পেশা শিক্ষকতা। অরণী বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
প্রকাশিত হয়েছে এই পৃথিবী এই দেশ ও নিভৃত পরবাস নামে দুটি কবিতার বই। টাইমমেশিন ও গুপ্তহত্যা অতঃপর নামে দুটি বড় গল্পের বই।
মূলত উপন্যাস লিখছেন। বর্তমানে ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন।
ঢাকায় বসবাস করেন।
অপরূপা সেই মেয়ের মুখের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয়েছি কতদিন। কিন্তু কন্ঠ তার আমার চেয়েও হাস্কি অথবা হার্স যাই কেন। ওর কন্ঠেও কবিতা! এবসার্ট। আমি এটিই ভাবতাম। কিন্তু মাসুদ ভাই নাছোড় বান্দা। তিনি কবিতা তুলবেনই তার কন্ঠে।তার উপর আবার সেটা শক্তির। শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন তখন সদ্য। এদিকে আমরা বসেছি সেই কবিতা পাগল কবিকে নিয়ে বিশাল প্রোডাকশন করবো বলে।ব্যপক তার সাধনা।স্বনামধন্য নাট্য ব্যক্তিত্ব ইশরাত নিশাতের গ্রন্থিত পান্ডুলিপি নিয়ে বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী মাসুদুজ্জামানের বিশাল কর্মযজ্ঞ সেটা – নাম ‘পদ্যবাউল’।যার কথা বলছিলাম সে শারমিন।তখনও স্রোত আবৃত্তি সংসদের সবচেয়ে কম আবৃত্তি করা মেয়েটি। ঝরঝরে হাসিতে মাতিয়ে রাখে। ঢলোঢলো মুখখানি রূপের আতিশয্যে ভরপুর। কিন্তু কবিতা পড়তে গিয়ে দারুণ আড়স্ট। আজও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ কবিতা পড়তে গেলে যার কন্ঠ এখনো গভীর বিষাদে মনে পড়ে সে শারমিন মুস্তাফা।তারই কন্ঠে এই অসম্ভব যেদিন সম্ভব হলো সেদিন নির্মিত হলো এক অসাধারণ প্রেজেন্টেশন, মুগ্ঘশ্রবণ কবিতা ‘একা’।
সেই রূপ ছলোছলো মেয়েটি যখন রিহার্সেলে বসতো তখন তার কন্ঠ গম্ভীর। মেঘের মতো ঘন কালো আর নির্বাক তার দুঃখ।আমরা তখন বসেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে।কবিতার নির্মান আর আবৃত্তির প্রোডাকশন তো নয় এ যেন বাংলা সাহিত্যের অনার্স কিংবা মাস্টার্সের ক্লাস। সারাদিন ব্যাপী চলমান আমরা কজনে মিলে।সকাল দুপুর গড়িয়ে কখনো সন্ধ্যাও লাগো লাগো। পড়ে চলেছি একাগ্র নিবিষ্ট ‘শক্তি’।শক্তির ব্যক্তি জীবন। কবিতার ভাবনা। এক একটি কবিতার উন্মুল গ্রন্থিল পেশী প্রতিটি কোষ আমাদের পাঠযোগ্য তখন। কবিকে না বুঝলে কবিতা বোঝা যায় কেমনে। কবিকে না জানলে তার কবিতার পাঠ হয় কী করে।কবিকে না জানলে এক জনম জানা যায় কী করে!একজন মানুষ কেমন করে কবি হয়ে ওঠেন তার পাঠ ব্যবচ্ছেদ ইট কাঠ পাথর সিমেন্ট তারপরইতো একটি কবিতার আবৃত্তি যোগ্য নির্মাণ। তিনি একজন মানুষ। চলেছেন শ্বাশত। তিনি এখন। তিনি তখন। তিনি বর্তমান। তিনি ভবিষ্যৎ। তিনি জীবিত। তিনি মৃত। তার মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোদ্ধার চেয়েও সত্য আমি জেনেছি কালে কালে কাজে কাজে পড়তে পড়তে।একজন মানুষ শুয়ে রয়েছেন অতল ভবিষ্যতে। নির্বিকার নির্জীব নিঃসঙ্কচিত্ত নিবিঢ় নিথর।আজকে বসে ভাবছেন তিনি কালকের কথা। হিন্দু হয়ে ভাবছেন তিনি মুসলিমের কথা। চিতায় পুড়ে খাক হতে হতে তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন কবরের নিঝুম অন্ধকারে। আর নিরলে শুয়ে শুয়ে ভাবছেন একা নিঃসঙ্গ প্রহর।ঠিক মৃত একজন মানুষের মতন পার্থিব জীবনেও কখনো গভীর একাকীত্ব জড়িয়ে ধরে পরম প্রেমে। জনমের বিষাদে। জন্মান্তরের দহনে। আর তখন কেবল এক আশ্রয় কবিতা। না হলে এমন গভীরতায় উচ্চারিত হয় ..
তোমাদের ছেড়ে এসে অ-মূল বৈরাগে
একা লাগে ভারি একা লাগে
এ যেন এক বিপুল বিষাদ। নিরন্তর যাতনা। এ এক দূর। ভীষন এক নিকট। জনবহুল পথ কলরব কাকলিতে মুখর প্রভাত সৌরোজ্জ্বল দুপুর আর বিষাদ রাত্রির থেকে দূর। এ বিরাগ বাধ্যতামূলক। এ বিষাদ প্রস্তুতিহীন। এ বৈরাগ ইচ্ছের নয়। এত এত নৈকট্য আহব্বান পেছনে ফেলে এ বড় দূর। ঠিক এমনই এত বিষাদে এত বিনাশের আর এত বিন্নাসের মায়ায় নির্মিত কবিতাটি…। এই কবিতার বোধ জন্মান্তরের মতো লাগে।আমাকে রিলেট করে এই কবিতা জীবন আর মুত্যুর মাঝখানে।বেঁচে থেকেও মৃতের কানে শোনা দূরন্ত জীবন। মরে গিয়েও জীবিতের চোখে দেখা খুব প্রিয়তর আঙিনা খোকা কিংবা ঘাসপোকা। বেভুলে মনে পড়ে যায় দূরন্ত কালো মেঘ। কিন্তু নেই সেখানে জীবিতের কিংবা জীবের উদ্বেগ। মৃত্যু আর জীবনের মাঝখান এটি। মৃত আর জীবিতের এ যেন এক গভীর অপ্রকাশযোগ্য সাঁকো। আমার কাছে এ যেন এক গভীর যোগমন্ত্র।বহুদিন একা একা গভীর শূন্যতায় বিনিদ্র রাতে যাপনের মহাশুন্যে আমি পড়েছি এই মন্ত্র। যোগ হয়েছে যা সাধনে।আর পড়তে পড়তে কেবলই মনে পড়েছে সেই মেয়েটির ঝরঝরে হাসি। অপরূপ গালের মায়া। কি গভীর বেদনার সুখে কী গভীর বিষাদের ঐ্শ্বযে নির্মাণ করেছিল সে ‘একা’।অনেককাল কবিতার সাথে আবৃত্তির সাথে যোগাযোগ বিহীন। দারুণ ব্যস্ততর যাপিত জীবনের কর্মক্লান্তি পেরিয়ে যখন একা। তখনই আমাতে বহুকাল পর জেঁকে বসেছে শক্তি জাঁকিয়ে বসেছে ‘একা’। নেই স্টেজ নেই মাইক্রোফোন গ্যালারী ভরা দর্শক। মাঝে গেছে যুগ যুগান্তর। তবু একটি শব্দও ভুলিনি। তবু একটি বিন্দু বেদনারও নেই এতটুকু স্খলন। তবু একা নিবিড় নিঃসঙ্গতায় পড়ে চলেছি শক্তি, আমার প্রিয়তম কবিদের একজন। পড়ে চলেছি একা…
একা লাগে ভারি একা লাগে
তোমাদের ছেড়ে এসে অ-মূল বৈরাগে
একা লাগে ভারি একা লাগে।
এখানে লাফায় ঘাসে পোকা
আঙিনায় মানুষের খোকা
এখানে দূরন্ত ঘাসে পোকা।
এখানে উদ্বেগ নেই মেঘে
দেখার মতন নেই জেগে কেউ,
একা দুঃখে ও আবেগে
একা লাগে বড়, একা, লাগে।