয়মান চাকার মতো
মাইক ফাটিয়ে অনর্গল বলে গেলাম-
‘হে মাটি… হে স্বদেশ… হে মায়ের অশ্রুসিক্ত
পিতার কবর, ওগো পূর্বপুরুষের গলিত লাশে উর্বর পুণ্যভূমি।
যতক্ষণ হৃৎপিণ্ডে রক্ত আছে, যতক্ষণ ঘাড়ের উপর মাথাটি দণ্ডায়মান
কসম তোমার- যে লুটেরা লুটে নেয় তোমার সুখ, যে কুলাঙ্গার
চেটে খায় তোমর সম্ভ্রম, তোমার দুর্দিনে
যে দুর্বৃত্ত বগল বাজিয়ে হাসে তোষামোদি হাসি
বিরুদ্ধে তার রুখে দাঁড়াতে গিয়ে
মরণ যদিও আসে- লড়ে যাবো, লড়ে যাবো, লড়ে যাবো।’