“আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥”
-রবীন্দ্রনাথ
আমার বিদেশি বই পড়া ও তা অনুবাদের মাধ্যমে দ্বিতীয় বার পড়ার সুচনা অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট নামে এরিখ মারিয়া রেমার্কের অসাধারণ কালজয়ী উপন্যাসের মাধ্যমে। এর আগে টারজান অমনিবাস, শরতরচনাবলী,বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি,চাঁদের পাহাড়, রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প,চোখের বালি,শেষের কবিতা, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দ মঠ,কপাল কুন্ডলা, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছিনিয়ে খাইনি কেন ও অন্যান্য গল্প, সত্যজিতের ফেলুদা,কিরিটি রহস্য,শরদিন্দু অমনিবাস পড়ে ফেলেছি। বইগুলোর উল্লেখ করলাম এই কারনে যে এই সব বই পড়েছি যখন তখন আমি এখনকার মতে বেশ ছোটো।ক্লাস ফোর ফাইভের মধ্যে এগুলো শেষ। বাবা মা যে বইই আনত তাই গ্রোগাসে পড়ে ফেলা আমার নেশা ছিল।টারজান না পড়ে কোনো পরীক্ষা দিতে যেতাম না। পরীক্ষার আগের মুহূর্তে বইয়ের বিশেষ অংশ দেখে নেওয়ার মত টারজান আর ডায়নার প্রেমের দৃশ্যের ডায়লগ গুলো ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিতাম।যেন এগুলোর থেকেই প্রশ্ন আসবে।আর না দেখে নিলে একটা উত্তরও আমি দিতে পারব না।এর একটা কারনও ছিল।স্কুলের কোনো বন্ধুই তখনো এই বইটার সঙ্গে পরিচিত নয়।কাজেই যদি একটি উত্তরও দিতে হয় তা নিজেকেই দিতে হবে।
দাদু বলতেন,এ মেয়ে বড় হয়ে পড়াশোনা করবে না,মূর্খ হবে,আর বছর বছর পরীক্ষায় টারজানের প্রেম, ভ্রমরের আত্মজীবনী,এসব লিখে খাতা ভরিয়ে আসবে।ক্লাসে আর ওঠা হবে না।খুকু (আমার মায়ের ডাক নাম)এ মেয়ের যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবি মঙ্গল। নইলে বিপদে পড়বি।অশিক্ষিত মেয়ের পাত্র জুটবে না জামাই যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন!
আমার মা সেই মুহূর্তে হয়তো একটু বকত,তারপরেই যে কে সেই। কারন এই বইয়ের নেশা ধরানোর প্রথম মানুষ তো তিনিই। ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে হবে,বোনদের দেখতে হবে,এসবের পুরস্কার বই।আর সেগুলো তিনিই এনে দিতেন বেশি।
অন্য দিকে বাবা আমাকে কোন পন্ডিত ভাবতেন জানি না,এমনিতে বলতেন,বুদ্ধি নেই, কিন্তু বই আনলে এসব বইই এনে দিতেন।তাঁর দেওয়া প্রথম বইটি যদি টারজান অমনিবাস হয়,দ্বিতীয়টি হল ওয়ার এন্ড পিস আর তৃতীয়টি অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।
ওয়ার এন্ড পিস একবর্ণও বুঝতে পারিনি,বাধ্য হয়ে বাবা শেষের বইটির বাংলা অনুবাদ এনে দিয়েছিলেন।ও হ্যাঁ, আরেকটি বই এনেছিলেন,রুটস। এল্যেক্স হেলিস।বাংলায় শিকড়ের সন্ধানে।অনুবাদ গীতি সেন।বলা যেতে পারে বিদেশি সাহিত্য পড়ার সুচনা এভাবেই। ক্লাস ফোরে।
এখনো মনে পড়ে তলস্টয়ের বইয়ের এক বর্ণ না বুঝে বাবাকে বলেছিলাম, ইংরেজি জানি না।পড়তে পারছি না।
উত্তরে বাবা বলেছিলেন, না জানাটা অপরাধ নয়,কিন্তু চেষ্টা না করাটা অপরাধ। তুমি প্রতিদিন অন্তত দু থেকে তিন পাতা পড়বে।তাহলে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।
এই কথাটা সব ক্ষেত্রেই শুনেছি। রোজ একটা কাজ যেটা ভালো লাগে না,সেটা করতেই হবে।তবেই ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।
তা করতেই যখন হবে পড়া শুরু হল।
আমাদের সময় স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে ইংরেজি চালু ছিল।এইভাবে বাড়িতে শিক্ষার সুচনা হয়ে গেছিল আগেই।
এতে ইংরেজি কিছুটা শিখলাম, আর বিদেশি বই পড়ার অভ্যাস হয়ে গেল।
একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম,অল কোয়াইট পড়তে পড়তে,যুদ্ধ এক মারাত্মক ক্ষতিকর জিনিস। একজন অন্যজনকে না চিনে কেবল শত্রুপক্ষের ভেবে নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলে।
আর ফিরে আসে বিভৎস সব স্মৃতি নিয়ে। এই ক্ষত তার জীবনে শেষ দিন অবধি প্রভাব ফেলে। প্রেমের বই বাদে এই বইটি পড়ে আমার রাতের ঘুম বন্ধ হয়ে গেছিল। পলের জন্য অদ্ভুত কষ্ট হত।যুদ্ধ কিভাবে তাকে অনুভূতিহীন করে তুলছিল ধীরে ধীরে আমি তা স্পর্শ করতে পারছিলাম।
এরপর একে একে পড়ে ফেললাম থ্রি কমরেডস,এ টাইম টু লাভ এন্ড টাইম টু ডাই, দ্য নাইট ইন লিসবন সহ এরিখের নানা বই।কেমন এক নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
এরিখের অধিকাংশ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সেই প্রেক্ষিতে মানুষের জীবনের বদলে যাওয়া ঘটনা। ভেঙে পড়া মানুষের মুখের নানা প্রতিচ্ছবি,এক ধরনের নির্লিপ্ততা, তার মধ্যেও বাঁচার আকুলতা,
সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।হয়তো সেই সব কিছুই বুদবুদের মতো মিলিয়ে যাবে তবু তাদের কথা বুকে গিয়ে বাজে।
এ যেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জেনেছি তুমি আছো আমি আছির মত এক অনুভূতি। বিভৎসতার মধ্যে ভালোবাসা,হিংস্রতার মধ্যে শান্তির খোঁজ।আমি সেই সব উপন্যাসের চরিত্র গুলো ছুঁতে চাইছি।কখনো পল কখনো তিন বন্ধুর ভালোবাসা আমাকে বিভোর করে দিচ্ছে। ভাবছি বন্ধু এমনও হয়! না,আমার কোনও বন্ধু এত ঘনিষ্ঠ ছিল না যাদের সঙ্গে এই চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায়।একমাত্র বোনের সঙ্গেই ভাগ করে নিচ্ছি কস্টার,রবার্ট আর অটো লেঞ্জকে।যুদ্ধ থেকে ফিরেও তাদের বন্ধুত্ব অটুট।আর ওই মহিলা কি নিদারুণ ভাবে উজ্জীবিত করছে তাদের।
বাবা বলেছিলেন,এই উপন্যাস প্রকাশ পাবার পর রেমার্কের বই ও তাকে নিষিদ্ধ করা হয় নিজের দেশে।দেশ ছেড়ে তিনি আশ্রয় নেন অন্য দেশে।মারিয়ার জন্য মন খারাপ হয়েছিল খুব।
সমার সেট মম বা শেকসপিয়ার নেশাটা ধরাতে পারেননি।টলস্টয় তো দীর্ঘদিন পড়িই নি প্রথম বইটা শেষ করার পর।
কিন্তু সেদিন একটা জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম, বিশ্ব সাহিত্য না জানলে আমার আমিকে জানা হয় না।আজও আমি সেই খোঁজে।