T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় পলাশ দাস

একটি রাত ও ফড়িং পোতা

গা বেশ শুকিয়ে শুকিয়ে আসছে। ভোররাতের দিকে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। বেশ বৃষ্টি হয়েছে পুজোর দিনকয়েক আগে পর্যন্তও। তাই হয়তো এবার মাঝ অক্টোবরেই ঠান্ডা গায়ে লাগছে। সন্ধ্যার দিকে ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, রাতের দিকে রাস্তার আলোর কোল জুড়ে কুয়াশা। ঠিক এই সময় হৈ হৈ কাণ্ড বেঁধেছে ঝিমাইদের বাড়ি। ঝিমাইদের বাড়ি সারা বছরই ফাঁকাই পড়ে থাকে, তবে উৎসব অনুষ্ঠানে একান্নবর্তী হতে সময় লাগে না। সন্ধ্যা থেকে গোল টেবিল বৈঠক বসেছে। সবাই যখন একসাথে হয়েছি, তখন কালকে কোথাও একটা যেতেই হবে বলে, ঝিমাই সন্ধ্যা থেকে বায়না জুড়েছে। আর ঝিমাইকে ঠান্ডা করতে এখন সবাই বসেছে কোথায় যাওয়া হবে তা ঠিক করতে। শব্দের আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ছে টেবিলের এ-কোণা থেকে ও-কোণায়। তুমুল হৈ হট্টগোলের মাঝে অনিকেত বলে উঠল, “বাড়ির কাছাকাছি তো যাওয়া যায়, ফড়িং পোতা। কি যাওয়া যায় না?” সঙ্গে সঙ্গে অনিকেতের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝিমাই, তিন্নি, তুতুলরা।

হৈ হৈ ব্যাপারটা মাত্রা ছাড়াল। কানে হাত দিয়ে অম্বরীশ বলে উঠল, “তোরা একটু চুপ করে বস, নাহলে ও – ঘরে যা। আমরা তো কথা বলছি, ঠিক করে তোদের জানাব।” “না, না, বাবা। আমরা যাচ্ছি না। তোমরা আমাদের ফাঁকি দিয়ে কিচ্ছু করতে পারবে না! আমরা থাকব”, বলতে বলতে ঝিমাই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। “তাহলে কোনো কথা বলবি না, একেবারে চুপ করে থাকবি।” অম্বরীশের কথা শেষ হতেই ঝিমাই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে আর কোনো কথা বলবে না। তিন্নি, তুতুলরাও ঝিমাইয়ের দেখাদেখি ঠোঁটে আঙুল ছুইয়ে বসে পড়ল। ইতিমধ্যে রতন দু-রাউন্ড চা দিয়ে গেছে। অজন্তা, ইলা, গহনারাও এসে এখন আলোচনায় যোগ দিয়েছে। খুব জোর আলোচনা চলছে। অজয় মাঝে মাঝে হাসি তামাশা দিয়ে আলোচনাকে আড্ডায় পরিণত করেছে। “ফড়িং পোতা! ধুর, মেজদা কি বলছিস এসব। ওটা একটা যাওয়ার জায়গা হল!” অজয় বলল। অনিকেত বলল, “কেন, খারাপ কিসের?” কি বলছিস, এতদিন পর আমরা একজায়গায় হয়েছি। একটু দূরে না গেলে হয়। তুই কি বলিস বড়দা?” অম্বরীশ মাথা নাড়িয়ে বলল, “ না সেটা ব্যাপার নয়, একেবারে খারাপ কিন্তু ও বলেনি। আর এসব বেড়ানোর ব্যাপারে আমরা কতটা বুঝি বল। ও সারা বছরই তো ঘুরে ঘুরে কাটায়। “অনি, ওখানে রাতে থাকা যাবে নাকি রে?” “হ্যাঁ, কেন থাকা যাবে না। এখন অনেক ভালো ব্যবস্থা হয়েছে। কটেজ করেছে। আমরা সেবার ওখানেই আমাদের কোম্পানির মিটিং করলাম না। আমাদের সব অতিথিরা এসেছিল। রাতে থাকল। বেশ ভালো ব্যবস্থা। আর নদীর দিকটা তো এখন ওপেন হয়ে গেছে। আরও আলো হাওয়া। খুব ভালো হয়েছে। যাওয়া আসাও ভালো। আমি বলব কম খরচে, কম সময়ে খুব ভালো বিনোদনের জায়গা। পাশেই জঙ্গল আছে। ঘোরা থাকা দু-একদিনের জন্য পারফেক্ট।” একটু থেমে আবার শুরু করল অনিকেত, “ আরে ঝিমাই কি এমনি লাফাচ্ছে নাকি, আমাদের সেই ছবিগুলো ইলা ওকে দেখিয়েছিল না, সেই থেকেই তো ইলাকে বলে রেখেছে।” অম্বরীশ ঝিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই নাকি! কাজ অনেকটাই এগোনো আছে দেখছি।” ঝিমাই মাথা নামিয়ে বলল, “আমি তো কাকিমাকে বলেছিলাম কাকাইকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে…” ওর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে অম্বরীশ বলল, “থাক, থাক, বুঝেছি। মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে।” সঙ্গে সঙ্গে সবাই বেশ উচ্চস্বরে হেসে উঠল। ইলা বলল, “ দাদা, তাহলে এবার যে বিয়ে দিতে হয়। তা আমাদের ঝিমাই কি ছেলে দেখেছে?” ঝিমাই লজ্জা লজ্জা মুখে বলল, “কাকিমা… তুমি পারও। আগে পড়াটা শেষ হোক!”

অজয় মাথার উপর দুহাত তুলে বলল, “আলোচনা অন্যদিকে যাচ্ছে, এভাবে চললে কাল কেন, আগামী এক বছরে আমাদের কোথাও যাওয়া হবে না!”
“তুমি ঠিক বলেছ ছোটকা, আসলে এরা কেউই নিয়ে যেতে চায় না। তাই, এসব বলে সময় নষ্ট করছে।” বলেই ঝিমাই তিন্নির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিল। “এই যে আমাদের তিন্নি সোনা, কত আশা করে আছে তার কী হবে? তোমরা তাড়াতাড়ি ঠিক করো না কোথায় যাবে, এমন করলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে, ও বাবা!”
অম্বরীশ হাত তুলে বলল, “এবার তাড়াতাড়ি শেষ কর তোরা রাত হচ্ছে। অজন্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরাও বল।”
অজন্তা ইলাকে দেখিয়ে বলল, “আমাদের মধ্যে ইলাই সব বলবে, কি বলিস গহনা?”
“হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ বড়দি, মেজদি এসব ভালো বলতে পারবে।”
“তুতুল তোর মা কোথায়?” অজন্তা বলল।
“আমি জানি না বড়মামি, মা হয়তো রান্নাঘরে আছে। মা আমাকে মেরেছে, আমি মা-র সাথে কথা বলছি না এখন। তাই সবটা জানি না।” বলেই ঝিমাইয়ের চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো।
“ছোটদি তোকে মারল কেন?” গহনা জানতে চাইল।
“ওই যে তখন ঝিমাইদিদি আচার খাচ্ছিল, আর আমি বায়না করছিলাম। তাই।” বলেই ঝিমাইয়ের হাত ধরে বলল, “ঝিমাইদিদি আমাকে আচার দেবে কালকে, আজ তো খাওয়া হল না।”
ঝিমাই তুতুলকে আলগোছে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, “কালকে খেলে যদি তোমার শরীর খারাপ করে তাহলে, যদি জ্বর হয়, তখন? আগে ঘুরে আসি তারপর দেবো।”
তুতুল মহা আনন্দে মাথা নেড়ে ঘরের মধ্যে একপাক ভোঁ করে ঘুরে নিয়ে ঝিমাইয়ের পাশে দৌড় থামিয়ে বলল, “তুমি খুব ভালো ঝিমাইদিদি!” বলেই আর একপাক ঘুরল, তারপর থেমে বলল, “আমার রাগ করা শেষ বড়মামি, আমি মা-কে ডেকে আনছি।” বলেই একছুটে ঘরের বাইরে চলে গেল।
সবাই এবার হো হো করে আরেকবার হেসে উঠল। একটু পরেই সুতপার হাত ধরে তুতুল এসে দাঁড়াল। তারপর আরও জোর শুরু হল ঘুরতে যাওয়ার বৈঠক।

বিকেল থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে এখন রাত, সেই থেকে চলছে যার কোনো শেষ নেই। একেক জনের একেক কথা। একেকবার জোয়ারের জল এসে পাড়ে ধাক্কা দিচ্ছে, আর ফিরে যাচ্ছে। প্রত্যেকবার নতুন জল, নতুন উজান। খানিক পরে তারা হারিয়ে গিয়ে আবার নতুন।
এরই মধ্যে অনিকেত বলল, “তোরা এখনও শোন বড়দা, ফড়িং পোতাতেই চল। আমি বলছি, দেখবি ভালো লাগবে।”

দুই।।

“কি রে রতন, কতবার হল?” অনিমা রান্না ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রতনকে জিজ্ঞাসা করলেন। “
রতন পিঠ ঘুরিয়ে একবার দেখল অনিমাকে। “বেশি নয় মা, এই দু’বার।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনিমা বললেন, “এরা সারা বছর যখন না থাকে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর একসাথে হলেই দেখ, কান পাতা দায়। আর তোর খাটনি বাড়ে…”
কথা থামিয়ে দিয়ে মাঝপথেই রতন বলল, “না মা, এ আর তেমন কি! তাও দাদারা আসে তাই। নাহলে সারা বছর কোনো শব্দ নেই, হৈ হৈ নেই, ভালো লাগে না। এই ভালো, বাড়ির মানুষেরা বাড়িতে না থাকলে সে বাড়ি কি বাড়ি হল মা!”
“তা ঠিক বলেছিস, কিন্তু তাই বলে এতটাও ভালো ন!” বেশ খানিকটা অনুযোগের সুরেই বললেন অনিমা।
রতন অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল হাতের চায়ের কাপগুলো ধুয়ে গুছিয়ে রাখতে রাখতে।
“তা, আজকে কি নিয়ে লাগল রে?”
“কালকে মনে হয় কোথাও যাবে সবাই মিলে, সেইসব নিয়ে কী কথা বলছে। ঝিমাই খুব বায়না ধরেছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
“এরা পারেও, এই সপ্তাহ খানেক কী হৈ হৈ করল আবার এখন ঘুরতে যাবে?” অনিমা রতনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন।
“বুঝলে না মা, বছরে তো এই কটা দিন একসাথে হয়। একটু হৈ হৈ করবে না! আবার তো সেই সামনের বছর।”
“তা ঠিক। আসলে কি বলত, এই কটা দিনই তো ওদের একসাথে কাছে পাই। ছুটকি তো তাও তুতুলকে নিয়ে মাঝে মধ্যে আসে। ওরা তো আসতেও পারে না। তাই কাছ ছাড়া করতে চাই না।” রতন কাজের ফাঁকে সান্ত্বনার হাসি হাসল।
“আমি খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি না কি রে?”
রতন হাতের কাজটা ফেলে রেখে অনিমার কাছে এগিয়ে এলো, “কি বলছ এসব। তোমরা আছ বলেই না ওরা তোমাদের টানে এখানে আসে। তোমরা না থাকলে কি আর এই বাড়িতে আসবে! তোমার তো কাছে পেতে ইচ্ছা করবেই।”
মুচকি হেসে অনিমা বললেন, “তা এবার আর আমাকে বলল না যে?”
হা হা করে রতন একচোট হেসে বলল, “সেখানেই তো যত গণ্ডগোল। তোমাকে বলবে কি, আগে নিজেরা ঠিক করুক।” বলে রতন ঘরের বাইরে চলে গেল।

রাত্রি এগোতে এগোতে এখন প্রায় সাড়ে ন’টা। রায়বাড়ি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। দিগম্বর রায় খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। রাতে ঘুম হয় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুমটাও কমে গেছে। রাতে ঘুম ভেঙে যায় অনেকবার। উঠতে হয়। বাড়িতে লোকজন রয়েছে বলে এখন একটু অনিয়ম হয়ে যাচ্ছে, তবুও তার মধ্যে দিয়ে যতটা মেনে চলা যায়। ঝিমাইদের আলোচনাও শেষ হয়েছে। ঠিক হয়েছে কালকে বেরোন হবে ফড়িং পোতার উদ্দেশ্যে। রাতে সেখানে কাটিয়ে পরের দিন বিকালে ফিরবে সবাই। ঝিমাইদের ডিমান্ড ছিল অন্তত দু’দিন। কিন্তু, আবার ফিরতে হবে যার যার কাজে তাই, কেউ ওদের মতে সম্মত হয়নি। পাড়ার গাড়ি ড্রাইভার বল্টুকে বলাও হয়ে গেছে কাল দুপুরের আগেই গাড়ি নিয়ে হাজির হতে। তাই, সবাই তাড়াতাড়ি খেতে বসে পড়েছে। আজ আর বেশি রাত নয়। এমনিতে সবার শরীর খুব যে যুতের তা নয়, এই কদিন পুজোয় মেতে বেশ ক্লান্ত, তবুও এ বছরের মতো ঝিমাইদের কথা রাখতে যেতেই হচ্ছে।

বারান্দা জুড়ে আবছা আলো জ্বালছে। সব দরজা দেওয়া হয়েছে কিনা দেখে ঘুমাতে যাওয়া রতনের বহুদিনের অভ্যাস। সেইমতো রতন সদর দেখে বারান্দা দিয়ে ঘরে যাচ্ছিল। দেখল আবছা অন্ধকারে টেলিরে পাশে বসে ঝিমাই। “কি গো ঘুমাও নি?”
“হু, আজ কি আর ঘুম আসে! কাল যে যাব।”
একঁউ হেসে রতন বলল, “যাও ঘুমিয়ে পড়ো, নাহলে শরীর খারাপ করবে যে! দেখ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা পড়ছে।” বলে রতন চলে যাচ্ছিল। পিছু ডাকল ঝিমাই।
“রতনদা!”
রতন ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল ঝিমাইয়ের পাশে। রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝিমাই বলল, “ছুটি শেষ গো রতনদা। আবার ফিরে যেতে হবে। এখন খুব মনে হচ্ছে, জোরাজুরি না করলেই ভালো হত। তোমাদের সারা বছর খুব মিস করি। তোমার সাথে , ঠাম্মার সাথে থাকলেই ভালো হত।”
ঝিমাইয়ের কাঁধে হাত রেখে রতন বলল, “তোমরা কটা দিনের জন্য এসেছ, একটু আনন্দ না করলে হয়। আমরা তো আছি। আবার আসবে আবার দেখা হবে, কথা হবে। আর তোমাদের যাওয়ার তো এখনও দ-শ- দিন বাকি। ওঠো এখন, যাও শুতে যাও, এসব কথা কাল হবে।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে ঝিমাই। রতনের পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখল দরজার পাশে পর্দাটা কেমন নড়ে উঠল। “দরজার পাশে কি রতনদা? আমার কিন্তু ভূতে খুব ভয়!”
“ ধুস, কি সব বল। তেনারা এখন এখানে আসবে কেন? আমি দেখছি…” রতন এক পা এগোতেই ছায়া নড়ে উঠল, সরে আসল দুটো ছায়া। রতন দেখল পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসছে দুই ভূত। তিন্নি আর তুতুল।

“কি রে তোরা এখানে?”
“ঘুম আসছে না রে দি! আমাদের তো আবার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। এটা মনে পড়লেই ঘুম আসে না। তাই, উঠে এলাম। ঘুম না আসলে শুয়ে থাকা যায়, বল?”
তুতুল ঝিমাইয়ের হাত ধরে বলল, “এখন আমরা কলা গাছ কলা গাছ খেলব ঝিমাই দিদি?”
তিন্নি লাফিয়ে বলল, “না, ফোনটা আনছি, গেম খেলব।”
তিন্নি চলে যাচ্ছিল ঝিমাই ওর হাতটা চেপে ধরল, “না এখন কোনো খেলা নয়। কালকে যেতে হবে না। আমি ঘুম ডেকে এনে দেব, চল শুয়ে পড়বি।” দুজনের হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে পিছু ফিরে বলল, “রতনদা তুমি আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়, জেগে থেকো না। আমি এদের শুইয়ে দিই।”

আলো বন্ধ করতে করতে রতনের মনে কথাগুলো বিজয়ার ঢাকের মতো বেজে উঠল। কে বলবে এদের সারা বছর দেখা হয় না। একজন ঘুমাচ্ছে না দেখে আরেক জন তাকে ঘুমাতে নিয়ে গেল। নড়তে থাকা দরজার পর্দার দিকে চেয়ে রতনের মন বলে উঠল, এমন ছোটোবেলা সারা জীবন কেন থাকে না? কেন সবাই বড়ো হয়ে যায়? আলো নেভাতে যেতে যেতে রতন মনে মনে বলল, তোমরা সারাটা জীবন এমন থাকবে না জানি। হয়তো আর দশ বছর পর এমনভাবে আর হাত ধরে নিয়েও যাবে না। তবুও আমি চাইব এমনই থাক তোমরা। আলোটা নিভে গেল। সারা ঘরটা অন্ধকারের জবজবে হয়ে উঠল। দরজা, জানলা, চেয়ার, টেবিল সব কেমন অন্ধকারের ভিতর তলিয়ে যেতে থাকল। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ধীরে হেটে চলে গেল রায়বাড়ির পুরোনো মানুষ রতন।

তিন।।

সকাল থেকেই একটা হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। ফড়িং পোতা যাওয়া এখন মাথায় উঠেছে সবার। বাড়িতে সব লণ্ডভণ্ড। দিগম্বর রায়ের বহু পুরোনো দম দেওয়া হাত ঘড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। অনিমা রায়ের চশমা আর ঠাকুরের পাথর বাটি হাওয়া। গহনার কানের দুল নেই। সুতপা যে নতুন শাড়িটা কিনেছিল পুজোয় সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না। অজন্তার গলার হার সেটাতেও চোরের নজর পড়েছে। অম্বরীশের বিয়েতে পাওয়া সোনার আঙটি, ইলার পায়ের তোড়া, তুতুলের পুজোয় পাওয়া বড়মামার দেওয়া ইলেকট্রনিক হাত ঘড়ি এইসব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সকাল থেকে টান টান উত্তেজনা।

তুতুলের চিৎকার, তিন্নির লাল জামায় কালির বিশ্রী ছিটে লাগার জন্য ঘ্যানঘ্যান, গহনার মুখ ভার, অজন্তা এককোণে বসে, অম্বরীশের বেজায় মাথা গরম, আর থেকে থেকে শুধু একটাই কথা বলছে, “জীবনে কোনোদিন একটাও জিনিস এ-দিক ও-দিক হল না আর আজ এতগুলো জিনিস একসাথে বেপাত্তা।”
জোরে রতনকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল, “রতনদা রতনদা… কালকে রাতে দরজা দিয়েছিলে তো ঠিকঠাক? এই রতনদা…”
অজয় চুপচাপ বসে চা খাচ্ছে দেখে ওকেও কয়েক কথা শুনিয়ে দিল, “চা খাচ্ছিস, চা খাওয়া আসছে? তোর কোনো ফিলিং নেই না! এতগুলো জিনিস বেপাত্তা, কোথায় খুঁজবি তা না করে চা খাচ্ছিস।”
অজয় মুচকি হেসে বড়দার কথা উড়িয়ে দিল। “আমি খুঁজলেই বুঝি পাওয়া যাবে!”
“হাতে হাত না রেখে চেষ্টা তো কর।” অম্বরীশ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল।
“আজ যাওয়া হবে না নাকি রে বড়দা?” অনিকেত বলল।
“এর মধ্যেও যাওয়ার কথা মাথায় আসছে। ঘরে গিয়ে দেখ কেমন ঘ্যানঘ্যান জুড়ে দিয়েছে সব। আগে সব জিনিস পাওয়া যাবে, তারপর। থানা পুলিশ করব দরকারে।”
“আঃ এত চিৎকার করলে কি পাওয়া যাবে। আছে কোথায় দেখ ভালো করে। অনেক মানুষজন এ-দিক ও-দিক হয়ে গেছে হয়তো।” দিগম্বর রায় খুব শান্ত ভাবে কথাটা বললেন।
“তুমি বুঝতে পারছ না বাবা!” বলতে বলতে অম্বরীশ চলে গেল।
পিছন থেকে ডাকল অনিকেত, “গাড়িকে না বলে দেবো? মানে কখন পাওয়া যাবে, তারপর…”
“তোদের যা ইচ্ছে হয় কর। আমি ভাবতে পারছি না।”
তিন্নি তখনও টেবিলের পাশে মুখ রেখে কেঁদে চলেছে। তুতুল ঘরে এতটাই জোরে কাঁদছে যে বারান্দার বসার জায়গা থেকে শোনা যাচ্ছে।
“মা, কী হয়েছে গো?” ঝিমাই অজন্তার কাছে জানতে চাইল। এমনিতেই মাথা গরম হয়ে ছিল তার ওপর ঘি ঢালল ঝিমাই।“কী আবার হবে, যা কোনো দিন হয় নি, তাই হয়েছে। চুরি বোঝ? যাও দেখ গিয়ে। সব হয়ে গেল এখন উনি এলেন কী হয়েছে জানতে…”
“এত রাগ করছো কেন? সব পাওয়া যাবে। কোথায় আর যাবে এই বাড়িতেই আছে।”
“দেখ মাথা এমনিতেই গরম আছে। যা এখান থেকে।”
“আচ্ছা, যাচ্ছি।” বলেই ঝিমাই চলে গেল।

বেলা সাড়ে বারোটা পার করে একটার দিকে ঘড়ির কাঁটা চলেছে। বল্টুকে বলে দেওয়া হয়েছে যাবে না। বাড়ির সকলে বুঝে গেছে যাওয়া হবে না। অনিমা একদিকে দুঃখ পেলেও, অন্যদিকে বেশ খুশি। সবাই একসাথে বাড়িতে থাকবে বলে। রতন বেশ আনন্দে আছে। তাইতো দুপুরের রান্নার বাজার করতে গিয়েছে বেশ খানিক আগেই। অজয়ের তেমন হেলদোল নেই। ঝিমাই মনকষ্টে ভুগছে বলে মনে হচ্ছে না। অনিকেত সারা সকাল তন্ন তন্ন করে সারা বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত।বাড়ির সকলেই যখন ধরে নিয়েছে আর পাওয়া যাবে না, অম্বরীশ যখন লোকাল থানায় ফোনটা করবে বলে হাতে ফোন নিয়েছে তখনই সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ঝিমাই বলল, “সব পাওয়া গেছে বাবা, সব উপরের চিলেকোঠার কোণায় একটা কাগজের বাক্সের মধ্যে ছিল। মেজকা হয়তো ওখানে খোঁজ করেনি। আমি দেখলাম। এই নাও তোমাদের সব জিনিস।”
সবাই যখন খোয়া জিনিস পাওয়ার আনন্দে মেতে উঠবে উঠবে করছে তখনই অজয় বেশ উৎফুল্ল হয়ে রতনকে বলে উঠল, “রতনদা, এবার তোমার খেল শুরু হোক!”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।