গারো পাহাড়ের গদ্যে এস এম শাহনূর (পর্ব -১৪)

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য চাঁদপুর:

“চাঁদপুর ভরপুর জলেস্থলে,
মাটির মানুষ আর সোনার ফলে।’’
(কবি মরহুম ইদ্রিস মিঞা)

“প্রকৃতির নিবিড় মমতায় পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া বিধৌত চাঁদপুর যেনো এক রুপ নগরের রাজকন্যা। যার রূপের যাদুতে মুগ্ধ হয়ে নেমে আসে আকাশের চাঁদ।
মেঘনা ডাকাতিয়ার জলজ জ্যোৎস্নার বিগলিত স্রোতধারায় পুষ্ট, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক নিবিড় শ্যামল জনপদের নাম চাঁদপুর।যার আয়তন প্রায় ১৭০৪.০৬ বর্গ কিলোমিটার।চাঁদপুর হচ্ছে চাঁদের নগর।এ চাঁদ আকাশের বিনিদ্র যামিনী জাগা চাঁদ নয় এ চাঁদ কোন ব্যক্তির কাল বিকীর্ণ নামের বিচ্ছুরণ।

লোককথার বিখ্যাত সওদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর একদিন এই উর্বর জনপদে ভিড়েছিলে। তাহারি সমৃদ্ধ নামে পরিচিত চাঁদপুর এই লোকবিশ্বাস অনেকেরই মনে দৃঢ় হয়ে গেঁথে আছে। কারো কারো মতে শহরের পুরিন্দপুর বর্তমানে কুড়ালিয়া হলার মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম হতে চাঁদপুর নামের উৎপত্তি। বারো ভূঁইয়াদের আমলেই ভূখণ্ড বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের দখলে ছিল এই অঞ্চলে তিনি একটি শাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন তাই ইতিহাসবিদ জেএম সেনগুপ্তের মতে চাঁদ রায়ের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর।

লোককথার প্রসিদ্ধ চাঁদ সওদাগরের নাম কিংবা চাঁদ ফকিরের পুণ্য নামের স্মৃতিধন্য মেঘনার স্রোতধারায় পুষ্ট চাঁদপুর পর্যটকদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে আজো।”
চাঁদপুর জেলা শহরের গোড়াপত্তনের অনেক-অনেক বছর আগেই এই জেলার বিভিন্ন পল্লী গ্রামে গড়ে উঠেছিল সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সেদিন সংশ্লিষ্ট প্রথিতযশা শিল্পী-সাহিত্যিক ও কলাকুশলীগণ। পল্লীর সহজ-সরল মানুষের বাস্তব জীবনের কাছাকাছি ঐ সময়ের শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্প ও সাহিত্য চর্চা অবিভক্ত ভারতবর্ষের সূধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিশেষভাবে। ঐ সময়ে শিল্পীদের-সঙ্গীত আর অভিনয় মাতিয়ে তুলেছিল পল্লী গাঁয়ের মানুষের অনাবিল অন্তরকে। এমনিভাবে বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের সাহিত্য সংস্কৃতির মহাসাগরের বিপুল স্রোত প্রবাহকে ননা উপাচারে সমৃদ্ধ করেছে এই জেলা।

জেলার পশ্চিমাংশে প্রবাহমানা মেঘনার কলকল ছলছল ঐক্যতান সৃষ্টি করেছে এক সুরেলা আবেশ। সে আবেশের ছোঁয়াচ কালে কালে, যুগে যুগে মাতিয়ে তুলেছে এর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ সমতল ভূমির সরল প্রাণ জনগণের অন্তরকে। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে মেঘনারই শাখা-স্রোতধারা ডাকাতিয়া।ডাকাতিয়ার রয়েছে অন্য এক মোহনীয় রূপ। ডাকাতিয়া এক অপরূপে সাজিয়েছে এই জনপদকে। তার স্বচ্ছস্রোতধারা দিয়ে প্রাচুর্য। এনেছে প্রাচুর্যপ্রাপ্তির প্রশান্তি। ফুলে ফুলে ভরপুর, গানে গানে সুমধুর এই মহকুমার প্রায় প্রতিটি জনপদ। প্রভাতের সাতরঙ্গা রশ্মিচ্ছটা, মেঘনা-ডাকাতিয়ার কলকল-ছলছল উচ্ছ্বলতান, প্রভাত পাখীর কল-কাকলী মোহনীয় করেছে সুদূর অতীতে- জেলার প্রত্যেক মানুষের অন্তরের সুকোমল তন্ত্রীকে। প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর বৈচিত্র্যময় পরিবেশে এখানে সাহিত্য-নির্যাসের সুরভীতে আকৃষ্ট হয়ে জন্মেছে কত শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক। কালের আবর্তে তাঁদের অনেকের নাম আজ শুধু স্মৃতি হয়ে রয়েছে মানুষের অন্তরে। মনসা মঙ্গল কাব্যে বর্ণিত উজ্জ্বয়িনী সম্ববতঃএ জেলার কচুয়া থানার উজ্জ্বয়িনী বা উজানী গ্রামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। উজ্জ্বয়িনীতে প্রাপ্ত বিশেষ বিশেষ নিদর্শন প্রকৃত তথ্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেবে তথ্যানুসন্ধানী গবেষককে। উজ্জ্বয়িনীর অদূরে বালুকাময় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অবস্থান আর এর গঠন প্রকৃতি নির্দ্ধিধায় স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীন সেই নদীর কথা-যে নদী দিয়ে বয়ে চলতো চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা। কচুয়ার ‘‘মনসা মুড়ার’’ সাথে জড়িয়ে আছে ‘‘বেহুলা সুন্দরী’’র অবিস্মরণীয় কাহিনী। দুলাল রাজার ও থানা বিবির (থানেশ্বরী) দীঘির অবস্থান আজও স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের অনেক স্মৃতিবিজড়িত কাহিনীর কথা। চাঁদপুর নামের সাথে চাঁদ শাহ্ ফকির কিংবা চাঁদ সওদাগরের কীর্তি অমর হয়ে আছে। সেদিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে এই মহকুমা যে এক প্রাচীন গৌরবমন্ডিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী, এ কথা নিঃসংকোচে অথচ সগর্বে বলা যায়। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র যখন ছিল কোলকাতা, ঠিক সেসময় চাঁদপুরের সাথে কোলকাতার ছিল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের (বাংলাদেশের) কেন্দ্রস্থলে অবস্থান হেতু এতদ অঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই মহকুমার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তখনকার দিনে পূর্বাঞ্চলের প্রায় সকলকেই চাঁদপুরের পথ পেরিয়েই যেতে হতো কোলকাতায়। সেই কারণে কোলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা শিল্প সংস্কৃতির স্পর্শে উজ্জীবিত ও আকৃষ্ট হয় এই মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মী।

শান্তিনিকেতনের প্রথম নারী শিল্পী-অধ্যাপিকা ও বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা। ১৯২৭ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে নোয়াখালীর লামচর গ্রামের জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর ছেলে নিরঞ্জন চৌধুরীর সাথে চিত্রনিভার বিয়ে হয়। তখন চিত্রনিভা’র নাম ছিল নিভাননী।চিত্রকলায় অধ্যায়নের অভিপ্রায়ে ১৯২৮ সালে নিভাননী শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখেন। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর সহচার্যে চিত্রসাধনাকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন।রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত তাঁর ছবি অাঁকার খোঁজখবর নিতেন। বলতেন, ‘কী কী ছবি অাঁকলে? আমায় এনে দেখিও।’ তারপর নিভা তাঁকে ছবি দেখাতে গেলে তিনি বলতেন, ‘তোমার শক্তি আছে, তুমি পারবে, আমি আশীর্বাদ করলুম।’ রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত অর্থেই নিভার শিল্পমুগ্ধ ছিলেন। সেজন্যে তাঁর চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ নিভাননীর নাম রাখেন ‘চিত্রনিভা’। নিভাননী আজীবনই কবিগুরুর দেয়া নামটি সযত্নে বহন করে গেছেন। নামরাখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ রসিকতা করতে ভুলতেন না। চিত্রনিভা চৌধুরী জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখলে বলতেন, ‘তোমার নামকরণ করলুম, এখন বেশ ঘটা করে আমাদের খাইয়ে দাও।’

রবীন্দ্রনাথ চিত্রনিভাকে তাঁর অাঁকা ছবি উপহার দিয়েছিলেন। তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন কয়েকটি রঙের বাটিও। এমনও হয়েছে নিভাননীর অাঁকা ডিজাইনের মধ্যে কবি নতুন একটি কবিতা লিখেছেন।
তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন ১৯৬১ সালে।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা’র জন্ম (১৯১৩ – ১৯৯৯) চাঁদপুরের পুরাণবাজারে।একদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ চাঁদপুরে এসেছিলেন।

চাঁদপুরে রবীন্দ্রনাথের যেনো নাড়ির টান ছিলো। চাঁদপুর শহর হতে ছয় কিলোমিটার দূরে বাজাপ্তি গ্রামে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ এবং পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির সহায়ক কর্মবীর কালীমোহন ঘোষের বাড়িতে। কালীমোহন ঘোষের জ্যেষ্ঠপুত্র শান্তিময় ঘোষের নাম রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেব ঘোষ করেন। শান্তিদেব ঘোষ শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ ছিলেন। কালীমোহন ঘোষের কনিষ্ঠ পুত্র সাগরময় ঘোষ রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে চাঁদপুরে বর্তমান নিউমার্কেট এলাকায় তৎকালীন পৌরসভার পার্কে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। রবীন্দ্রনাথ চাঁদপুর হতে ২৮ তারিখ নারায়ণগঞ্জে গমন করেন।

➤তথ্য ঋণ:
[১] ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর
[২] চাঁদপুরের কথা
[৩] চাঁদপুর জেলা তথ্য বাতায়ন
[৪] বিস্মৃতির চাঁদপুর (সম্পাদনা গ্রন্থ)।।
কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
চৈতন্য প্রকাশনী।
[৫] স্মৃতিকথা’।।চিত্রনিভা
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য চারুকলা পর্ষদ। (২০১৫)
রবীন্দ্রস্মৃতি।।চিত্রনিভা
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন,বাংলাদেশ।(২০১৭)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।