• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৭)

ঢেপ্সির প্রেমকাহিনী

সপ্তম ভাগ

আমরা রাতের খাবার খেতে বসলাম। সবাই নীরবে খেয়ে গেল, মুখে আওয়াজ নেই। আমি খেয়েদেয়ে ঘরে চলে গেলাম। দরজা বন্ধ করে পড়ছি, হঠাৎ দরজায় জোর জোর ধাক্কা। দরজা খুলে দেখি মা দাঁড়িয়ে। গলা খেঁকিয়ে তেড়ে এলো, “কী এমন ঢঙের পড়া করিস দরজা বন্ধ করে পড়তে হয়!?” পড়ে নে, পড়ে নে। থার্ড ইয়ার হোক। ঘাড় ধরে বিদেয় করবো। যাকে পাবো তার সঙ্গেই পাপ বিদেয় করে দেবো। আমার মাথা গেল গরম হয়ে। আর সহ্য হলো না। ঘুড়িয়ে বললাম “আমি পাপ! আমি ঢেপ্সিকে শিখিয়েছিলাম? আমি কী দোষ করেছি? তোমার দিদির মেয়ে মা করে বেড়ায় তার কাছে এটা কিছুই নয়। আর হ্যাঁ, বিয়ে দেওয়ার আরেকবার চেষ্টা করো আমি থানা পুলিশ কিছু বাকি রাখবো না।” মা ঝুলঝাড়ু নিয়ে তেড়ে মারতে উদ্যত হলে বাবা- দাদু দুজনেই এসে মাকে আটকালো। বাবা ভীষণ ঠাণ্ডা গলায় মাকে বললো “ঘরে যাও। অনেক রাত হয়েছে। রাতের বেলায় এসব কেলেঙ্কারি করো না। প্রতিবেশীরা আড়ালে ফিসফিস করবে।” মা কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলো না তার আগে দাদু থামিয়ে দিল ” বৌমা, আমার নাতনি এমন কিছু করেনি যে বিয়ে দিয়ে পাপ বিদেয় করতে হবে তোমায়। তুমি যদি ওর পড়াশোনার খরচ না জোগাতে পারো তবে আমিই ওকে পড়াবো। তোমাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে না ‌দুটো কথা, ও পড়াশোনা করবে এবং ওর এখন বিয়ে হবে না।” বাবা মাকে টেনে নিয়ে ঘরে চলে গেল।
আমি ঘরে এসে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না। লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম‌ও আসছে না। ইউটিউব অন করে কানে হেডফোন লাগিয়ে শুলাম। হোয়াটসঅ্যাপে রিমার মেসেজ ঢুকলো। কাল অবশ্যই কলেজে আসিস। ভীষন জরুরী কথা আছে। আমি “বেশ ঠিক আছে” রিপ্লাই দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে টিউশন গেলাম। বাড়ি ফিরে রেডি হচ্ছি কলেজ যাবো এমন সময় মামার বাড়ির দাদু এলো। আমি চিন্তা করছি দাদু তো এভাবে সারপ্রাইজ ভিসিট করে না, আগে থেকে খবর দেয়। তবে আজ কীভাবে হঠাৎ করে!? এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতে বাড়ি থেকে বেরোলাম।
পৌরসভার কাছে জ্যামে আটকে গেছি সাইকেল নিয়ে। বিরক্ত লাগছে, পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো ” ভালো আছেন ম্যাডাম?” ঘুরে তাকিয়ে দেখি অজয়। আমার তো অজয়কে দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল।” হুম ভালো” বলে চুপ করে গেলাম। আল্টিমেটলি কলেজ পৌঁছালাম। রিমাকে ফোন করছি কিন্তু সে ফোন রিসিভ করে না। আমার মেজাজ অলরেডি গরম হয়ে ছিল আরও গরম হয়ে গেল। ক্যান্টিন থেকে একবোতল ঠান্ডা জল কিনলাম। একঘন্টা হয়ে গেল। তবুও রিমা আসছে না। আমি ছটফট করছি। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, নরমাল টেক্সট সবেতেই নক করলাম। কিন্তু নো রিপ্লাই। আমার ভীষন বিরক্ত লাগছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে রাজদীপ ফোন করে বলছে “আইনক্সে সিনেমা দেখতে যাবি?” আমি সমস্ত রাগটা রাজদীপের ওপর উগড়ে দিয়ে একপ্রকার চিৎকার করেই বললাম ” ফোন রাখ। মাথা খাবি না।” ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছি ভুলবশত একজনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল। তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে আমার ছ্যাঁকা লেগে গেল। ফোনটাও হাত থেকে পড়ে গেছে। দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। দুজনেই সরি সরি বলছি। মুখে সরি বললেও মনে মনে গুষ্ঠি উদ্ধার করছি। সারা শরীর ঘামে ভেজা ছিল। ছ্যাঁকা লাগা জায়গাটা চিরচির করে জ্বালাপোড়া করছে। আমার অবস্থা দেখে আশেপাশে থেকে আরোও তিন চারটে ছেলে ছুটে এলো। তাদের মধ্যে একজন বরফ নিয়ে এলো। আমার হাতে ঘষে দিতে লাগলো। আস্তে আস্তে জ্বালাপোড়া কমে গেল। সবাই চলে গেল শুধুমাত্র ওই ছেলেটি ছাড়া, যার সিগারেটে আমার ছ্যাঁকা লেগেছিল।
ছেলেটি মুখ কাঁচুমাচু করে বললো আমি আন্তরিক দুঃখিত তোমার কাছে। তুমি যদি চাও আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি। আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম, এ আবার কী?? বিরক্ত হয়ে বললাম মানে কীসের প্রায়শ্চিত্ত? সে হাসতে হাসতে বললো “এই যে তোমাকে ছ্যাঁকা দিলাম। এটা তো একপ্রকার পাপ।” আমি তার কথা বলার ধরন দেখে হেসে ফেললাম। ছেলেটি বললো চলুন ম্যাডাম ক্যান্টিনে ঠান্ডা পানীয় পান করতে করতে গল্প করা যাক। ক্যান্টিনে দুজনে বসলাম। একথা সেকথায় জানলাম তার নাম অনিরুদ্ধ অধিকারী। এই কলেজের এক্স স্টুডেন্ট। আমি গল্প করলেও ছটফট করছি। বারবার ফোন দেখছি। রিমার দেখা নেই। অনিরুদ্ধ সেটা লক্ষ্য করেছে তাই বললো ” কারোর আসার কথা আছে?” আমি বললাম “হুম। আমার এক বান্ধবী। কিন্তু সে তো আসতেই না। ফোন‌ও ধরছে না।” অনিরুদ্ধ বললো “আরেকটু অপেক্ষা করো। দেখো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।” ছেলেটা বেশ প্রাঞ্জল। হড়বড় করে কথা বলে গেল। তবে ছেলেটা ভীষণ মেধাবী। কথাবার্তায় সেটা স্পষ্ট। আমার মেজাজটা বেশ শান্ত হয়ে গেছে এখন। আমিও গল্পে মশগুল। এমন সময় রিমা ফোন করে বললো “সরি সরি। আমি সাইকেল স্ট্যান্ডে আছি। দুমিনিটের মধ্যে আসছি।” দৌড়াতে দৌড়াতে রিমা আমাদের কাছে এলো। রিমা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বকবক করেই চলেছে। চোখ তুলে তাকিয়েই দেখে আমি আর অনিরুদ্ধ হাসছি। রিমা অনিরুদ্ধকে চেনে না। অপ্রস্তুতে পড়ে গেছে, লজ্জা পেয়েছে। অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললো “রিমাদেবী এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনার বান্ধবীকে ছ্যাঁকা দিয়েছি। আরে না না ভুল ভাববেন না প্রেমে ছ্যাঁকা নয়, সিগারেটে ছ্যাঁকা। আপনারা গল্প করুন আমি আসছি।” যাওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো ” ম্যাম নম্বরটা পাওয়া যাবে? ঝাড়ি মারবো না। মাঝে মাঝে ফোন করে জ্বালাতন করবো মাত্র।” আমি বললাম তোমার নম্বর দাও হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি। নম্বর দিয়ে অনিরুদ্ধ চলে গেল।
রিমা আগাগোড়া কিছুই জানে না। সে বুঝলো না ব্যাপারটা কি হয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম পরে শুনবি। আগে বল কী কেস? রিমা যা বললো তার অর্থ হলো ঢেপ্সি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে আমি ওর আর অজয়ের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। ওদের সম্পর্কে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছি। অজয় দেখতে সুন্দর। আমি অজয়ের প্রেমে পড়েছি। আমি এসব শুনে প্রচন্ড রেগে গেলাম। রিমাকে বললাম ” ওকে বলে দিস অমন মাতাল ছেলের সঙ্গে প্রেম করার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।” ঢেপ্সি যদি এবার বাড়াবাড়ি করে ওর বাড়ি গিয়ে অপমান করে আসবো। বাজে থার্ডক্লাস মেয়ে।” রিমা বলছে চুপ কর শান্ত হ। আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম ” আমি এই ঘটনার সঙ্গে বিন্দুমাত্র জড়িত না। তার পরেও আমার বাবাকে ওর বাবা অ্যাটাক করেছে। আমার বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে। আমার দোষ কোথায় বলতে পারিস!?” রিমা আমার চোখ মোছাতে মোছাতে বললো “দ্যাখ আমি সব জানি। কিন্তু কী করবো বল। কাঁদিস না। সাবধানে থাকিস। দরকারে আমি কাকিমার সঙ্গে ফোনে কথা বলবো‌।”
দুজনেই সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে সকালে কলেজ আসার সময় আমার সঙ্গে অজয় দেখা হয়েছিল এবং অজয় যা যা করেছে রিমাকে সব বললাম এবং অনিরুদ্ধর কথাগুলো সব খুলে বললাম। রিমা হাসতে হাসতে বললো “তুইও তাহলে কি এবার অনিরুদ্ধর প্রেমে পড়লি নাকি?” আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম কথাটা শুনে। হাসতে হাসতে বললাম “না রে, এইতো সবে মাত্র আজ দেখা হয়েছে। ঐ সমস্ত প্রেম-টেম কোন ব্যাপার না। যা কান্ড দেখছি তারপর আমার প্রেম করার কোন ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনটাই নেই। যদি অনিরুদ্ধ সে রকম কোনো ব্যবহার করে ব্লক অপশন তো আছেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে বাড়ি চলে যায় মা চিন্তা করবে। এমনিতেই তো আমার উপর রেগে আছে। লেট হলে আরো রেগে যাবে। তুই কিন্তু আজকে বড্ড দেরি করে দিলি একবার ফোনটা ধরতে পারতিস না? কি অসুবিধা হয়েছিল?” রিমা বললো “আর বলিস না। বাড়িতে হঠাৎ করে মামার বাড়ি থেকে সবাই চলে এসেছে। আমার দিদির জন্য পাত্র নির্বাচন করেছে, ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। সেই নিয়ে বাড়িতে কথাবার্তা হচ্ছিল দিয়ে আমার লেট হয়ে গেল। মা একা সংসারে কত কাজ করবে বল! আমি একটু সাহায্য করছিলাম। বুঝতে পারিনি এত দেরি হয়ে যাবে। ঠিক আছে আজকে বাড়ি চলে যা। তোকে রাত্রে ফোন করবো বা মেসেজ করবো।”
ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলাম দেখলাম মা দাদুর সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে। মনে মনে নিশ্চিন্ত হলাম যাক বাবা তাহলে মায়ের মন ভালো আছে। রাগটা একটু কমেছে, দাদুর কাছে গিয়ে বসলাম। দাদু একটু আদর করলো আমার জন্য ক্যাডবেরি এনেছিল সেসব দিলো। মা বলল হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আয়, খেতে দিচ্ছি। খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল ওহ হো অনিরুদ্ধ একটা মেসেজ করতে বলেছিল। ওকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা হাই পাঠালাম কিছুক্ষণের মধ্যে রিপ্লাই এলো “কি আপনি?” আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো ভাবলাম একটু মজা করি। রিপ্লাই দিলাম “আমি আমি বেনামী বন্দর”। ওদিক থেকে মেসেজ ভেসে এলো “এই বন্দরে নোঙ্গর করা যাবে?” বললাম “না এই বন্দরে সব জাহাজ নোঙ্গর করা হয় না। এই বন্দর শুধুমাত্র যে জাহাজকে চাই একমাত্র সেই জাহাজ‌ই নোঙ্গর করতে পারে।” তারপরে একটা হাহা ইমোজি পাঠালাম। অনিরুদ্ধ বুঝে গেছে ততক্ষণে। ওপার থেকে রিপ্লাই দিলো “আচ্ছা তুমি দীপা। বেশ বুঝলাম কি করছো?” আমি রিপ্লাই দিলাম “এইতো শুয়ে আছি” তারপর আবার মেসেজ করলাম “এখন একটু খানি ঘুমাবো। সন্ধ্যাবেলায় ফোনে কথা হবে, বাই।” আমি একটুখানি চোখ বন্ধ করে শুলাম। সন্ধ্যেবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অনিরুদ্ধ আমাকে আমার কিছু ছবি পাঠিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে। আমি অবাক হয়ে গেলাম আমার অজান্তে ক্যান্টিনে কখনো এই ছবিগুলো তুলেছে আমি জানিই না। কিন্তু ছবিগুলো খুব সুন্দর লাগছে। আমি বললাম “বাহ বেশ ছবি তুলেছে তো। তুমি বেশ ভালো ফটোগ্রাফি করতে পারবে। অনিরুদ্ধ বলল সে মাঝে মাঝে কিছু ছবি তুলি মাত্র। আহামরি কিছুই না। তোমার অজান্তেই পারমিশন ছাড়াই ছবিগুলো তুলেছিলাম। তার জন্য সরি আমি” হাসির ইমোজি পাঠিয়ে বললাম “ভাগ্যিস তুমি পারমিশন না নিয়ে তুলেছিলে। তাইতো এতো ন্যাচারাল এসেছে না হলে হয়তো আর্টিফিশিয়াল ব্যাপার থাকতো।” অনিরুদ্ধ রিপ্লাই দিলো “তাহলে এগুলো ফেসবুক ডিপি করো।” আমি বললাম “আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই।” অনিরুদ্ধ বললো “খুলে ফেলো, ফেসবুক জগতে একদম অন্যরকম। দেখবে সেখানে মজা আছে, আনন্দ আছে, দুঃখ আছে, শিক্ষা আছে। চটপট একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে ফেলে অনিরুদ্ধ অধিকারীকে একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দাও।” আমি মনে মনে ভাবলাম একটা ফেসবুক একাউন্ট খুললে মন্দ হয় না। ফেসবুক থেকে ঢেপ্সির ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেও জানতে পারি ‌ সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফেসবুক অ্যাপ টা ডাউনলোড করে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললাম কিন্তু নাম দিলাম পাষাণ কন্যা অহল্যা।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।