• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ১৪)

কু ঝিক ঝিক দিন

১৪.

“সকলের আহারাদির পরে অন্নপূর্ণা তাহাকে কাছে বসাইয়া প্রশ্ন করিয়া তাহার ইতিহাস জানিতে প্রবৃত্ত হইলেন। বিস্তারিত বিবরণ কিছুই সংগ্রহ হইল না। মােট কথা এইটকু জানা গেল, ছেলেটি সাত-আট বৎসর বয়সেই স্বেচ্ছাক্রমে ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে।
অন্নপূর্ণা প্রশ্ন করিলেন, “তােমার মা নাই?”
তারাপদ কহিল, “আছেন।”
অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তিনি তােমাকে ভালােবাসেন না?”
তারাপদ এই প্রশ্ন অত্যন্ত অদ্ভুত জ্ঞান করিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “কেন ভালােবাসবেন না।”
অন্নপূর্ণা প্রশ্ন করিলেন, “তবে তুমি তাঁকে ছেড়ে এলে যে?”
তারাপদ কহিল, “তাঁর আরও চারটি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে আছে।”
অন্নপূর্ণা বালকের এই অদ্ভুত উত্তরে ব্যথিত হইয়া কহিলেন, “ওমা, সে কী কথা। পাঁচটি আঙুল আছে বলে কি একটি আঙুল ত্যাগ করা যায়।”
তারাপদর বয়স অল্প, তাহার ইতিহাসও সেই পরিমাণে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ছেলেটি সম্পূর্ণ নূতনতর। সে তাহার পিতামাতার চতুর্থ পুত্র, শৈশবেই পিতৃহীন হয়। বহু সন্তানের ঘরেও তারাপদ সকলের অত্যন্ত আদরের ছিল; মা ভাই বােন এবং পাড়ার সকলেরই নিকট হইতে সে অজস্র স্নেহ লাভ করিত। এমন-কি, গুরুমহাশয়ও তাহাকে মারিত না—মারিলেও বালকের আত্মীয় পর সকলেই তাহাতে বেদনা বােধ করিত। এমন অবস্থায় তাহার গৃহত্যাগ করিবার কোনােই কারণ ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিথি গল্পের তারাপদকে আমরা চিনি।সে বারবার নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে পালাতে ভালোবাসত।এই যে অনিশ্চিত জীবন,সব থাকা স্বত্বেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া এ জীবন আমার কাছে অদ্ভুত এক আকর্ষণের।
জীবন পথে চলতে চলতে এমন কত কথাই মনে পড়ে।এই তো সেদিন কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ায় ঢাকা একটা স্টেশনে গিয়ে নামলাম।ভয় ঢর হীন এক ১৩বছরের মেয়ে।না,এতটুকুও ভয় করেনি বাড়ি থেকে পালিয়েছি বলে।কেউ ধরে নেবে এ কথা ভুলেও ভাবিনি।খালি একটাই অসয়াস্তি ছিল, রাতে কোথায় থাকব!তবে নিশ্চিত ছিলাম কাছে দূরে কোথাও শ্মশান থাকবেই। নতুবা স্টেশন তো আছেই।
তখন সবে দুপুরের রোদ ডালপালা মেলছে আকাশে।পকেটে পয়সাও নেই। খিদে পাচ্ছে।স্টেশনের থেকে বেরিয়ে একটা গুমটি।আমারই বয়সী এক মেয়ে উনুনে চা করছে।আর তার মা ডিমের ওমলেট ভাজছে।
ডিমের গন্ধে খিদে আরও বাড়ছে।চুপ করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।জল চাইলাম।হঠাৎ দেখি সেই মা উঠে এসে বললেন,বাড়ি পালাইছিস?
আমি বললাম খিদে পেয়েছে মা।
কার মা,কিসের মা,কেনই বা মা বললাম জানি না।কিন্তু সেই মুহূর্তে সেটাই মনে পড়েছিল।
আমার দুপুর রাত সব কেটে গেল সেই মায়ের আশ্রয়ে ভালোবাসায়।জেনে গেলাম তারা মা মেয়ে দুজনে থাকে। বাবা পালিয়েছে। সেই মা বলল,পালাস না।পালালে বাড়ির লোকের বুকে বড় দাগা লাগে।
জেনে গেলাম মেয়েটির নাম শিমুল। কারন তার জন্ম শিমুল গাছের তলায়।তার এই নাম মা দিয়েছে। মেয়ে হওয়ায় বাপ ছেড়েছে সেই মুহূর্তে। আরও জানলাম,মেয়ের জন্ম দেওয়া মা নাকি এই সংসারে বাতিল।
আমিও তো মেয়ে।আমার মায়ের তিন মেয়ে।কই আমরা তো বাতিল নই।আমার মাও বহাল তবিয়তে বাবার সঙ্গে।
তাহলে!সেই প্রথম জানলাম সমাজে লিঙ্গ বৈষম্যের কথা। জানলাম, মেয়ে হওয়া অপরাধ।
আমাদের বাড়িতে তিনবোনের অগাধ আধিপত্য। আর আধিপত্য আছে বলেই আমি ছোট্ট থেকে বাউণ্ডুলে। মনে মনে ভাবতাম এই সংসার জীবন আমার জন্য নয়।আমি তারাপদর মতো বাঁধন ছেড়ে পালাবো।
অথচ পালাতে পালাতেই সম্পর্কের বন্ধনে বার বার আটকে পড়েছি।এই যেমন শিমুলের মা। আমাকে তার শাড়ি পেতে মাটির বিছানায় শুতে দিল।ভাত,আলুসিদ্ধ আর ডিম ভেজে দিল।
সেই চালের স্বাদ যেন অমৃত।অথচ আমাদের বাড়িতে কখনো এমন চালের ভাত হয় না।
এমনভাবে শুধু নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলুসিদ্ধ মাখে না মা।তাতে লেবু,পেঁয়াজ দেওয়া হয়।তবু আমি খুব আনন্দের সঙ্গে সেই খাবার খেলাম।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল, কদিন তাদের সঙ্গে থাকতে।তাদের জীবনটাকে দেখতে।
বাবা বলেন,যত দেখবি তত উপলব্ধি করবি তুই যে জীবন কাটাস তার বাইরেও অন্য জীবন আছে।সেখানে উঁচু নিচু বিভেদ নেই। প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা সুখ, আলাদা দুঃখ। সবার একটা স্বপ্ন আছে।সেটা একান্ত নিজের। তুই হয়তো সেটা দেখতে পাবি না,বাকিগুলো যদি ছুঁতে পারিস জীবনের অনেকটা পথ সহজ হয়ে যাবে।
আমিও তো চাই এদের মতো করেই থাকতে।
কিন্তু আমি জানি আমার পালাবার আয়ু ২৪ঘন্টা। কাল সকালে এখানে থাকব না।বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরব।কারন আমি বাড়ি না ফেরা অবধি বাবা পুলিসের মাথা খারাপ করে দেবে।আর ঠিক কাল সকালের মধ্যেই যেভাবে হোক পুলিসের লোক আমাকে পেয়ে যাবে।এই ধরা পড়ে যাওয়াটা আমার সহ্য হয় না।তাই কাল ভোরেই আমি পালাব।আবার কয়েক দিন পর ফিরে আসব অন্য কোনো স্টেশনে অন্য কারোর ঘরে।
কিন্তু শিমুলের মায়ের জন্য আমার আজও মন খারাপ করে,আজও ইচ্ছে করে সেই স্টেশনে যেতে।জেনে আসতে সেই কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ায় মোড়া স্টেসনের বাইরের গুমটিতে শিমুল নামের সেই মেয়েটি আজও একইভাবে চা বানাচ্ছে কিনা!যাওয়া হয় না।কারন এখন আমি জানি সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যায়।আমার দেখার দৃষ্টিটাও হয়তো বদলে যাবে।তাই যা বুকের ভিতর কালো পেনসিল দিয়ে লেখা আছে তা থাক।বৃথা কেন তাকে আবার পেন দিয়ে লেখার চেষ্টা করব!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *