সাপ্তাহিক ধারাবাহিক ঐতিহ্যে “কলকাতার চার্চ (কোম্পানীর যুগ)” (পর্ব – ৩) – লিখেছেন অরুণিতা চন্দ্র

পূর্ববর্তী পর্বগুলিতে কলকাতার বুকে অষ্টাদশ শতকে পলাশী পূর্ব এবং পরবর্তী যুগের ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত Anglican অর্থাৎ চার্চ অব ইংলণ্ডের অধীনস্থ চার্চ দুটির কথা আলোচিত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতাতেই আসে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কোম্পানির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় তথা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ Anglican চার্চ তথা মহানগরীর একমাত্র ক্যাথিড্রাল হিসাবে St. Paul’s Cathedral -এর কথা।
আগেই বলা হয়েছে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিশপ পদটি সৃষ্টি হয়। এবং রেভারেন্ড মিডলটন (তাঁর নামে মিডলটন রো আজো পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে বিদ্যমান) সেই পদে আসীন হন। কিন্তু এই সময়ে মহানগরী তে কোন ক্যাথিড্রাল ছিল না। ক্যাথিড্রাল অর্থে সেই গীর্জা কে বোঝায় যেখানে বিশপের আসন রক্ষিত হয় এবং তা। কিছু সময়ের জন্য তাই কোম্পানীর একমাত্র অফিসিয়াল চার্চ হিসাবে সেন্ট জন’স চার্চ ই ক্যাথিড্রালের মর্যাদা লাভ করে। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কোম্পানিকে কলকাতায় একটি ক্যাথিড্রাল নির্মাণের প্রস্তাব দিলেও তা গৃহীত হয় নি। কারণ আগেই দেখা গেছে কোম্পানী নিজের খরচায় চার্চ নির্মাণে বিশেষ আগ্রহী ছিল না কারণ শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তারা মূলতঃ তখন ছিল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ক্রমশঃ কলকাতায় ইংরেজ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং সেন্ট জন চার্চের স্বল্প পরিসরে ক্যাথিড্রালের কার্যকলাপ বজায় রাখা কঠিন হচ্ছিল। তাই ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে যখন চতুর্থ বিশপ রেভারেন্ড টার্নারের সময় পুনরায় এই প্রস্তাব ওঠে তখন কোম্পানী কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আগ্রহী হয় এবং বিশপকে ক্যাথিড্রালের জন্য প্রয়োজনীয় জমি খোঁজার পরামর্শ দেয়। ময়দানের দক্ষিণে বিশপ টার্নার একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজে পান। কোম্পানী কর্তৃপক্ষ তখন ক্যাথিড্রাল নির্মাণের উদ্দেশ্যে একটি বোর্ড গঠন করেন। অবশেষে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ই অক্টোবর টার্নারের পরবর্তী বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালের শিলান্যাস করেন।ক্যাথিড্রাল যাতে কলকাতার জলবায়ুর উপযোগী হয় তার জন্য মেজর জেনারেল William Norin Forbes এর নকশা তৈরি করেন। ঠিক হয় গথিক ঘরানার সামান্য অদলবদল করে তৈরি হবে এই ক্যাথিড্রাল। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ই অক্টোবর চার্চটি প্রথম খুলে দেওয়া হয় এক বিরাট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন।
এই চার্চে সংরক্ষিত শিল্পবস্তুর মূল্য অপরিসীম। মঞ্চের পিছনের দেওয়ালটি ফ্লোরেন্টাইন মোজাইক স্টাইলের অপূর্ব রঙিন মুরাল চিত্রবিদ্বারা সজ্জিত। স্যার Arthur Bloomsfield এই নকশা তৈরি করেছিলেন। মধ্যভাগের তিনটি চিত্র বাইবেল বর্ণিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আধারে অঙ্কিত। এগুলি ছিল ‘Annunciation’,’The Adoration of the magai’ এবং ‘the flight into Egypt’। অন্য চিত্রগুলিতে খ্রীষ্টের জীবনের বিবিধ ঘটনা বর্ণিত যার মধ্য দিয়ে সন্তানদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়। মঞ্চের দক্ষিণ কোণে বিশপের যে সিংহাসনটি সংরক্ষিত সেটি বিশপ Ralph Johnson-এর স্মৃতি বিজড়িত যিনি ১৮৭৬ থেকে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা ও বার্মার বিশপের পদ অলংকৃত করেছিলেন। উত্তর এবং দক্ষিণের দেওয়ালে দুটো ছোট প্রার্থনাকক্ষ অবস্থিত যা আকর্ষণীয় ভাস্কর্য ও চিত্র দ্বারা সমন্বিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বিশপ Reginald Heber- এর আবক্ষ মূর্তি যাঁর পরিচিতি ছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার জন্য। এছাড়া চার্চের রূপকার মেজর জেনারেল নরিন ফোর্বস-এর মার্বেল মূর্তি ও একই কক্ষে অবস্থিত। ডানদিকের প্রার্থনাকক্ষের দেওয়ালে প্রবাদপ্রতিম বাঙালি চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের আঁকা ‘the last supper’ এর এক ক্ষুদ্র বাঙালি সংস্করণ দেখা যায়। এছাড়া পুত্র যিশুর মৃতদেহ কোলে মাথা মেরীর রঙিন চিত্রটিও উল্লেখের দাবী রাখে। আর আছে বাইবেলের কোরিয়ান অনুবাদ থেকে নেওয়া ৭২০০০ কোরিয়ান বর্ণমালা র দ্বারা বর্ণিত সেন্ট পলের গসপেল-এর সাহায্যে অঙ্কিত যিশুর চিত্র। এছাড়া চার্চের দেওয়ালে রক্ষিত মার্বেলের স্মৃতি ফলক গুলি ঔপনিবেশিক যুগের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাহিনী জানায়। চার্চের বড় ঘড়িটি সেযুগের বিশ্ববিখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা ‘Bhuliany’ র দ্বারা নির্মিত এবং আজো তা এই শহরকে শুনিয়ে চলে ঔপনিবেশিক কলকাতার ঐশ্বর্যের গৌরবগাথা। চার্চের বাইরের উত্তর দিকের দেওয়ালে প্রতিষ্ঠাকালীন লৌহ ক্রুশটি এখনো বিদ্যমান। যদিও মরচে ধরার ফলে সেটি পরে স্টিল নির্মিত ক্রুশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। চার্চের সম্মুখের প্রাঙ্গণ টি ‘Meditation Ground’ নামে পরিচিত।
১৮৯৭ ও ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে ক্যাথিড্রালের সুউচ্চ শিখরটি ধ্বসে পড়লেও তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোম্পানীর আমলে নির্মিত এই ক্যাথিড্রাল যা ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী পার্লামেন্টারি শাসনের সময়ে প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ শাসকের ধর্মবিশ্বাস তথা শৌর্যের স্মারকে পরিণত হয়েছিল তা আজও মহানগরীর ইউরোপীয় সংস্কৃতির এক গৌরবময় নিদর্শন রূপে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এভাবেই সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল তিলোত্তমা কলকাতার ভারতের প্রথম মেট্রোপলিটন হবার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।