জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ১৪)

মুসলমানীর কাঁচা দুধ, সেজবউয়ের গোলারুটি

পর্ব ১৪

ওই তো দেখতে পাচ্ছি মা জননী জ্বলন্ত উনুন বুকে চেপে তিনতলার ছাদ থেকে দোতলায় নামিয়ে আনছে। এক আধদিন নয়, ফি রোজ, ৩৬৫ দিন, বছরের পর বছর। যতদিন না বাড়িতে গ্যাস এল। ধোঁয়ায় ঘরদোর নষ্ট হবে, তাই এই ব্যবস্থা। এটা যে কতটা বিপজ্জনক, হাত থেকে উনুন পড়ে যেতে পারে, স্টেপ মিস হতে পারে, সেটা তাকে বহুবার বলেও কোন লাভ হয়নি। তাই শহরে প্রথম গ্যাসের আপিস খুললে বাবা সর্বাগ্রে গ্যাসের সং যোগ নিলেন। গ্যাসের আগে আসত  কুঁদো কয়লা, তারপর গুল কয়লা।
তবে গ্যাস বা কয়লা, কিংবা মামারবাড়ির উঠোনে তিনটে ইঁট পেতে বানানো ইন্সট্যান্ট উনুনে ডিমের ঝোল, ভাতের পিকনিক- সবের ভূমিকা তো একটাই। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের  মধ্যে সবচেয়ে আবদেরে ইন্দ্রিয়টির তৃপ্তি সাধন। সে আয়োজনে কোন খামতি ছিল না। যাকে বলে লপচপানি খাওয়া। খুব ছোটবেলায় মনে আছে গরমকালে মর্নিং স্কুল হত। বাড়ি ফিরে আমার বাঁধা খাওয়া ছিল লুচি, আলুভাজা আর দুধ। আমি একহাতে বই পড়তাম, অন্য হাতে লুচির মধ্যে আলুভাজা রোল করে দুধে চুবিয়ে খেতাম। সে আর বেশি কথা কি? আমি লেবুতলা পার্কের একটি বাড়ির কাকাতুয়াকে জানি, যে রাতে লুচি আর দুধ খেত। স্মৃতির স্বাদের আরো তরিবাতির মধ্যে আছে মার হাতের সুজির খিচুড়ি, সাবুর খিচুড়ি, উপমা, চিঁড়ের পোলাও, কড়াইশুঁটির কচুরি,  সরষে দিয়ে পারসে বা ইলিশের ঝাল, চিংড়ি ভাপা, তোপসে মাছের ফ্রাই, মেটে চচ্চড়ি,  যুক্তিফুল, বেগুন, বড়ি দিয়ে চচ্চড়ি, মটর শাক, পাঁপড়ের ঝাল, রোববার দুপুরের খাসির মাংস-ভাত।জ্বর থেকে উঠলে ঘি আর গোলমরিচ ছেটানো আলুমরিচ, মুখের স্বাদ ফেরানোর জন্যে। আর অদ্ভুত ছিল,  দুপুরে সবকিছুর পরে মা শেষ পাতে দুধভাত খেত আলুসেদ্ধ মেখে! কিংবদন্তী আছে আমি নাকি উঠোনের কালমেঘ (যার তুল্য তেতো হয় না) পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতাম। তাই হয়তো অনেক তিক্ততা হাসিমুখে উড়িয়ে দিতে পারি।
তবে খাওয়ার বেশি ধূম পাঁজিতে না খাওয়ার জন্য চিহ্নিত দিনগুলোতে!ষষ্ঠী সারা বছরে অনেকগুলো। জ্যৈষ্ঠে অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাই ষষ্ঠী, শ্রাবণে লোটন বা লুণ্ঠন ষষ্ঠী, ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠী, আশ্বিনে দুর্গাষষ্ঠী, অঘ্রাণে মূলাষষ্ঠী, পৌষে পাটাই ষষ্ঠী, মাঘে শীতলষষ্ঠী, আর সবার শেষে চৈত্রে দুটি ষষ্ঠী- অশোকষষ্ঠী আর নীলষষ্ঠী। আমার ধর্মকর্মে বেশ উদাসীন মা, যাঁর জীবনে দুটি আনন্দ- গান আর মানুষজন, দিদিমার পেড়াপীড়িতে মাত্র তিনটি ষষ্ঠী করেন – সরস্বতী পুজোর পরের দিন শীতল ষষ্ঠী, দুর্গাষষ্ঠী আর  চৈত্রে বছর শেষের নীলষষ্ঠী। অন্যদের কথা জানি না, আমার মায়ের এইসব ষষ্ঠীতে উপোষের কষ্টের থেকে খাবারের স্বাদ বদলই বেশি। বাবা বলেন- ও তো তোমাদের মুখ পালটানোর পুজো। তাই নারকেল কুরো ছড়ানো সাবু মাখা, লুচি, হরেক ফল, মিস্টি আবার  শীতল ষষ্ঠীর গোটা সেদ্ধর সঙ্গে পান্তা। এই গোটা সেদ্ধর তুলনা আমি আর পেলাম না। আমার মা করত ভাজা গোটা, কেউ কেউ ঝোল ঝোল গোটা করত। তবে শীতল বা দুর্গা ষষ্ঠী মা ঘরে বসেই করে, কোথাও যেতে হয় না। কিন্তু নীল ষষ্ঠীতে তো না বেরিয়ে উপায় নেই। কথায় আছে
 নীলের ঘরে দিয়ে বাতি
জল খাও রে ভাগ্যবতী
সারাদিন উপোস থেকে (অর্থাৎ অতি উপাদেয় সাবু মাখা খেয়ে)  সন্ধেয় নীলকণ্ঠ শিবের মাথায় ডাবের জল ঢেলে উপোসভঙ্গ (বেশি কিছু না,  ঘিয়েভাজা পাটে পাটে খুলে যাওয়া চারটি পরোটা,  শুখনো শুখনো আলুর দম, বেগুন ভাজা, আর মিস্টি তো শেষ পাতে মাস্ট)। তো  এই সব ব্রতীদের জন্যেই রাসমাঠে  অস্থায়ী চালাঘর বানানো হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে নীলের ঘর, সেখানে আজকের দিনে অধিষ্ঠান করছেন নীলকণ্ঠ শিব। এই নীলকণ্ঠ শিব থেকেই কি নাম নীলষষ্ঠী? কিন্তু মেয়েদের ব্রতকথায় পাচ্ছি স্বয়ং মা ষষ্ঠী এসে সন্তানহীন বামনীকে বলছেন ‘সংক্রান্তির আগের দিন উপবাসী থেকে নীলাবতীর পুজো করে নীলকণ্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিবি। তারপর প্রণাম করে জল খাবি। একে নীলষষ্ঠী বলে’ এখন এই নীলাবতী কে? সেটা না জেনেই বহু বছর নীলের মজা পেয়েছি। মজা বলে মজা। চালাঘরটি বেজায় নিচু, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়, তারপর সেখানে ভিড় ঠেলাঠেলি, তার মধ্যে মা কোনরকমে ঢুকছে, আমি খুব সিরিয়াস মুখ করে ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছি, ডালায় সশিস ডাব, পাঁচ রকম ফল, তার মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় বেল, আরো কত কী এবং অবিশ্যি অবিশ্যি কাঁচা দুধ। এই কাঁচা দুধ নিয়ে ঝক্কি কম না। প্রায় প্রতি বছরেই কাঁচা দুধ রাখার কথা মা ভুলে যেত, তখন মার বিপত্তারিণী হয়ে দেখা দিত দুধের দিদি, মানে যে মুসলমান মহিলা আমাদের দুধ দিত। মা ভুলে যাবে জেনেই সে প্রতিবার খানিকটা কাঁচা দুধ সরিয়ে রেখে দিত। তার স্বামীর নাম সম্ভবত ছিল আকবর, কিন্তু তার নামটি যে কী হাজার জিগেস করেও জানতে পারিনি। স্বামীর বাড়িতে থাকত, কিন্তু ঘরে নয়, ঘরণী ছিল আরেকজন। নিজের ও তিন ছেলেমেয়ের ভাত নিজেকেই যোগাড় করতে হত আর সেটা ওই দুধ বিক্রি করে। মুসলমানের পোষা গরু মুসলমান হয় কিনা আমি জানি না, মহাদেবও জানেন না। সেই গরুর দুধ মাথায় ঢালায় তাঁর কোনদিন তো আপত্তি দেখিনি।
তো  মা এবং দুধের দিদির সম্প্রীতির প্রতীক স্বরূপ সেই দুধ শিবের মাথায় ঢালার পর চালাঘরের বাইরে এসে যখন দাঁড়াই, তখন আকাশে তারা ফুটে গেছে। চৈত্রের শেষ সন্ধেটি বড় মনোরম। শিবমন্দিরের পাশের কোষাঘাট থেকে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে। এককালে এই পুকুরটির সঙ্গে আদি গঙ্গার যোগ ছিল, কোষা নৌকা এসে লাগত এখানে, সেই থেকে কোষাঘাট। আধো অন্ধকার মাঠে হঠাৎ একটা কুমীরকে দেখে চমকে উঠি। প্রতিবছর নীলের ঘরের পাশে মাটির কুমীরটি বানানো হয়। জানি না কেন। কিন্তু কুচোকাঁচার দল বেজায় মজা পায় দেখে। কুমীরটি আজকেই ভেঙে ফেলা হবে না। যতদিন না বৃষ্টির জলে ধুয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়, ততদিন থাকবে এভাবেই। আমার হঠাৎ মনে হয় অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও শিবমন্দিরের নিঃসঙ্গ শিবের একজন সঙ্গী জুটল।
 পরের দিন পয়লা বৈশাখ। নিম হলুদ বাটা মেখে স্নান, এক ঘটি জলে পাঁচটা ফুল আর সোনা রুপোর আংটি রেখে দিত মা, স্নান করে বেরোলে সেই জল ছিটিয়ে দিত গায়ে। এইভাবে নাকি সারা বছর শুভকে ছুঁয়ে থাকা হয়। দুপুরে মুগ ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, পার্সে, রুই, খাসির মাংস, শেষে দই -এর ভূরিভোজ।  নতুন কিছু পরা, পুজোর মতো দামী নয়, হাল্কা সুতির, বাড়িতে পরার মতো কিছু। আর অগুন্তি লোকজনের আসা, মিস্টি, চা, আর মায়ের গান, গভীর রাত অব্দি চলা আসর। হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়বে মায়ের গলায় ‘নিশিদিন নিশিদিন’ কিংবা ‘পা, পা মা গা রে সা’। কিন্তু সে তো পরের দিন। আজ চৈত্রের শেষ সন্ধেয় এক কুমীর আর এক শিবলিঙ্গ পরস্পরের কাছে আসতে চাইছে। আর মার ব্রত সার্থক করে দিচ্ছে এক মুসলমানীর ছোঁয়ায় পবিত্র দুধ। নববর্ষ  এর থেকে ভালভাবে  শুরু হতে পারে?
তবে যত খাওয়া , তার মধ্যে সেরা সেই আনা বেলেঘাটা হাসিরানি সরকারের সেজকাকীর হাতের গোলারুটি। ওদের মাটির দাওয়ায় বসে বসে সন্ধে হল প্রায়। আধো অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে ওঠে সেজবউয়ের উনুন। চাটুতে তেল মাখিয়ে আটাগোলা ছাড়ছে সেজবউ। ছ্যাঁকছোঁক শব্দ হচ্ছে। খানিকক্ষণ পরে  তুলে রাখা  দুটো কলাইয়ের থালায় নিয়ে আসছে সেই গরম গরম গোলারুটি, পাশে একটু গুড় হয়তো। থালাদুটো সসঙ্কোচে নামিয়ে বলছে ‘গরিব কাকী আর কী দেবে? তোমার মা কত মিষ্টি পায়েস খাওয়ায়, নিজের মুখের ভাত অব্দি ধরে দেয় অসময়ে গেলে’ আকাশে একটি দুটি তারা ফুটছে। উঠোন ঘিরে দাঁড়ানো ঘরগুলিতে হারিকেন জ্বলবে এবার, তার তোড়জোড় চলছে। সারাদিনের তাতা মাটি এবার ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। পঞ্চানন ঠাকুরের থান থেকে কী যেন একটা হাওয়া বাঁশবনের দিকে চলে গেল। তার মধ্যে বসে আমি আর মা সেজবউয়ের কথায় কর্ণপাত না করে পরম আনন্দে খেতে থাকি সেই গরম গরম গোলারুটি। আহা সারা পৃথিবীর খিদে মিটুক।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।