• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ -তে প্রভাত মণ্ডল (পর্ব – ২)

ইছামতীর সন্তান – ২

উত্তর চব্বিশ পরগনার সীমান্ত শহর বনগাঁ থেকে মাত্র চার কিলোমিটারের ব‍্যবধান,গ্ৰামের নাম আংরাইল।গ্ৰামেরই পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইছামতীর ওপারে বাংলাদেশের গ্ৰাম পুটখালি।এই দুই গ্ৰামের এক অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য,আংরাইলের জনবসতি সম্পন্ন এলাকার নদীর ওপারে পুটখালি গ্ৰামের মানুষের চাষাবাদ ভূমি, একই ভাবে এদেশের চাষাবাদ ভূমির ওপারেই বাংলাদেশের মানুষের বাসভূমি।মাঝে বয়ে চলা ইছামতী বড্ড নিস্তেজ হয়ে গেছে আজ পলি জমে জমে।শ‍্যাওলার স্তূপে বসে পানকৌড়ি এক নজরে তাকিয়ে থাকে শিকারের আশায়।মাছরাঙাটাও চতুর, পানকৌড়ির শিকার লুফে নেবার বদ অভ‍্যাসটা ওর ভিতরে কাজ করছে।মানুষের স্বার্থপরতাটা বুঝি ওরাও জেনে গেছে।ঠিক সেটাই হল,পানকৌড়ির মুখের গ্ৰাসটা ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে গেল বটগাছটার ডালে।হ‍্যাঁ, পুটখালি গ্ৰামের জনবসতি সোজা ইছামতীর এ ধারে একটিমাত্র বটগাছ প্রাচীনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মাঝখানে।মাঠটির নাম চরের মাঠ।গাঁঁ এর প্রাচীন মানুষ জগা সকালে পান্তাভাত আর কাঁচা পেয়াজ চিবাতে চিবাতে নাতি-নাতনি আর পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করে —
যহন ছোটো ছ‍্যালাম গাঙে জোয়ার-ভাঁটা খ‍্যালতো কি!সোরোত ছ‍্যালো কি বাপরে!তাহানো যাইতো না।ছ‍্যাচোল্লিশের পরে হেদুস্তান পাহিস্তান যহন ভাগ হইলো তখনকার দিন ভোলান যাইনা।
পাড়ার কামালের মা বলে ওঠে —-
হ দাদা ঠিক কৈচেন।এহাত্তরের পর আমরা যহন আসি তহন তাই কত্ত চ‍্যাওরা ছ‍্যালো গাঙ,কুমীর দেহা যাইতো
খইলসা,চাঁদা,সরপুটি,ক‍্যাঁঁকলে,পাহা পাহা বান মাছ এত্ত এত্ত বাগদি পাড়ার ছ‍্যামরা গুলান দে যইতো।মাগুর মাছ জেয়ান থাইতো হাঁড়িতে,ফুরাইতো না ঘর থাইক‍্যা।আর এহন!
—- হ কামালের মা হেই দিনগুলা মনে পড়লি জেবে জল গড়াইয়া পড়ে।
জগার বৌ এসে বলে —–
অ ভুলার বাপ,আর চাইড্ডা দিমু নাই ভাত?নবন প‍্যাজ কিচু লাগবো নাই?
— না লাগবো না।তোমারে কইচি না একদিন,কতার মাজে কতা কইতে আইবা না?দেকতিচো তো কতা কইতেচি কামালের মার লগে।
—আ হা হা হা,এহন পিরীতির নোক পাইচো না!এহন তো আমারে সহ‍্য করতি পারবানানে।কামালের মারে পাইলে তো আর কারো লাগেনানে।
ভোলার মা গজগজ করতে করতে চলে যায়।কোনো ভ্রুক্ষেপ সেদিকে জগা কিংবা কামালের মা কারোরই নেই।আপন মনে প্রাণের কত গল্প করতে থাকে।জগা বলে চলে —-
তোমরা তো আইচো এই কয় সাল হইলো।শুশুক দ‍্যাকচো?দ‍্যাহো নাই।আমরা দ‍্যাকচি।চোহের ধারে ঘুইরা ব‍্যাড়ায় য‍্যান এহোনো।এহন যেই হানে চরের মাট,আগে জল আর জল ছ‍্যালো।মাটি জইমা জইমা চর পইর‍্যা যাওনের পর ঘোষ আর কাপালিগো সব সরকার থেইক‍্যা জমি নে চাষ শুরু করচেলো।সেইহান থেইক‍্যা চরের মাট কয় সগ্গোলে।
সত‍্যিই তো,ইছামতীর বিস্তীর্ণ জলাভূমি, জোয়ার-ভাঁটা সব হারিয়ে গিয়ে নদী আজ ক্ষীণ স্রোতা।জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব কালের নিয়মে আজ অবলুপ্তির পথে।ইছামতীর বুক জুড়ে পরেছে চরা।তাই আংরাইলের এই সীমান্ত ঘেঁষা প্রায় পাঁচশত বিঘার কাছাকাছি জমি আজ চরের মাঠ বলে পরিচিত।ইছামতীর বুকে আজ ফসলের ক্ষেত।নীলাভ জলাভূমি আজ সবুজে পরিপূর্ণ।
তবে এই সবুজের সমারোহ আষাঢ়ে ঢেকে যায় সফেন জলস্রোতে।স্রোতহারা নদী বর্ষায় পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে গর্ভের সন্তান নিয়ে।ফিরে পায় পুরোনো চেহারা।আষাঢ় থেকে ভাদ্র থৈ থৈ করে জলে।সে সময় চাষীরা অনেকেই যে যার জমিতে ছোটো ছোটো জাল পাতে।কখনো মাছ হয় আবার কখনো খালি জাল কাঁধে নিয়ে জল ভেঙে বাড়ির দিকে রওনা দিতে হয়।জল শুকিয়ে চাষের কাজ শুরু হতে আবার কার্তিক মাস।
গ্ৰামের আয়তন অনেকখানি।একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী,এক পাশে বর্ণবেড়িয়া,এক পাশে পুরাতন বনগাঁ অন‌্য পাশে আছে গদাধরপুর।গ্ৰামটির আয়তন যেমন দীর্ঘ তেমনি কাপালি, ঘোষ,নমঃশূদ্র,পন্ডক্ষৈত্র,হালদার, পাঁড়ুই সহ আরো নানা জাতির মানুষের বসবাস এই গ্ৰামে।আগে পরস্পরের মধ‍্যে যে মিলমিশ ছিলো দিন পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই সৌহার্দ্য আর লক্ষ‍্য করা যায় না।কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে সব সম্প্রীতির বাঁধন।এসব বোধ হয় আধুনিকতার ছোঁয়া।
গাঁ’এর কাঁচা রাস্তা প্রায় সবই পাকা,বিদ‍্যুৎহীন স্থানগুলোতেও বিদ‍্যুৎ পৌঁছে আজ আমূল পরিবর্তন চোখে পড়ে।তবে বাহান্ন পল্লীর কোনো পরিবর্তন হয় না।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের অত‍্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ যখন নিজের বীর সন্তানদের হারিয়ে স্বাধীনতা লাভ করল,সে সময়ে বহু হিন্দু পরিবার বিনিময় প্রথার মাধ‍্যমে ভারতে চলে আসে।আবার ভারতে থাকা বহু সংখ্যক মুসলমান পরিবার বাংলাদেশে চলে যায়।বাংলাদেশ থেকে আসা এমনই বাহান্নটি হিন্দু পরিবার চরের মাঠের পার্শ্ববর্তী স্থানে, পাকা রাস্তা থেকে অদূরেই জগার বাড়ির কাছাকাছি সরকারি খাস জমিতে এসে আশ্রয় গ্ৰহণ করে।বাহান্নটি পরিবারের বাস বলে ওই অঞ্চলের নাম হয় বাহান্ন পল্লী।প্রায় সকলেই নমঃশূদ্র।গ্ৰামের আর সকল মানুষগুলোর মত সরকারি সাহায্য তাদের জোটে না।দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের শিশুদের অধিকাংশই অপুষ্টির শিকার।
—-দ‍্যাকচো কামালের মা?অই মনে হয় আবার ক‍্যাডা মরচে।দিনকাল যে কি হইতেচে ক‍্যাডা যানে।খালি দেহি হরিনাম দ‍্যাতে দ‍্যাতে লইয়া যায়।
—– হ গো দাদা!আমাগেরও দিন আইতাচে!আর তো কইডা দিন,কহন টুক কইর‍্যা চইলা যাইমু তার খবর ক‍্যাউ জানে না গো দাদা!
ভোলার মা’র মনে খুব কষ্ট।এই বয়সে স্বামী সবসময় কামালের মা’র কাছে পড়ে থাকে,গল্প করে অথচ নিজের স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ তার নেই।যৌবন বয়সে ভোলার বাপ আর কামালের মা’কে নিয়ে অনেক কথা শোনা যেত।তাদের রঙের কথা।জগা নিজের বৌ এর জন‍্য না এনে কামালের মার জন‍্য আয়না,চিরুনী,চুল বাঁধা ফিতে এমনি রকমারি কত কি এনে দিত।সহ‍্য হত না ভোলার মা’এর।রাগ করে বাপের বাড়িও গিয়ে উঠেছিল কয়েকবার।কিন্তু প্রতিবারই বাপ তাকে স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেয়,বলে —–
বিডা মানুষ যহন যা মন চায় করুক গিয়া,অত দেহনের কি আচে।কতায় কতায় পা তুইলা নাচতে নাচতে বাপের ঘরে আইলেই হইলো?লোকে কি কবে ভাবচিস একবারও?বাপের মানডা খাইবি নাহি?
সুবল দশম শ্রেণিতে পড়ে গাঁ’এরই স্কুলে।জগার নাতির বয়সে।গনেশকে ডাকতে এসে সুবল দেখলো গনেশের দাদু কামালের মা’র সাথে বসে গল্প করছে।এমন দেখে মুচকি মুচকি হাসে সুবল।কামালের মা’এর তা দৃষ্টি এড়ায় না——
অ ব‍্যাডা হাসতাচো ক‍্যান?
গনেশ ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে —
এই বুড়া বয়সে তোমাগো যা স্ববাব দ‍্যাকতাচি,তাতে আমাগো মত যহন বয়স ছ‍্যালো তহন কি না করচো,ভাবা যায়!শরমের বালাই নাই তোমাগো মাজে একটুও।

হঠাৎ চোখমুখ লাল,খুব দ্রুততার সাথে বিশু সাইকেল চালিয়ে আসে।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।