• Uncategorized
  • 0

‎ছোট গল্পে যুগান্তর মিত্র

উৎসব শেষের আলো

পুটুস, অ্যাই পুটুস !
কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সুফল। ঘাড় ঘুড়িয়ে, হাসি ছড়িয়ে পুটুস তাকিয়ে দেখল সুফলকে। হাওয়ায় উড়ছে পুটুসের  শ্যাম্পু-করা চুল। সেই চুল সুফলের মুখে এসে লাগে। পুটুসও ফিসফিস করে বলল, কী বলছ ?
প্যান্ডেলের পিছনে একবার আসবি ? একটা কথা বলার ছিল।
ভ্রু কুঁচকে যায় পুটুসের। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ তাদের খেয়াল করল কিনা। মনে হয় কেউ সেভাবে দেখেনি। অষ্টমী পুজোর অঞ্জলি দেওয়া চলছে। মাইকে পুরোহিত মশাই মন্ত্র বলছেন। সবাই সেই মন্ত্র উচ্চারণ করে ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে দুর্গার পায়ে। সবার চোখই দুর্গা প্রতিমা বা পুরোহিতের দিকে। তাছাড়া পুটুস বসেছে প্যান্ডেলের একদম শেষের দিকের চেয়ারে। ওর আশেপাশেও কেউ নেই। সবাই আগের দিকে বসেছে।
পুটুস আজ অঞ্জলি দিতে পারবে না। সকালে ভুল করে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খেয়ে ফেলেছে। ওর মা বলেছিল, “কিছু হবে না। অঞ্জলি দিতে পারিস। সবই তো মনের ব্যাপার।” পুটুসও পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, “হ্যাঁ, মনের ব্যাপার বলেই তো অঞ্জলিটা দিতে চাইছি না। মনটা খুঁতখুঁত করছে। নির্জলা ভাবে অঞ্জলি দিই। এবার চাও খেয়ে নিলাম। তার সঙ্গে বিস্কুটও। কিছুতেই মনে পড়ল না কেন কে জানে !” যদিও পুটুস জানে তার মনের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা নয়। আজকের দিনে পাতিপুকুরে থাকলে বেশ হইহই করে কাটত। ভোর থেকেই নানা আয়োজনে মেতে থাকতে হত। ওদের বাড়ির একবারে লাগোয়া প্যান্ডেলে পুজো হয়। যেন নিজেদেরই পুজো।
বিয়ের পরে প্রথম বছরই শুধু পুজোতে বাপের বাড়িতে এসেছে পুটুস। তার পরের বার নির্মাল্য আসতে দেয়নি। ভাগ্যিস আসতে দেয়নি। তাই তো সে এই পুজোটায় জড়িয়ে পড়তে পেরেছিল। এবার একজন অল্পবয়সী সদস্য দুর্ঘটনায় মারা গেছে কিছুদিন আগে। সেই কারণেই এবারের পুজোটা বাতিল হয়ে গেল। নির্মাল্য তাই ওকে বাপের বাড়িতে আসতে বলেছে। একরকম জোর করেই পাঠিয়েছে। পুটুসও ঝাড়া হাত-পা। সন্তান হয়নি এখনও। তাই হুট করে চলে আসতে পারল। নির্মাল্য শ্বশুরবাড়ি আসবে একাদশীর দিন সকালে।
সুফলের ডাকে চুপ করে উঠে যায় পুটুস। তার আগেই সুফল চলে গেছে সেখান থেকে। ওকে অনুসরণ করে সেদিকেই যায় পুটুস। প্যান্ডেলের পিছনের দিকে দত্তদের বাড়ির পিছনদিকটা পড়ে। এদিকে এ বাড়ির কোনও দরজা-জানালাও নেই। তাই এইখানটাকেই বেছে নিয়েছিল সুফল। পুটুসও নিরাপদ বুঝে সেদিকে পা বাড়ায়।
কী বলবে গো ? এবার কি নিজের জন্য বলতে এসেছ ? এখন আর বলে লাভ নেই। বিয়ে হয়ে গেছে। হা হা হাসে পুটুস।
ধ্যাৎ, বাজে কথা বলবি না কিন্তু। সুফলের মুখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।
বাজে কথা ? তুমি কী ক্যাবলা ছিলে গো সুফলদা। দীপকদার জন্য তুমি বলতে এলে ? সে নিজের কথা নিজে বলতে পারল না ? এইরকম ল্যাদামার্কা ছেলেদের আমার একদম পছন্দ হয় না।
সুফলের মনে পড়ে গেল সেই ঘটনা। দীপকদা তখন সদ্য রেলে চাকরি পেয়েছে। পুটুসকে খুব পছন্দ। অথচ নিজে বলতে পারবে না। তাই সুফলকে এসে ধরেছিল। সুফলও কৃতিত্বের কাজ ভেবে পুটুসকে বলেই বসল, পবিত্রদের বাড়ির পিছনের মাঠে বিকেল চারটে নাগাদ আসতে পারবি ? একটু কথা ছিল। একাই আসিস কিন্তু।
সেদিন কীসের জন্য যেন স্কুল ছুটি ছিল। বঙ্কিম স্যার তাই সকাল সাতটার বদলে আটটা থেকে পড়াবেন। পুটুস তখন পড়ে ফিরছিল। পড়ার টাইম যে বদল হয়েছে সে খবরও দিয়েছে দীপকদা।
এখন বলা যায় না ? কাঁধে থাকা পড়ার ব্যাগটা একবার সামনে টেনে এনে বলল পুটুস।
না, এখন নয়। বিকেলে আসিস। একটু সময় লাগবে। খুব গোপন কথা।
ব্যাগটা আবার পিঠে নিয়ে চলে যেতে যেতে পুটুস হাসিমুখে বলেছিল, আচ্ছা যাব। বিকেলে যখন অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে দীপকদার কথা বলল সুফল, তখন ভীষণ রেগে গেল পুটুস।
তোমার কি মাথা খারাপ ? ঐ কাকুমার্কা লোকটাকে আমার একদম ভালো লাগে না। আর কোনওদিন ওর কথা বলতে এসো না বলে দিলাম। কথাটা বলেই ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় পুটুস। হতভম্বের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে সুফল। হঠাৎই সে হাওয়ায় কথা ভাসিয়ে দেয়, দীপকদা ভালো চাকরি করে। রেলের চাকরি।
পুটুসের কোনও হেলদোল নেই যেন। নাকি কথাটা শুনতেই পায়নি ! অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ভাবে সুফল। কিছুটা এগিয়েও ফিরে আসে পুটুস। গনগনে আগুনের শিখা তখন তার চোখে।
রেলের চাকরি ধুয়ে জল খাব ? তুমি যদি নিজের হয়ে বলতে, তাও না-হয় একটা কথা ছিল। ভেবে দেখতাম।
নিজের হয়ে মানে ?
নিজের জন্য হাঁদারাম।
এবার কী বলবে সুফল ? কীই-বা বলার আছে তার ? বিস্ময়চিহ্ন চোখেমুখে ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া !
যাক, যা হয়েছে হয়েছে। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। এখন এসব নিয়ে আমার মাথা খারাপ কোরো না বলে দিলাম।
আর দাঁড়ায়নি সেদিন। ফিরেও আসেনি আর। এরপর অনেকদিনই সুফল ভেবেছে একবার নিজের জন্য সত্যিই বলা যায় না পুটুসকে ? ও কি ফিরিয়ে দেবে ? কিন্তু পারেনি। কিছুতেই বলতে পারেনি। দেখতে দেখতে সময়ও কেটে গেছে বিস্তর। এর বছর কয়েকের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেছে পুটুসের, মিউনিসিপালিটির কর্মী নির্মাল্যর সঙ্গে।
সেদিনের কথাই মনে করিয়ে খোঁচা দিল পুটুস। সে সত্যিই ক্যাবলা ছিল। হয়তো আজও সে ক্যাবলাই আছে।
হ্যাঁ, কী বলবে বলে এখানে ডেকেছ বলো। মাঝখানে নীরবতার মধ্যে হু-হু হাওয়া বয়ে গেছে। দুজনেই হয়তো নিজের মতো করে ভেবে গেছে সেইসব দিন। পুটুসের কথায় সম্বিত ফিরে পায় সুফল।
তোর বর মিউনিসিপালিটিতে চাকরি করে না ?
এটা জানার জন্য নিশ্চয়ই ডাকোনি ?
না না। আসলে আমি তো একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি। মাইনে খুবই কম। তাই সাইডে বই-খাতা-কলম এইসব সাপ্লাইয়ের কাজও করতে হয়। অফিস থেকে নানা কাজে এদিক-সেদিক পাঠায়। সেই সুযোগে আমি অর্ডার ধরে নিই। আমার এক সাগরেদ আছে, সে মাল ডেলিভারি করে। ওই মিউনিসিপালিটিতে কিছু জিনিসপত্র সাপ্লাই করছি মাস কয়েক হল। বিলটা পাশ করে তোর বর। কিন্তু অনেকদিন হয়ে গেল। অনেক টাকার ব্যাপার। বুঝিসই তো। পুঁজি কম !
ঘুষ দাও ? চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল পুটুস।
না, মানে ঘুষ…
পয়সা ছাড়া ও এক ইঞ্চিও কাজ করে না আমি জানি। ঘুষ খেয়ে খেয়ে পেট মোটা করে ফেলেছে।
সে তো কমিশন দিতেই হয়।
কমিশন বলছ কেন ? ঘুষ, সোজা ভাষায় ঘুষ।
তুইও ঘুষ বলবি ?
হ্যাঁ বলব, আমি একদম এসব পছন্দ করি না। ও জানে। এই নিয়ে আগে ব্যাপক লাফড়া হত। এখন আর কিছু বলি না।
পুটুস বরাবরই স্মার্ট ছিল। কথাবার্তায় তুখোড় আর আচরণে ছটফটে। এখন কি আরও বেশি করে স্মার্ট হয়ে উঠেছে ? ভাবে সুফল। সেইসময় পুটুসকে হাসতে দেখে বিপন্ন বোধ করে সে।
হাসছিস কেন ?
তুমি না সুফলদা, এখনও ক্যাবলাই রয়ে গেলে। ও একদম ঘুষ খায় না। পছন্দও করে না। আমি তোমার সঙ্গে মজা করলাম।
সুফল অবাক হয়ে দেখে পুটুসকে। সবকিছু নিয়েই মেয়েটা মজা করতে পারে। বাপ রে ! চুপ করে থাকা সুফলের দিকে তাকিয়ে পুটুস জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি ওকে বলেছ আমাকে চেনো ?
না না। বলা হয়নি।
আচ্ছা ঠিক আছে। বললে ভালোই করতে। তবে এখন আর তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমিই বলে দেবো। টাকাটা ঠিক পেয়ে যাবে। হয়তো অন্য কোনও ব্যাপার আছে। ও কিন্তু এইরকম নয় গো।
সুফলের চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তখনই পুটুস কথা বলে উঠল। অন্য কথা বলো সুফলদা। কতদিন বাদে কথা হচ্ছে। তুমি তো আমাকে দেখলেই সরে যাও। আজ নেহাত বিপদে পড়েছ, তাই কথা বলতে এসেছ যেচে।
কথাটা ঠিকই। পুটুসকে চোখে পড়লেই কেমন যেন গুটিয়ে যায় সুফল। কিছুতেই মুখোমুখি হতে পারে না। তাই এই অভিযোগে কিছু জবাব দেওয়ার নেই তার, জবাব খুঁজেও পায় না সুফল। পুটুস সেইসময় বলে, আর কবে বিয়ে করবে সুফলদা ? এবার বিয়ে করো। জমিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাই।
সুফল যে বিয়ে করতে চায় না তা নয়। কিন্তু এই বেতনে ঠিক সাহস করে উঠতে পারে না। অবশ্য এই নিয়ে ওর বাড়িতেও কোনও হেলদোল নেই।
এমনিই করা হয়ে ওঠেনি রে। এবার প্রসঙ্গ ঘোরাতে সুফল বলে ফেলে, তোর শাড়িটা খুব সুন্দর !
আর আমি ?
তুইও…
ইতিমধ্যেই মাইকে ঘোষণা হয়, আমাদের অঞ্জলি এইমাত্র শেষ হল। আর যদি কোনও মা-বোনেরা বাকি থাকেন এখনও আসতে পারেন। কিছু সময় পরে আবার আমাদের অঞ্জলি দেওয়া শুরু হবে।
এই খেয়েছে ! শেষ হয়ে গেল ! এবার সবাই বেরিয়ে পড়বে। এক কাজ করো, তুমি এখানেই সিগারেট ফোঁকো। আমি আগে কেটে পড়ি। তুমি একটু পরে এসো। দুজনকে একসঙ্গে এখান থেকে বেরোতে দেখলে কেলো হয়ে যাবে।
কয়েক বছর আগের কথাগুলো সুফলের মনের মধ্যে বুদবুদ্ তুলছে। পুটুসকে মাঝে মাঝেই দেখে আজকাল। হয়তো বাড়ির সামনে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। কোনওদিন পুটুসের কাছে যেতে ইচ্ছে থাকলেও পেরে ওঠেনি। ওর সামনে গিয়ে কী বলবে সুফল ? এসব ব্যাপারে কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পায় না সে।
()
পুটুসদের পাশের বাড়ির বাচ্চু এসে সুফলকে জানাল পুটুস তাকে আজ সন্ধ্যায় ওদের বাড়িতে যেতে বলেছে। খুব দরকার আছে বলেছে সুফলদা। অবশ্যই যেও কিন্তু। বলেছে বাচ্চু। কথাটা শুনেই সুফলের মনটা খুশিতে নেচে উঠল। যদিও বাচ্চুর সামনে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তাহলে কি পুটুস রাজি হয়ে গেল ? মা দুর্গার কাছে অনেকবার করে বলেছে সুফল, মা, পুটুসকে রাজি করিয়ে দাও। মা তাহলে তার কথা রেখেছেন। ভাবে সুফল। পুজোর প্যান্ডেলে ঢাক বাজছে। মাইকে তার শব্দ ভেসে আসছে। সুফলের মনের ভেতরেও ঢাক বেজে চলেছে একটানা। এক পুজোর সময় মিউনিসিপালিটি থেকে পাওনা টাকার জন্য পুটুসকে বলেছিল সুফল। পুটুস বলাতে তাড়াতাড়ি টাকাটা পেয়ে গেছে সে। এরপর থেকে আর কোনও অসুবিধা হয় না সুফলের। সেই ঘটনার মাঝে কয়েকটা পুজো বেরিয়ে গেছে। পুটুস আর কোনওবার পুজোতে এখানে কাটায়নি। এর মধ্যেই ঘটনাপ্রবাহে পুটুস এখন বাপেরবাড়িতেই পাকাপাকি থাকে।
এবার মহালয়ার সকালে পুটুসের মাকে কথাটা বলেছিল সুফল। তিনি তখন সামনের বাগানের ফুলগাছে জল দিচ্ছিলেন। অনেকদিন ধরেই বলব বলব করে বলে উঠতে পারছিল না সে। তারপর সেদিন কপাল ঠুকে বলেই ফেলল সুফল। পুটুস তো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। ওর মাও রাজি হবে না ধরেই নিয়েছিল সুফল।
এসব কী বলছ সুফল, ও এসব মানতেই পারবে না। আমার মেয়েকে তো চিনি আমি।
কেন মানবে না মাসিমা ? ওর তো সারাজীবনটাই পড়ে আছে। কীভাবে থাকবে বলতে পারেন এভাবে ? ওকে আপনি বোঝান। ঠিক বুঝবে।
কী জানি বাবা, জামাইটা চলে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে সারা দিনরাত। কত বলেছি সিনেমায় যা। আগে তো নাটক দেখতে যেতি। এখন যেতে পারিস না ? তা শুনলে তো মেয়েটা। কী ছটফটে ছিল ! এই একটা ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেল।
তবু আপনি বোঝান মাসিমা। আমি ওকে ভালো রাখতে পারব। বিশ্বাস করুন।
আর তোমার মা-বাবা যদি আপত্তি জানান ? তখন কী হবে ? এসব তো সবাই মানতে পারে না বাবা !
কেউ আপত্তি জানাবে না মাসিমা। আমি মাকে বলেছি। মা বাবাকে রাজি করিয়েছে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তবু যদি কোনও সমস্যা হয় তখন কী হবে আমার মেয়েটার, একবার ভেবেছ ?
তেমন পরিস্থিতি হবে না মাসিমা। হলেও বিয়ে আটকাবে না। আমি আলাদা জায়গায় বাড়িভাড়া করে থাকব। আমাদের দুজনের ঠিক চলে যাবে। ভালোবাসাটাই আসল মাসিমা। ভালোবাসা থাকলে সব মানিয়ে নেওয়া যায়।
এসব সুফলের কল্পনা। সে ভেবেছে পুটুসের মাকে বললে উনি এইরকমই বলবেন আর তার জবাব দেবে এইভাবে। যদিও সত্যি সত্যি এইরকম কথা বলে দিলে সুফল আদৌ এসব বলতে পারত কিনা তা নিয়ে নিজেরই সংশয় আছে। বরাবরই সে সাজিয়েগুছিয়ে কথা বলতে পারে না। ভুলভাল হয়ে যায় সব। ঠিক সময়ে কেমন যেন গুলিয়ে যায়।
কিন্তু পুটুসের মাকে যখন বলল সে, পুটুসকে আমি বিয়ে করতে চাই মাসিমা, তিনি এসবের কিছুই বললেন না। সুফলের সব অনুমান মিথ্যে হয়ে গেল। বললেন, হ্যাঁ বাবা। ও আমাকে অনেকদিন আগেই বলেছে একথা। তুমি যেদিন ওকে প্রস্তাব দিয়েছ সেদিনই বলেছে। কিন্তু বলল, এসব কি সম্ভব মা ? আমি রাজি হতে পারব না।
ও বলেছে একথা ? আপনি ওকে রাজি করান মাসিমা। কথা দিচ্ছি আমি ওকে সুখে রাখব।
আমি বুঝিয়ে বলব। তার আগে তুমি আর-একবার বলো। ও ওপরের ঘরেই আছে। সারাদিনই প্রায় ওখানে থাকে।
আচ্ছা, আমি তাহলে যাচ্ছি মাসিমা। আপনিও বুঝিয়ে বলবেন।
সেদিন দোতলার সিঁড়ি দিয়ে যেন পা ফেলে ফেলে নয়, উড়ে উড়ে গেল সুফল। সেখানে গিয়ে দেখল পুটুস বিছানায় শরীর বিছিয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ।
পুটুস। ঘুমাচ্ছ ? ওকে সুফল তুই করেই বলে এসেছে বরাবর। সেদিন তুমি করে বলতে ইচ্ছে করল তার।
পুটুস চোখ খুলল। তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, না সুফলদা। ঘুমাইনি এখনও।
আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম পুটুস। সেদিনের সেই কথাটা। তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ।
পুটুস উঠে বসল না। পাশ ফিরে শুল। সুফলের দিকে পিছন ফিরে। পাশবালিশটা চেপে ধরে বলল, এসব নিয়ে কিছু ভাবছি না সুফলদা। আমার এসব ভাবতেও ভালো লাগছে না। তুমি এখন যাও। আমি ঘুমাব। খুব ঘুম পাচ্ছে।
চলে যেতে বলছ পুটুস ? আমাকে চলে যেতে বলছ ? আমি যে আশা করে এসেছিলাম।
যাও সুফলদা। আমার এখন এসব ভালো লাগছে না। রাতে ঘুমাতে পারি না। কিছুতেই ঘুম আসে না। এইসময় বড্ড ঘুম পায়।
না, আমি যাব না পুটুস। আজ আমি তোমার থেকে রাজি হওয়ার ইশারা নিয়েই ফিরব।
আহ্‍ সুফলদা। আমাকে এই নিয়ে আর বিরক্ত কোরো না। আমি এখন ঘুমাতে চাই। প্লিজ যাও এখন। এই নিয়ে আর কোনওদিন বোলো না।
সুফল হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিল। আসার সময় বলেছিল, আরও ভাবো পুটুস। আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। তুমি রাজি হয়ে যাও। প্লিজ, তুমি রাজি হয়ে যাও। আমাকে ফিরিয়ে দিও না পুটুস। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। এসব বলেই চুপচাপ চলে এসেছিল সে। আসার সময় পুটুসের মাকেও কিছু বলেনি। বলার দরকার পড়েনি। পুটুসের থেকেই জেনে যাবেন।
তাহলে এতদিন পরে পুটুস রাজি হল ? সুফলের চিৎকার দিয়ে গান করতে ইচ্ছে করছে। এবারের অষ্টমী পুজোর দিন পুটুসকে অনেক করে বলেছিল সুফল, চল পুটুস, ঠাকুর দেখে আসি। রেল লাইনের ওপাশে দারুণ দারুণ পুজো হয়। তুই তো জানিস।
পুটুস কিছুতেই রাজি হল না। নাহ্‍। আমার ইচ্ছে করে না সুফলদা। আমি যেতে পারব না। তুমি যাও। দেখে এসো।
মনমরা সুফল বাড়ি থেকেই বের হয়নি সেদিন। তবে পুটুসের চোখের আড়ালও হতে চায়নি। যখনই সুযোগ পেয়েছে, পুটুসের দৃষ্টিসীমায় চলে এসেছে সে। আশা করে আছে, কবে পুটুস তার ইচ্ছেতে হ্যাঁ করে দেয়।
সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অধৈর্যের করাত চলছিল সুফলের মনের মধ্যে। এমনিতে সারা বছর খুব বেশি ছুটি পায় না সুফল। কিন্তু পুজোর দশদিন তাদের টানা ছুটি থাকে। এইসময় সে দুপুরে বিছানায় গড়িয়ে নেয় একটু। আজ আর তার ঘুম এল না। উত্তেজনায় ঘুম উধাও হয়ে গেছে। পুটুস নিশ্চয়ই এখন ঘুমাচ্ছে। ভাবে সুফল, আর ঘড়ির কাঁটার বয়ে চলা দেখে। অবশেষে দিন যখন ঢলে পড়ল, তখন গেরুয়া পাঞ্জাবিটা পরে বের হল সে। পুটুস গেরুয়া পাঞ্জাবি পছন্দ করে। বলেছিল একদিন। এটাতে নাকি তাকে খুব মানায়।
পুটুস রাজি হওয়ার কথা শোনায়নি। সে রাজি নয়। সুফল বুঝে গেল পুটুস আর কোনওদিনই রাজি হবে না। সেকথা স্পষ্ট করে বলেও দিয়েছে সে। এখনও তার বর নির্মাল্য তাকে ঘিরে রেখেছে। পুটুস ডেকেছিল নির্মাল্যর মায়ের কাছে টাকা পাঠানোর জন্য। ওর শাশুড়ি অসুস্থ।
তুমি কিছু টাকা দিয়ে আসতে পারবে সুফলদা ? শাশুড়ি খুব অসুস্থ। বিছানায় শয্যাশায়ী।
তুই যাচ্ছিস না কেন ? তোরও তো এইসময় যাওয়া উচিত পুটুস।
আমি যেতে পারব না গো। নির্মাল্যর অফিসের টাকাপয়সা পাওয়ার পর ওখানে গেছিলাম। বেশকিছু টাকা দিয়ে এসেছি। ওনার ছেলে। ওনারও প্রাপ্য আছে।
ওখানেই থেকে গেলি না কেন পুটুস। সুফল কথাটা ভাসিয়ে দিল হাওয়ায়। পুটুসের আচরণে ক্ষুব্ধ সে। এতই যখন নির্মাল্য নির্মাল্য করিস, তখন তার বাড়িতেই থাক। মনে মনে উচ্চারণ করে সুফল। পুটুস তার কথার জবাব না-দিয়ে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। সুফল তখন তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে। অনেকক্ষণ পরে জবাব এল, থাকব ভেবেছিলাম সুফলদা। ওর চলে যাওয়ার পরে তো ওখানেই ছিলাম। কিন্তু আর পারছিলাম না। সারা ঘরে যেন নির্মাল্য হেঁটেচলে বেড়ায়। বিশেষ করে সন্ধের পরে, ওর অফিস থেকে ফেরার সময় থেকে আরও অসহ্য লাগত। সকালেও একইরকম লাগত। তাই চলে এসেছি। আর যাব না ওখানে। বলেই এসেছি। আমার শাশুড়ি ছোট ছেলে আর বউমাকে নিয়েই থাকুন। বড় ছেলে নেই। বউমাও না-হয় নেই ভেবে নেবেন।
রাগটা চড়চড় করে বাড়ছিল সুফলের। সেই সঙ্গে হতাশাও। আর ওখানে থাকতে ইচ্ছে করছিল না তার। তাই কেটে কেটে উচ্চারণ করল, বেশ, টাকাটা পাঠিয়ে দিস বাচ্চুকে দিয়ে। আর ঠিকানাও। আমি সময় করে দিয়ে আসব। এবার আমি উঠব। কাজ আছে।
না না। পাঠানোর ব্যাপার নেই। এখনই নিয়ে নাও। আমি গুছিয়েই রেখেছি।
নির্লিপ্ত পুটুস। এত নির্লিপ্ত থাকতে পারে মানুষ ! একজন বুকের মধ্যে আছড়ে-পড়া ঝড় সামলাতে পারছে না, আর যার জন্য ঝড়, সে এত নির্লিপ্ত ! ভাবে সুফল। পুটুস উঠে আলমারি থেকে একটা সাদা খাম এগিয়ে দিল তার দিকে। আর ঠিকানা লেখা একটা চিরকুট। ভালো করে বুঝিয়েও দিল কীভাবে যেতে হবে। সুফল সেসব পকেটে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল পুটুসদের বাড়ি থেকে।
এখন আমি কী করব ? পুরো পৃথিবীটাই আলোবাতাসহীন মনে হচ্ছে আমার। পুজো শেষ হয়ে গেছে। গতকাল রাতে পাড়ার প্যান্ডেলের ঠাকুরও বিসর্জন হয়ে গেছে। না-হলে প্যান্ডেলে বসেও সময় কাটাতে পারতাম। ভাবতে ভাবতে প্যান্ডেলের দিকেই পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সুফল। কেউ নেই সেখানে। থাকার কথাও নয়। ভাসানের পর মণ্ডপ তো এমনই থাকে। যতক্ষণ প্রতিমা থাকে, আলোর জৌলুস থাকে, ততক্ষণই তো তাকে ঘিরে রাখে লোকজন। শুধু পুটুস বুঝল না। বিসর্জনের পরেও নির্মাল্যকে আঁকড়ে পড়ে আছে। এইসব কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় সুফলের। তারও যেন ভাসান হয়ে গেল এইমাত্র। অনেক আশায় বুক বেঁধেছিল সে। পুটুস ঠিক রাজি হবে। আশা তো এমনি এমনি করেনি। একদিন পুটুসই বলেছিল নিজের জন্য বললে ও ভাববে। পরিস্থিতি যাই হোক, আমি তো নিজের কথাই বলেছি। আমার ভালোবাসা বুঝল না পুটুস ! হতাশায় ভেঙে পড়ে সে।
মণ্ডপে একলা একটা প্রদীপ জ্বলছে। ম্রিয়মাণ আলো। আর তার চারিদিকে আন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেন অপেক্ষা করছে, আলো নিভে গেলেই কালো ঘোমটার আড়ালে প্রদীপটাকে ঢেকে দেবে অন্ধকার। টিমটিমে আলো নিয়ে প্রদীপটা এমনভাবে জ্বলছে, যেন কারও প্রত্যাশা বুকে জমা নেই তার। কেউ এসে আলো উসকে দেবে, এমন আশাও সে করে না।
প্রদীপের সলতে উসকে দিয়ে তার পাশেই বসে রইল সুফল। খানিকটা আলো থাকুক। আরও কিছুক্ষণ বুকে আগুন ধরে রাখুক ম্রিয়মাণ প্রদীপ। হাওয়ায় ভাসছে রাতের শিশির। একটু একটু ঠাণ্ডা অনুভব করছে সুফল। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে তার।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।