মেহেফিল -এ- কিসসা সাইফুল ইসলাম জুয়েল (রম্য গল্প)
সুন্দরবনে বাঘ সিংহ দর্শন
ট্যুরের শুরুটাই হল ভুল দিয়ে। একটা নয়, অনেক ভুল। সন্ধ্যা সাতটায় ট্রেন ছাড়বে। যেখানে থাকি, সেখান থেকে কমলাপুর বেশ দূরে বলে আগেই কমলাপুরের কাছাকাছি অবস্থিত ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। ওখান থেকে হেঁটে যেতে বড়জোর ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে। তো বাড়ির কাছে সিনেমা হল থাকলেই যেমন বেশি বেশি সিনেমা দেখা যায় না (বাড়ির বড়দের কানে আসার ভয়ে), তেমনি কাছে এসে বসে থাকলেও ট্রেন মিস করার ভয় উড়িয়ে দেয়া যায় না। আধাঘণ্টা আগে বেরিয়ে সেই পথটাকে মনে হল সুদূর সাইবেরিয়া। রাস্তায় জ্যাম, জেলীর আস্তরণ বসিয়েছে বাস-রিকশা-গাড়ি। এক পর্যায়ে তো বোঝা নিয়ে রিকশা থেকে নেমে দৌড় লাগালাম।
হাঁপাতে হাঁপাতে এক মিনিট আগে প্লাটফর্মে উপস্থতি হলাম। ওদিকে ট্রেন নেই। আমি আসার আগেই ছেড়ে গেল নাকি?
ডিজিটাল স্ক্রিনে দেখলাম- ট্রেন আসতে আরও চল্লিশ মিনিট লেট হবে। ছাড়তে তো বহু দেরি!
বিষ্যুদবার হওয়ায় ট্রেনে অন্যান্য দিনের তুলনায় হেভভি ভিড়। কোনোমতে ঠেলেঠুলে ৬৬ নম্বর সিটটাতে গিয়ে বসলাম। সাতটার ট্রেন কোন সে ঘড়ির হিসাব মিলিয়ে আটটা দশে ছাড়ল কে জানে! এদিকে, কিছু লোককে দেখলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সিটের হিসাব মেলাচ্ছে। কিন্তু কয়েকটা সিটের হদিস মিলছে না। রাত একটার দিকে একদল এলো। তারা এসে সুরসুর করে মিলিয়ে ফেলল সিটের হিসাব। এটা-ওটা তাদের সিট। এতক্ষণ মনুষ্যজ্যামে পাশের বগিতে আটকে ছিল। তাদের কারণেই আবিষ্কার করলাম, আমার সিটটাও আমার নয়, তাদের! অগত্যা নতুন করে ৬৬ নম্বর সিট খুঁজতে শুরু করলাম। একবার তো মনে এও কুডাক দিল- ভুল করে আবার ভুল বগিতে উঠে পড়িনি তো! নাকি ভুল ট্রেনেই চেপে বসেছি! অবশেষে যখন ৬৬ নম্বর সিট খুঁজে পেলাম, দেখি একজন সেখানে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন!
খুলনা গিয়ে জাহাজে অন্য একটা দলের সঙ্গে ভিড়লাম। তারা সুন্দরবনে এসে বাঘ দেখার জন্য উদগ্রীব। হাড়বাড়িয়ায় বাঘের প্রায় তাজা পায়ের ছাপ দেখার পরও হতাশ সবাই।
রাতে বনরক্ষীর সঙ্গে কথায় কথায় মজা করে বললাম, ‘আপনার নিজের আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে অস্ত্র আছে। আমাদের কাছে বাঘ এলে আমরা কী করব?’
বনরক্ষী অস্ত্র দেখিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘বাঘ এলে আপনাদের কিচ্ছু করতে হবে না। যা করার তিনিই করবেন!’
আমি এবার নিজের বীরত্ব জাহির করতে পকেট থেকে গুলতি বের করে তাকে দেখিয়ে বললাম, ‘বাঘ মামাকে গুলতি মারব।’
বনরক্ষী হঠাৎ বেশ সিরিয়াস হলেন, ‘আপনাকে একটা গোপন কথা বলি। কাউকে বলবেন না। কাল সত্যি সত্যিই বাঘ আসবে। তবে, আপনি ভুলেও তার দিকে গুলতি ছুড়ে মারবেন না, পিলিজ!’
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। আমাদের গাইডের পরনে ডোরাকাটা একটা টি-শার্ট দেখলাম। বাঘের এলাকায় এসে বাঘ সাজতে ইচ্ছে করছিল বোধহয়!
সকালে টাইগার টিলায় বাঘের অভয়ারণ্যে গিয়ে একপাল হরিণের দেখা মিললেও বাঘের টিকিটিরও দেখা মিলল না। তবে, টাইগার টিলায় ভাঙা হাঁড়ির দেখা পেলাম। আমাদের দলের একজনকে সেই হাঁড়ি ভাঙা দেখে বলতে শুনলাম, ‘দেখ দেখ, বাঘের হাড়! এতকাল জানতাম বাঘের হাড্ডি সাদা, এখন দেখছি লাল। এজন্যই বুঝি বাঘ দেখতে অমন ডোরাকাটা!’
অবশেষে মামার দেখা পেলাম আমরা! বিকালে হিরণপয়েন্টে যাওয়ার পথে ট্রলার থেকে কিছুটা দূরে একটি গাছের নিচে অনেকেই বাঘটিকে দেখল। শুয়ে শুয়ে নিজের লেজ দিয়ে কান চুলকাচ্ছে। কেউ কেউ বাঘটিকে দাঁড়ানো অবস্থাতেই দেখেছিল, তাদের চোখের সামনেই নাকি বাঘটা শুয়ে পড়েছে। এদিকে যারা দেখেনি তারা আরেক গল্প ফেঁদে বসল, ট্রলার চালক নাকি তাদেরকে আগেই বলেছিল, দেখবেন, একটু পরে অনেকেই বাঘ বাঘ বলে চেঁচিয়ে উঠবেন! আসলে সামনে একটা গাছের গোড়ার দিকে একটা শিকড় এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যে, দূর থেকে ওটাকে দেখলে যে কেউ বাঘ বলেই মনে করবে!
কিন্তু তাদের এ গল্পটা ধোপে টিকল না। দলের একটা অংশ বাঘ দেখার তৃপ্তি নিয়ে হিরণপয়েন্টের কেওড়া গাছের ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করল।
চিকন একটা পথ দিয়ে চলছি আমরা। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। হরিণ চলার পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ পথ দিয়ে নাকি বাঘও যাতায়াত করে। একটু আগে এখানে চাকরির কারণে থাকছে এমন একজন জানাল, কালরাতে এই এলাকায় বাঘ দেখা গেছে। বাঘ প্রাণী খেলে পচা একটা গন্ধ থেকে যায়। গতকাল সেই গন্ধটা নাকি পেয়েছিল তারা।
ভয়ে অস্থির অবস্থা সবার। ফিরে যাওয়ার সময় দেখা গেল, একটু আগে দেখে যাওয়া বাঘটা এখনও সেই আগের অবস্থাতেই শুয়ে আছে! হয়তো গাছ বা তার শিকড়-বাকড় না কাটা পর্যন্ত বাঘটা ওখানে ওভাবেই থেকে যাবে আজীবন!
দুবলার চর হয়ে পরদিন সকালে করমজলের উদ্দেশে আসার পথে বন্য শূকর চোখে পড়ল। পরে এক আঙ্কেল মোবাইলের গ্যালারিতে ছবি বের করে বললেন, ‘ভাল্লুক দেখলাম!’
আমরা অবাক। দেখলাম শূকর, হয়ে গেল ভাল্লুক! একটু পরেই মনে পড়ল, সুন্দরবনে তো ভাল্লুকই নেই। আঙ্কেল গতকাল রাতে আমাকে তার কানাডা ভ্রমণের কথা বলেছিলেন, তাই বুঝলাম-ভাল্লুকটা তিনি ওখানেই দেখেছিলেন। সে গল্প এসে ছাড়ছেন এখানে।
তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, ‘আজ সকালে আমি সুন্দরবনে সিংহ দেখেছিলাম!’
একজন কথাটা বিশ্বাস করে আফসোসের সুরে বলল, ‘একা একাই দেখলেন! ডাকলেনও না!’
আমি আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, ‘সিংহটা আমি আর আঙ্কেল- দুজনেই দেখেছি। আঙ্কেলের মোবাইলে ছবিও তোলা আছে। দেখতে পারেন।’
আঙ্কেল সত্যি সত্যিই তার মোবাইল বের করে সিংহের ছবিটাই সেই লোককে দেখালেন।
এতকিছু দেখলে আর কারোর আফসোস থাকার কথা না। তাই গাইড বেচারা রাতে স্বীকার করলেন, তিনি শীতের পোশাকের আড়ালে যেই ডোরাকাটা গেঞ্জিটা পরেছিলেন, ওটা নাকি যারা বাঘ দেখতে চায়, তাদের জন্য! জঙ্গলে একপর্যায়ে সবার থেকে লুকিয়ে দূরে সরে যেতেন। তখন বনরক্ষী সবাইকে ইশারা করে বাঘ দেখাতেন! কিন্তু তখন নাকি হিরণপয়েন্টে সবার বাঘ দেখার কথা শুনে, পরে তার আর বনের মধ্যে একাকী যাওয়ার সাহস হয়নি!
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘এই কাজটা করলে খারাপ হতো না। বাঘের গায়ে গুলতি মারার শখ আমার ছোটবেলা থেকে। ইচ্ছেটা পূরণ হতো অন্তত!’
করমজলে দেখা মিলল একপাল বানরের। এর-ওর থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নিচ্ছে। একটা বানরকে দেখলাম মনের সুখে চিপস খাচ্ছে। একটু দূরে এগিয়ে আরেকটাকে দেখলাম- এনার্জি ড্রিংকস খাচ্ছে! টাইগার এনার্জি ড্রিংকস!
আমি তখন পাশের জনকে বললাম, ‘বাঘ-হরিণ দেখার পাশাপাশি এও দেখলাম- বানর খাচ্ছে খোদ বাঘকে (টাইগার)! সুন্দরবন ভ্রমণের ষোলকলাই পূর্ণ হল।’